• মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ৩১ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||

ভাষা আন্দোলনের ৭০ বছরে শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা

প্রকাশ:  ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৫:৩৩ | আপডেট : ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৫:৫০
আরিফুল ইসলাম সাব্বির
ছবি: বামে কাজী ফয়সাল আহমেদ, মাঝে সানজিদা জান্নাত পিংকি, ডানে রেদোয়ান আহমেদ

একুশ মানে মাথা নত না করা। একুশ মানে দৃপ্ত পায়ে শাসকের রক্তচোখকে উপেক্ষা করা। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ভাষার দাবিতে যে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন তাতে এমন মাইলফলকই তৈরি হয়েছিলো। তারই ধারাবাহিকতায় একের পর এক প্রতিবাদের শেষে সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে সৃষ্টি হয় বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের।

ভাষার দাবিতে আন্দোলনের ৭০ বছর পেরিয়েছে। ২১শে ফেব্রুয়ারি এলেই নতুন শপথে শহীদদের স্মরণ করে পুরো জাতি। তরুণ প্রজন্মের কাছে এখনো সেই ঘটনা সজীব। তবে তাদের মধ্যে ভাষা আন্দোলনের চাওয়া পাওয়া নিয়ে রয়েছে নানা প্রশ্ন। অনলাইন পূর্বপশ্চিমবিডিকে এমনই মতামত জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তারা বলছেন, সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলন নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে ভাষা আন্দোলনের দ্বিতীয় সংগ্রাম ছড়িয়ে দিতে হবে সকলের মধ্যে।

অন্য ভাষার দৌরাত্বে বাংলারই দেখা নেই

ভাষা আন্দোলনের ৭০ তম বছরে এসে আমাদের রেডিও গণমাধ্যম, নাটকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে দেখা যায় অন্য ভাষার সঙ্গে মিশিয়ে জগাখিচুরি কথা বলতে। হিন্দি সিরিয়ালের আগ্রাসনের পর সেখানে দখল নিয়েছে হিন্দি ভাষাও। শুধু সবকিছুতে বাংলারই দেখা নেই।

হিন্দি চ্যানেলগুলোর মাধ্যমে হিন্দি ভাষার উৎপাত। শিশুরাও হিন্দির দিকে ঝুঁকে পড়ছে। ব্রিটিশ বা পাকিস্তানি শাসনামলেও বাংলার যতটা বিকৃতি তারা করতে পারেনি, স্বাধীন বাংলাদেশে বাংলা ভাষার বিকৃতি ঘটছে তার চেয়ে অনেক বেশি।

আবার আমাদের দেশি টিভি নাটকগুলোতেও এক ধরনের গোঁজামিল দেয়া আঞ্চলিক ঢঙের অদ্ভুত ভাষার চর্চা করা হচ্ছে। চরিত্ররা সব সে ভাষায় কথা বলছে। মোবাইল ফোন কোম্পানির বিজ্ঞাপনে বাংলা ভাষা বিকৃত করা হচ্ছে। এটা ভাষার জন্য আরেকটা বিপদ। এখান থেকে পরিত্রাণ পাওয়াটা কঠিন।

ফেব্রুয়ারি কেবল ভাষার মাস—এটা ঠিক নয়। ভাষার মাস বলে আলাদা কোনো মাস নেই। বছরের সব মাসই ভাষার মাস। ফেব্রুয়ারি এলে ভাষাচর্চার কথা বলা আর বছরের অন্য মাসে তা ভুলে থাকা- এটা অন্যায়। ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে দেশের সংবাদপত্র ও টেলিভিশনমাধ্যমে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন নিয়ে অনেক আলোচনা হয়। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের ৭০ বছর পরও সর্বস্তরে বাংলা প্রচলন না হওয়ার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে না। অথচ সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনের জন্যই সেদিন আন্দোলন হয়েছিল।

ভাষা আন্দোলনের এতগুলো বছরেও শিক্ষার সর্বস্তরে বাংলা চালু হয়নি। পূরণ হয়নি ভাষা আন্দোলনের মূল ও মৌলিক প্রত্যাশা। শাসকরা বাংলা ভাষার ব্যাপারে উত্সাহিত না হওয়ার আরেক কারণ সমাজের মৌলিক কোনো পরিবর্তন তারা চান না। পরিবর্তন না হলেই তাদের সুবিধা। কারণ, পরিবর্তনটা এলে আর সবাই সমান হয়ে গেলে তাদের ওই সুযোগ-সুবিধা থাকবে না।

সমাজে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে হলে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে আমাদের আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। একাত্তরে স্বাধীনতা লাভের পরও সমাজে কোনো মৌলিক পরিবর্তন হয়নি। সমাজটা আগে যেরকম শ্রেণীবিভক্ত ছিল, এখনও সেরকমই রয়ে গেছে। শ্রেণীবিভাজন সমাজ সংরক্ষিত হচ্ছে পুঁজিবাদের কারণে। সমাজের নেতৃত্ব দিচ্ছেন বিত্তবানরা। তারা আছেন মূলত পুঁজিবাদের সঙ্গে। তারা তাই ইংরেজিতে কথা বলেন। বাংলা বললেও তা হয় ইংরেজি মিশ্রিত। মধ্যবিত্তরাও তাই করেন।

এই সময়ে এসে তাই আমাদের দৃপ্ত শপথ হওয়া উচিত সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনে প্রয়োজনে আরেকটি ভাষা আন্দোলনের ডাক দেয়া। যাতে শহীদদের ত্যাগ বৃথা না যায়।

সানজিদা জান্নাত পিংকি, শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, গণ বিশ্ববিদ্যালয়

শহীদ মিনারের সম্মান রক্ষা করতে হবে

গত বছরই আমরা বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করলাম। নিঃসন্দেহে বিষয়টি আমাদের জন্য ভীষণ গর্বের। দেখতে-দেখতে ভাষা আন্দোলনের বয়সও ৭০ পেরোলো। যদিও এটি একটি শোকের ঘটনা তবুও এটি আমাদেরকে বিভিন্ন সময়ে করেছে গর্বিত। বলা হয়ে থাকে আমাদের যে স্বাধীনতা সেই স্বাধীনতার বীজ রোপিত হয়েছিল ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে।সত্যিকারের থেকে আসলে একটি ধারণা নয়। এটি বাস্তবিকও। পশ্চিম পাকিস্তানীরা বরাবরই আমাদের ভাষা শহীদদের স্মরণে নির্মিত শহীদ মিনারকে ভয় করছে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে তারা বারবার কামানের গোলা তাক করেছে এই শহীদ মিনারের দিকে। সর্বশেষ ১৯৯৯ সালের আমাদের এর মাতৃভাষা দিবস আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করে। এবং এটাকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়। তারপর থেকে প্রতিবছরই একুশে ফেব্রুয়ারি সারা বিশ্বে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।

যাদের জন্য আমাদের এত অর্জন, যাদের জন্য আমরা মায়ের ভাষায় কথা বলতে পারছি আমরা কি পেরেছি তাদের প্রাপ্য সম্মানটুকু দিতে? আমাদের ভাষা আন্দোলনের ৭০ বছর এবং স্বাধীন দেশ হিসেবে ৫০ বছর পার করলেও আমরা এখনো আমাদের ভাষা সৈনিকদের প্রাপ্য সম্মানটুকু দিতে পারি নাই।

ভাষা সৈনিকদের রাষ্ট্রীয়ভাবে পর্যাপ্ত সম্মান দেয়া হয় কিনা তা নিয়ে বিতর্ক আছে। সচরাচর আমরা ভাষা সৈনিকদের আলাদা করে চিনি না। একুশে ফেব্রুয়ারি এলে আমরা তাদেরকে ক্ষণিকের জন্য বিশেষ সম্মান করি। কিন্তু তা পর্যাপ্ত নয়। একুশে ফেব্রুয়ারি চলে গেলে তাদের আর কোন খোঁজ খবর রাখা হয় না।কিছুদিন আগে এক জাতীয় দৈনিকে দেখছিলাম- একজন ভাষা সৈনিক, আমি তার নাম ঠিক স্মরণ করতে পারছিনা, তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর যোদ্ধাদের মতো রাষ্ট্রীয় সম্মাননার দাবি জানিয়েছিলেন। এটুকু তো তারা পেতে পারেন। পৃথিবীর আর কোথাও ভাষার জন্য কেউ আন্দোলন করেনি আত্মত্যাগ করেনি। কিন্তু আমাদের ভাষাসৈনিক রা সেটি করেছিলেন। আমরা তো তাদেরকে এই সম্মানটুকু দিতে পারি।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, ২১ ফেব্রুয়ারিতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারকে ঝকঝকে পরিষ্কার করে ফুল দিয়ে শহীদদের সম্মান জানানো হয়। তার দু-একদিন পর থেকে সারাবছরই এই বেদিতে জুতা পায়ে কেউ বসে থাকেন, কেউ হেঁটে যান, কেউ দাঁড়িয়ে গল্প করেন।

ভাষার জন্য যারা জীবন উৎসর্গ করলেন তাদের স্মৃতি বিজড়িত শহীদ মিনারের অযত্ন-অবহেলার কথা মেনে নেয়া যায় না। তবুও কর্তৃপক্ষ এদিকে নজর দিচ্ছেন না। নৈতিকতার দিক থেকেই শহীদ মিনারের প্রতি আমাদের যথাযথ সম্মান ও গুরুত্ব দেয়া উচিত।

শহীদ মিনার দেখাশোনার দায়িত্ব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলেও শহীদ মিনার সংক্রান্ত যাবতীয় প্রশাসনিক কাজ সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকেই করা হয়। সেটা যাই হোক না কেন, দায়িত্ব যারা পড়ে থাকুক না কেন প্রকৃতপক্ষে শহীদ মিনারের পর্যাপ্ত রক্ষণাবেক্ষণ করা একান্ত প্রয়োজন। যারা আমাদের জন্য এত কিছু করে গেলেন তাদের তাদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নির্মিত শহীদ মিনারের প্রতি আমরা সেটা কখনো মেনে নেয়া যায় না। শহীদ মিনারের প্রতি দায় আমাদের সকলের রয়েছে। আমরা কেউই শহীদ মিনারের যত্ন নিচ্ছি না। যদিও বৃহত্তর অর্থে শহীদ মিনারের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে আমাদের সকলের। আমাদের সবাইকে বেশি সচেতন হতে হবে আরও বেশি দায়িত্বশীল হতে হবে শহীদ মিনারের। তাছাড়া সরকারের শহীদ মিনারের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দেয়া খুবই প্রয়োজন তা না হলে এই শহীদ মিনারের সম্মান আমরা রক্ষা করতে পারবোনা।

আমরা আগামী বছরগুলোতে আমাদের ভাষার জন্য লড়াই করা বীর সৈনিকদের এবং শহীদদের তাদের প্রাপ্য সম্মানটুকু দিতে পারব।

কাজী ফয়সাল মাহমুদ, শিক্ষার্থী, সিএসই বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইইউনিভার্সিটি

সর্বস্তরে বাংলা প্রতিষ্ঠায় সবাইকে একত্র হতে হবে

প্রত্যেকটি মানুষই তার নিজের মাতৃভাষায় মনের ভাব, আনন্দ-বেদনা, বিভিন্ন ইচ্ছা মূলত সবকিছুই প্রকাশ করে। পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী সেই ভাষাকেই থমকে দিতে চেয়েছিলো পেশিশক্তির প্রভাব খাটিয়ে। তবে বাংলা ভাষাভাষী মানুষের প্রতিবাদের মুখে তাদের সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়।

বিশ্বজুড়ে বাংলা আজ অত্যন্ত সম্মানজনক আসন ও মর্যাদা লাভ করেছে। ৫২-এর ভাষা আন্দোলন আমাদের মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার একটি চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত।

ইতিহাসের পাঠ আমাদের জানায়, বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিলো শিক্ষার্থীরা। এই আন্দোলনের ভিড়ে তৎকালীন পাকিস্তানের সরকার গুলি বর্ষণ করেছিল। যে রফিক, জব্বার, শফিউল, সালাম, বরকত সহ অনেক ভাষা আন্দোলনকারী শহীদ হন। সেই দিনকেই পরে শহীদ দিবস হিসেবে পালন করা হয়।

তবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন-১৯৮৭’ প্রণয়ন করা হয় ১৯৮৭ সালের ৮ মার্চ।

এই আইনটি ব্যর্থ হলে ১৯৯৮ সালের শেষদিকে ‘বাংলা ভাষা বাস্তবায়ন কোষ’ গঠন করা হয়। এর কর্মপরিধির মধ্যে অন্যতম ছিল ব্রিটিশ আমল থেকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ও আদালতের প্রযোজ্য ইংরেজিতে প্রণীত আইন বাংলা ভাষায় রূপান্তর করা।

একুশে ফেব্রুয়ারিকে বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় ৫ই আগস্ট ২০১০ সালে এবং জাতিসংঘ কর্তৃক এই সিদ্ধান্তটি গ্রহণ করা হয়। এর পর থেকেই একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করা হয়ে আসছে।

তবে সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনের আইন করার পরও এখনো সর্বস্তরে বাংলার প্রচলন করা যায়নি। এমনকি উচ্চ আদালতেও পুরোপুরি বাংলা চালু হয়নি।

মাতৃভাষাকে উপেক্ষা করে নিস্তার থাকলেও বিবেকের দংশন থেকে আমাদের মুক্তি নেই। যাইহোক, ফেব্রুয়ারি মাস এলেই আমরা একটু বেশিমাত্রায় বাঙালিয়ানা শুরু করি। ষোলোআনা বাঙালি সাজতে প্রাণপণে চেষ্টা করি। বাঙালি চেতনা ও অস্তিত্ব বোধ যতটা না আমাদের অন্তরে আছে তার চাইতেও বেশি মাত্রায় কিছু করার চেষ্টা আমাদের অব্যাহত থাকে।

এই বাংলা ভাষাকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করতে গিয়ে এ জাতির বীর সন্তানরা তাদের বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে জীবন উৎসর্গ করেছিল, সে মাতৃভাষা বাংলাকে এভাবে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা মেনে নেওয়া যায় না। তাই আসুন, বাংলা ভাষাকে সর্বস্তরে ব্যবহার এবং প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আমরা সবাই মিলে একসঙ্গে সবাই মিলে কাজ করি।

রেদোয়ান আহমেদ, শিক্ষার্থী, দর্শন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

পূর্বপশ্চিম/এসকে

ভাষা আন্দোলন
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close