• সোমবার, ১৩ মে ২০২৪, ৩০ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||

একুশের গান যুগে যুগে

প্রকাশ:  ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৬:০৫ | আপডেট : ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ২৩:৫২
বিনোদন ডেস্ক

‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি’, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর লেখা আর আলতাফ মাহমুদের সুর করা এ গানটি শুনলেই চোখের সামনে ভেসে উঠে ভাইয়ের রক্তে রাঙা রাজপথ আর ছেলেহারা মায়ের অশ্রুভেজা নয়ন। যুগে যুগে একুশের গান বাঙালির হৃদয়ে ভাষা আন্দোলনের চেতনা আর বাঙালি জাতীয়তাবাদকে জাগ্রত করেছে। একুশের চেতনা ধারণ করা কিছু গানে চোখ রাখা যাক।

একটি কবিতা সুরের ছোঁয়ায় হয়ে ওঠলো চিরায়ত গান, পরিণত হলো জাতীয় চেতনার অংশে। এই অনন্য কবিতাটির রচয়িতা আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। বায়ান্নতে ছাত্র-গণহত্যার প্রতিবাদে ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ শীর্ষক এ কবিতাটি লিখেছিলেন তিনি। এটি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ সে বছর বিলি করে ছাত্র-জনতার মাঝে। পরের বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম শহীদ দিবস পালনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়। শহীদ দিবসের জন্য একটি গানের প্রয়োজন পড়ে । এই কবিতাটির তখন ছাত্রদের কাছে বেশ পরিচিতি পেয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের অনুরোধে এই কবিতাকে প্রথমে সুর দেন আবদুল লতিফ। পরে একই কথায় সুরারোপ করেন শহীদ আলতাফ মাহমুদ। তার তৈরি করা সুরেই গাওয়া হয় এখন ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি। ’ এই একটি গানই অমর করে রাখবে গীতিকার আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ও সুরকার আলতাফ মাহমুদকে।

অবশ্য ভাষা আন্দোলন নিয়ে প্রথম গান রচনা করেন ভাষা সৈনিক গাজীউল হক। প্রথমে অবশ্য কবিতা হিসেবেই তিনি লিখেন ‘ভুলব না ভুলব না একুশে ফেব্রুয়ারি ভুলব না’। পরে ছাত্র ইউনিয়নের সাংস্কৃতিক কর্মীরা একটি জনপ্রিয় প্রচলিত সিনেমার গানের সুরের সঙ্গে কবিতার লাইন মিলিয়ে তৈরি করে ভাষা আন্দোলনের প্রথম গান। ভাষা আন্দোলনের ওপর রচিত প্রথম গান নিয়ে অবশ্য খানিকটা বির্তকও আছে। কোনো কোনো গবেষকের মতে, ভাষা আন্দোলনের প্রথম গান রচনা করেন মোশারফ উদ্দীন আহমেদ। ১৯৫২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি তিনি লিখেন ‘মৃত্যুকে যারা তুচ্ছ করিল ভাষা বাঁচাবার তরে/ আজিকে স্মরিও তারে‘ শীর্ষক একটি গান।

গণসঙ্গীত শিল্পী আবদুল লতিফ কথা ও সুরে ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়’ গানটিও ভাষা দিবসের একটি উল্লেখযোগ্য গান। এই গানটি অবশ্য লেখা হয়েছিল বায়ান্নের আগেই ১৯৫১-এর শেষ ভাগে। তবে গানটি সমাদৃত হয় বায়ান্নের পরে। গানটির কয়েকটি লাইন পরবর্তীতে অবশ্য আব্দুল লতিফ পরিবর্তন করেছিলেন। সাংস্কৃতিক সংগঠন মুকুল ফৌজের কর্মীদের নিয়ে প্রথম তিনি এই গানটি গান। আব্দুল লতিফ এই গানটি ছাড়াও আরও একাধিক ভাষা আন্দোলনের সময়কার গান লিখেছিলেন, তার মধ্যে - ‘আমি দাম দিয়ে কিনেছি বাংলার’ এখনো জনতার মুখে মুখে ফেরে।

‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ গানটি শুধু ভাষা আন্দোলন নয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমৃদ্ধ একটি গান। ফজল-এ খোদার কথায় গানটি সুর করেন কণ্ঠশিল্পী আব্দুল জব্বার। তিনি নিজেই প্রথম গানটিতে কণ্ঠ দেন। এই গানটি একাত্তরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে সর্বাধিক পরিবেশিত একটি গান। মাতৃভাষা দিবস ছাড়াও এই গানটি স্বাধীনতা দিবস ও বিজয় দিবসে সর্বত্র পরিবেশন করা হয়।

ভাষা আন্দোলন নিয়ে রচিত আরেক কালজয়ী গান ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনও করিলিরে বাঙালি/ তোরা ঢাকার শহর রক্তে ভাসাইলি’। শামসুদ্দীন আহমেদ রচিত গানটি সুর করেন শহীদ আলতাফ মাহমুদ। প্রথম কণ্ঠ দেন রথীন্দ্রনাথ রায়। একুশে ফেব্রুয়ারির চেতনা নিয়ে লেখা হলেও এ গান ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।

মাতৃভাষা, ভাষা আন্দোলন ও শহীদ দিবস স্মরণে গত ষাট বছরে তৈরি হয়েছে অসংখ্য গান। এসব গানের মধ্যে কিছু আজও টিকে আছে, কিছু হারিয়ে গেছে কালের গর্ভে। যে গানগুলো এখনো টিকে আছে, সেগুলোর কয়েকটির প্রতি আলাদাভাবে দৃষ্টি দেওয়া যেতে পারে।

কবি শামসুর রাহমানের কথা ও খন্দকার নজরুল ইসলামের সুরে রুনা লায়লা গেয়েছেন ‘ফসলের মাঠে মেঘনার তীর’। রুনা লায়লা গাওয়া আরেকটি জনপ্রিয় ভাষা আন্দোলনের গান হলো ‘আমায় গেঁথে দাও না মাগো একটা পলাশ ফুলের মালা’।

নজরুল ইসলাম বাবুর কথা ও আলাউদ্দিন আলীর সুরে সাবিনা ইয়াসমীন গেয়েছেন ‘মায়ের শেখানো ভাষা’ এবং রফিকুল আলম গেয়েছেন ‘এক তারাতে সুর বাইন্দা’। নজরুল ইসলাম বাবুর লেখা আর আলাউদ্দিন আলীর সুরে সাবিনা ইয়াসমীন আরো গেয়েছেন ‘মায়ের শেখানো ভাষা’ গানটি। আবদুল লতিফের কথা ও সুরে সাবিনা ইয়াসমীনের কণ্ঠে‘ও আমার এই বাংলা ভাষা’ গানটির কথাও আলাদাভাবে উল্লেখ করতে হয়।

মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের কথা ও সমর দাসের সুরে শাকিলা জাফর গেয়েছেন ‘একুশ তুমি’, শাম্মী আক্তার কণ্ঠ দিয়েছেন ‘বরকত সালামের রক্ত’ গানটিতে। জাহিদুল হকের কথায় ও অজিত রায়ের সুরে শাম্মী আক্তার আরো গেয়েছেন ‘বর্ণমালায় গড়েছি বাংলাদেশ’। কবি আল মাহমুদের কথায় ও খন্দকার নুরুল আলমের সুরে শাকিলা জাফর গেয়েছেন আরো একটি ভাষার গান ‘ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ’।

জসিম রায়হানের কথায় এবং অজিত রায়ের সুরে সুবীর নন্দী গেয়েছেন ‘বাউল তুমি এমন দেশের কথা বল’। মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের কথা ও সমর দাসের সুরে এন্ড্রু কিশোর গেয়েছেন ‘শহীদ মিনার ভরে গেছে ফুলে ফুলে’। সৈয়দ আবদুল হাদী গেয়েছেন ‘মুখে মধুর বাংলা ভাষা’। আবিদা সুলতানা ও খুরশিদ আলম দ্বৈত কণ্ঠে গেয়েছেন ‘ক-এর রঙের মতো বাংলা’।

এছাড়া সমবেত কণ্ঠে রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমীন, শাকিলা জাফর, সৈয়দ আবদুল হাদী, সুবীর নন্দী, বশির আহমেদ, শাম্মী আখতার গেয়েছেন ‘ও আমার মুখের ভাষা’, ‘বাংলা আমার মায়ের ভাষা’, ‘একুশ মানে, ভাষার জন্যে ওরা’, ‘এক তারায় বাংলা’, ‘একুশ এলে মনে পড়ে’ প্রভৃতি গান।

একুশের চেতনায় রচিত গানগুলো সংরক্ষণের জন্য তেমন উদ্যোগ চোখে পড়ে না। দেশাত্ববোধক গানের বহু অ্যালবাম থাকলেও আলাদাভাবে ‘একুশের গান’ নিয়ে কোনো অ্যালবাম প্রকাশের তথ্য পাওয়া যায়নি। কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়ার আগে ভাষা আন্দোলনের গানগুলো সংরক্ষণের জন্য উদ্যোগ নেওয়া ভীষণ জরুরী।

পূর্বপশ্চিম-এনই

অমর একুশে
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close