আমার ফড়িং ধরার দিনগুলো
আমি বাংলাদেশের মেয়ে, তাই কালবৈশাখী নিয়ে আমার জীবনে কিছু না কিছু স্মৃতি তো আছেই। সেসব স্মৃতি যখন মনে পড়ে, তখন ভাবতে ভালোই লাগে। আমি শহরে বেড়ে উঠলেও আমার শৈশবের সঙ্গে গ্রামের সখ্যতা রয়েছে। মাঝে মাঝেই গ্রামে বেড়াতে যেতাম। তখন গ্রামে অনেক মজা করতাম। আসলে গ্রামে গেলেই বাংলার আসল সৌন্দর্য খুব কাছ থেকে অনুভব করা যায়। নির্মল বায়ুতে শ^াস নেওয়া যায়। আমি তখন ফড়িং ধরতাম। হয়তো ধরতে পারতাম আবার কখনো পারতাম না। তবুও ফড়িংয়ের পেছনে দৌড়তাম। এসব আমার রঙিন শৈশবের স্মৃতি। আজও আমি আমার ফড়িং ধরার দিনগুলো খুব মনে পড়ে। মাঝে মাঝে মনে হয় আবারও যদি সেই দিনকে ফিরে পেতাম, তাহলে অনেক ভালো হতো।
আমার নানা বাড়ি ছিল বরিশালের একটি গ্রামে। প্রতি বছরের গরমের সময়ে আমরা সেখানে ঘুরতে যেতাম। তাও আবার লঞ্চে যেতাম। নদীপথ ছিল বলেই লঞ্চ ছিল আমাদের প্রথম পছন্দ। নানাবাড়িতে অনেক আম গাছ ছিল। কালবৈশাখী ঝড় এলে আমি ও আমার কাজিনরা মিলে আম বাগানে আম কুড়াতে ছুটে যেতাম। মাঝে মাঝে তো এসব নিয়ে আমাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা হতো। সে আগে যেতে পারবে, কে বেশি আম কুড়াতে পারবে এসব প্রতিযোগিতা। যে যত বেশি আম পেত, তার গর্বও হতো তত বেশি। আম কুড়ানো শেষে আমরা সব আম একটি ঝুড়িতে রাখতাম। তার আগেই কিন্তু একটি আম ছুলানি রেডি করে রাখতাম। পাথরে ঝিনুক ঘষে এটি তৈরি করতাম। এটা দিয়ে খুব সহজে আম ছুলা যেত। তখনকার দিনে এভাবে আম খাওয়ার যে কত্ত মজা ছিল, তা যারা খেয়েছে শুধু তারাই জানে। আমার কাছে এটা উৎসবের মতো মনে হতো। আম কুড়ানো নিয়ে আমাদের মধ্যে ছোটখাটো ঝামেলাও হতো। তবে সেসব খুব স্থায়ী হতো না। এসব আম কুড়ানোর সুখের দিনগুলো আজও খুব মিস করি।
সম্পর্কিত খবর
আমি দেখেছি তখন মানুষ ঝড়কে খুব ভয় পেত। আমিও পেতাম। নানাবাড়ির গ্রামে যাদের মজবুত পাকা বাড়ি ছিল তারাও ঝড়ের আভাস পেলেই খুব ভয়ে থাকতো। আমার অনেক কাজিন ঝড়কে ভীষণ ভয় পেতে। ঝড় এলে ওদের মুখগুলো আতঙ্কে কালো হয়ে যেত। ওদের দিকে তাকানোই যেত না। ওরা তো ঝড়ের সময় মাঝে মাঝে ভয়ে খাটের নিচেও লুকাত। এসব কথা মনে পড়লে এখন হাসি পাই। তবে এসব স্মৃতিও মানুষের বেঁচে থাকার অনেক অবলম্বন।
আমি সবসময় ভাবতাম বৈশাখী উত্তর পশ্চিম দিক থেকে কেন আসে? আমার ধারণা ছিল ওই দিকটাই মনে হয় ঝড়ের বাসা। লঞ্চে যখন চড়তাম, তখন আমি সারাক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকতাম। আকাশ মেঘলা দেখলেই মনে হতো এই বুঝি ঝড় আসবে। একবার লঞ্চে নানাবাড়ি যাচ্ছি। হঠাৎ আকাশ মুখ গোমড়া করল। চারিদিক ভরে গেল কালো মেঘে। লঞ্চ কাঁপতে শুরু করল। প্রচণ্ড বেগে কালবৈশাখী ধেয়ে এল। শান্ত নদীটা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠলো। ঢেউগুলো আছড়ে পড়তে লাগলে লঞ্চের গায়ে। লঞ্চটাও উথাল পাথাল দুলছিল। ভয়ে তখন আমার গলা শুকিয়ে গেল। মনে হচ্ছিল এখনি লঞ্চটা উল্টে যাবে। আমি মনে মনে দোয়া-দরুদ পড়তে শুরু করলাম। অনেকে লঞ্চের মধ্যে আজান দিলেন। একসময় ঝড় কমে এল, আমি তখন একটু স্বস্তিবোধ করলাম। আমি সেদিন দেখেছিলাম নদী কত ভয়ঙ্কর হতে পারে। কালবৈশাখী নিয়ে এমন স্মৃতি আরও আছে। যে স্মৃতিগুলো আমাকে আজও পেছনের দিকে নিয়ে যায়। আমিও আমার ফেলে আসা শৈশবকে খুব মিস করি।
শ্রুতিলিখন: রবিউল কমল
পূর্বপশ্চিম- এনই