• মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

জহির রায়হানের অসমাপ্ত সিনেমা শেষ করায় সায় নেই পরিবারের

প্রকাশ:  ০৭ এপ্রিল ২০২৪, ২১:৫৭
পূর্বপশ্চিম ডেস্ক

ধর্ম, বর্ণ, জাতি ও সংস্কৃতির নামে বিশ্বজুড়ে হত্যাকাণ্ডের শিকার মানুষের আর্তনাদ তুলে ধরে ১৯৭০ সালে ‘‘লেট দেয়ার বি লাইট’’ নির্মাণ শুরু করেছিলেন কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান। তবে শুটিংয়ের মাঝখানে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ায় সিনেমার দৃশ্যধারণ আটকে থাকে। স্বাধীনতার পর মিরপুরে ভাইকে খুঁজতে গিয়ে তিনি শহীদ হন। থমকে যায় অসমাপ্ত সিনেমাটি।

সাম্প্রতিককালে এই বিষয়টি আবারও আলোচনায় উঠে এলেও অসমাপ্ত সিনেমা শেষ করায় সায় নেই পরিবারের।

জহির রায়হানের ছেলে অনল রায় জানিয়েছেন, অন্য পরিচালককে দিয়ে সিনেমাটি শেষ করতে চান না তারা। অস্কারজয়ী হলিউড নির্মাতা মার্টিন স্করসেসিও যদি জহির রায়হানের অসমাপ্ত এই ছবিটি শেষ করতে চান তাতেও অনুমতি দেয়া হবে না বলে দাবি করেন অনল।

এ প্রসঙ্গে ফেসবুকে একটি দীর্ঘ পোস্ট দিয়েছেন তিনি। সেখানে অনল রায়হান লিখেছেন, ‌‘‘সম্প্রতি একটি গণমাধ্যমে ‘লেট দেয়ার বি লাইট’ নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনটির মূল কথা- ছবিটি শেষ করা দরকার। ছবিটি শেষ করা লাগবে কেন? এটি জহির রায়হানের সরাসরি রাজনৈতিক একটি ছবি। তার রাজনৈতিক দর্শনের পরিষ্কার ও সোজাসাপটা শিল্প প্রকাশ হতো এটি। সুতরাং এখন যদি কেউ এই ছবি শেষ করতে চান, তিনি কি জহির রায়হানের মতাদর্শকে ধরতে পারবেন?’’

অনল লিখেছেন,‘‘স্টপ জেনোসাইড–এর বছরখানেক আগে তোলা হয়েছিল ‘লেট দেয়ার বি লাইট’। ‘স্টপ জেনোসাইড’–এ তিনি একটি জনযুদ্ধের ছবি তুলেছেন। কিন্তু ‘লেট দেয়ার বি লাইট’–এ চলচ্চিত্রকার হিসেবে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ স্বাধীন। রাজনীতি সচেতন শিল্পী হিসেবে ‘লেট দেয়ার বি লাইট’–এ তিনি তাঁর রাজনৈতিক মতকে সরাসরি উন্মোচন করতে চেয়েছিলেন, এতে আমার কোনো সন্দেহ নেই। এখন যিনি ছবিটি শেষ করবেন তার রাজনৈতিক মতাদর্শ কি জহির রায়হানীয়?’’

তিনি আরও লিখেছেন, ‘‘জহির রায়হান আজ বেঁচে থাকলে ‘লেট দেয়ার বি লাইট’–এ কি একই চলচ্চিত্রভাষা ব্যবহার করতেন? নাকি ছবিটা বানাতেনই না! নাকি ছবিটা শেষ করা হবে সে সময়ের আলোকেই? ৫৫ বছর আগে নির্মিত একটি অসমাপ্ত রাজনৈতিক ছবি কি সে সময়ের আলোকে শেষ করা যায়? যখন বিশ্ব বদলে গেছে, ইতিহাসের নতুন দৃষ্টিভঙ্গি এসেছে? যে পরিচালক আজকের বাংলাদেশ জানেন, আজকের আমেরিকা দেখেন তিনি ‘লেট দেয়ার বি লাইট’–এ নিজের ভাবনা ঢোকাবেনই। এ ছবি কোনোভাবেই জহির রায়হানের ছবি তো হবেই না, উল্টো এমন একজন মেধাবী বাঙালি চলচ্চিত্রকারের অসামান্য কাজটির ঐতিহাসিক মূল্য বিনষ্ট হবে।’’

অনল রায়হান লেখেন, ‘‘লেট দেয়ার বি লাইট’, ‘কাচের দেয়াল’ বা ‘জীবন থেকে নেয়া’র মতো লিরিক্যাল ফর্মেটের গল্পবলা ছবি নয়। এর নিজস্ব আঙ্গিক আছে। এই আঙ্গিক বা চলচ্চিত্রভাষা সম্পূর্ণ একটি মস্তিষ্কেরই আয়োজন। ছবিটির যদি লিখিত চিত্রনাট্যও থাকত তবু এই অসমাপ্ত ছবিতে আমি আর কারও হাত দেওয়ার পক্ষে থাকতাম না। বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ এই ছবির রাশ প্রিন্ট একবার লাইনআপ করেছিল এনজি শট ও ওকে শট দেখে। এটিরও প্রতিবাদ করেছেন অনল। তাঁর মতে, ‘লেট দেয়ার বি লাইট সম্পূর্ণ (বাতিল শটসহ) প্রদর্শন করা উচিত। মনে রাখতে হবে, চলচ্চিত্রের আগামীর ছাত্র-ছাত্রীর কাছে এই রাশ প্রিন্টের মূল্য হবে অপরিসীম।’’

অনল রায়হান আরও লেখেন, ‘‘এই ছবির প্রতি সুবিচার কেবল পরিচালক জহির রায়হানের নিজেরই করা সম্ভব। কারণ, তখনকার সময় এবং এখনকার সময়ের মধ্যে বিশাল ফারাক। পৃথিবী নানা পথ পেরিয়েছে। তা ছাড়া ছবিতে তার রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রকাশ করেছেন। যা চলচ্চিত্রে কেবল তিনিই বলতে পারতেন। পোস্টটি শেষ করেছেন এভাবে, ‘লেট দেয়ার বি লাইট’ অন্য পরিচালকের হাতে? আমি মানব না।’’

১৯৭০ সালে আগস্টের দিকে সিনেমার দৃশ্যধারণ শুরুর আগে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে সিনেমার মহরতে জহির রায়হান বলেছিলেন, ‘‘লেট দেয়ার বি লাইট’ সিনেমাটি তার সারা জীবনের স্বপ্নের ছবি।’’

সেখানে নায়ক-নায়িকা হিসেবে ওমর চিস্তি ও অলিভিয়া গোমেজকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন।

সেপ্টেম্বরে আরেক সংবাদ সম্মেলনে অলিভিয়ার বদলে ববিতাকে নিয়ে সিনেমাটি করার ঘোষণা দেন।

শুটিং শুরু হওয়ার পর আনুমানিক ৪০% কাজ শেষ হওয়ার পরই মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। স্বাধীনতার পর জহির রায়হান নিখোঁজ হওয়ার পর ছবিটিরও কোনো খোঁজ ছিল না।

সিনেমার ৩৫ মিমি ফুটেজ উদ্ধারের পর দেখা যায়, সেখানে ‘‘ওকে’’ শটের পাশাপাশি ‘‘এনজি’’ শটও ছিল; পরে ফিল্ম আর্কাইভের তত্ত্বাবধানে জহির রায়হানের ‘‘স্টপ জেনোসাইড’’–এর চিত্রসম্পাদক আবু মুসা দেবুকে দিয়ে ‘‘ওকে’’ শটগুলো আলাদা করানো হয়। ‘‘এনজি’’ শট বাদে পুরো ফুটেজের দৈর্ঘ্য দাঁড়ায় ৫৫ মিনিটের মতো। পরের তা ফিল্ম আর্কাইভে প্রদর্শনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও আর সম্ভব হয়নি।

ফিল্ম ইন্টারন্যাশনালের ব্যানারে এ সিনেমায় ওমর চিস্তি ও ববিতা ছাড়াও বনানী চৌধুরী, বকুল চৌধুরী, আমজাদ হোসেন, বিনয় বিশ্বাস, মাইকেল পিউরিফিকেশন, বদরুদ্দিনসহ আরও অনেকে অভিনয় করেছেন। পরিচালনার পাশাপাশি কাহিনি, চিত্রনাট্যেও ছিলেন জহির রায়হান। সংগীত পরিচালনা করেছেন খান আতাউর রহমান। সহযোগী পরিচালক ছিলেন ইলতুতমিশ, সহযোগী প্রযোজনায় হায়দার আলী।

বিনোদন,সিনেমা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close