• শনিবার, ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||

ভারতীয় মালাবার দেশে আসলে বেকার হবে লক্ষাধিক শ্রমিক

প্রকাশ:  ০২ এপ্রিল ২০২২, ১৫:১১ | আপডেট : ০২ এপ্রিল ২০২২, ১৫:৩৭
নিজস্ব প্রতিনিধি

মালাবার বাংলাদেশে রেডিমেট গহনা এনে ব্যবসা করলে কর্মহারা হবে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত লক্ষাধিক সোনার কারিগর। বন্ধ হয়ে যাবে শত বছরেরও পুরনো সব গহনা তৈরির কারখানা। সেই সঙ্গে বৈশ্বিক বাজারে বাংলাদেশি গহনা রপ্তানির সম্ভাবনাও ভেস্তে যাবে।

জানা গেছে, মালাবার গোল্ড অ্যান্ড ডায়মন্ড'স চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে অনুষ্ঠিত তৃতীয় বাংলাদেশ ইকোনমিক ফোরামে বাংলাদেশে ব্যবসা করার ঘোষণা দেয়। দুবাইয়ে এ প্রতিষ্ঠানটির মুল ব্যবসায়িক কার্যালয় হলেও মূলত এ ভারতীয় প্রতিষ্ঠানটি আগামী তিন থেকে পাঁচ বছরে ১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের তৈরি করা সোনার গহনা বাংলাদেশের বাজারে আনবে বলে জানায়। দুবাইয়ের মুভেনপিক গ্র্যান্ড হোটেলে অনুষ্ঠিত ফোরামে এ ঘোষণা দেয় মালাবার গোল্ড অ্যান্ড ডায়মন্ডসের অর্থ ও প্রশাসনের পরিচালক আমীর সিএমসি।

সম্পর্কিত খবর

    মালাবারের এমন ঘোষণার পরই আতংকিত হয়ে পড়েন দেশের সোনার কারিগর ও কারখানার মালিকরা। তারা জানান, মূলত এ দেশের স্বর্ণ চোরাচালানি চক্র ও স্বর্ণ শিল্প ধ্বংসের চক্রান্তের সঙ্গে জড়িতরাই মালাবারকে বাংলাদেশে আনতে ইন্ধন দিচ্ছে। দেশের স্বর্ণ শিল্পকে বাঁচিয়ে রপ্তানিমুখী করতে মালাবারের বাংলাদেশে আসা যে কোন মুল্যে ঠেকানোরও ঘোষণা দিয়েছেন তারা।

    ঢাকা স্বর্ণ শিল্পী শ্রমিক সংঘের সাধারণ সম্পাদক দিনেশ চন্দ্র পাল এ বিষয়ে বলেন, একটি আসাধু চক্র বিদেশী রেডিমেট গহনা দেশে আনার চোরাচালানি চক্রের সঙ্গে জড়িত। তারাই চায় বিদেশী রেডিমেট গহনা উৎপাদকারী বাংলাদেশে এসে ব্যবসা করুক। এই চক্রটি চায় আন্তজার্তিক বাজারে বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় স্বর্ণ শিল্প ধ্বংস হোক। এখন তারা ভারতীয় প্রতিষ্ঠান মালাবারকে বাংলাদেশে আনার চক্রান্ত করছে। তিনি বলেন, বর্তমানে বিদেশ থেকে রেডিমেট গহনা আসায় দেশী কারিগররা কাজ পায় না। এ জন্য সোনার কারিগরা অন্য পেশায় চলে যাচ্ছে।

    দিনেশ চন্দ্র পাল বলেন, সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রনালয়ে আমরা বিভিন্ন সময় চিঠি দিয়েছি, যাতে করে রেডিমেট গহনা আনা বন্ধ হয়। আমরা বার বার সরকারকে অনুরোধ করেছি গার্মেন্টেসের পরই যেন দেশের স্বর্ণ শিল্প প্রধান রপ্তানি পণ্য হয় সে সুযোগ করে দিতে। কিন্তু সরকার থেকে এ বিষয়ে কোন সাড়া নেই। অথচ আমাদের কারিগরদের তৈরি করা গহনার বিদেশে বিপুল চাহিদা রয়েছে। এখানকার কারিগরদের হাতে তৈরি গহনার ফিনিশিং ও সৌন্দর্য্য পৃথিবীর আর কোথাও নেই।

    দিনেশ চন্দ্র পাল বলেন, এখন সময় এসেছে দেশের স্বর্ণ শিল্পের বিকাশে সরকারের সহযোগিতা করার। সরকার থেকে কাঁচামাল বা আমাদেরকে কাঁচামাল আনার সুযোগ দিলে দেশে গহনা তৈরি করে রপ্তানি করা সম্ভব। বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা আমরাই সরকারকে এনে দিব।

    তিনি বলেন, মালাবার অন্য কোন বিদেশী বাংলাদেশে এসে ব্যবসা করুক আমরা তা চাইনা। এটা করা হলে এ শিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে। এদেশের লক্ষাধিক সোনার কারিগর বেকার হয়ে যাবে। বিদেশী কোম্পানির ব্যবসার পাশাপাশি অবৈধ গহনা আমদানি ঠেকাতে সরকারকে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।

    ঢাকা স্বর্ণ শিল্পী শ্রমিক সংঘের সিনিয়র সহ সভাপতি শংকর বসাক বলেন, বিদেশী কোন প্রতিষ্ঠান রেডিমেট গহনা নিয়ে যদি এ দেশে আসে তাহলে দেশের স্বর্ণ শিল্প শেষ হয়ে যাবে । এমন উদ্যোগ থেকে সরকারকে অবশ্যই সরে আসতে হবে।

    তিনি বলেন, বিদেশী কোন গহনা দেশে আনা যাবে না। কারণ আমাদের কারিগরদের হাতে তৈরি গহনার বিদেশে অনেক চাহিদা আছে। তারপরও বর্তমানে কাজের অভাবে আমাদের কারিগররা ভারতে চলে যায়। সেখানে গিয়ে তারা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাচ্ছে। কারণ ভারত সোনা রপ্তানি করে। ভারত সরকারও প্রচুর রেভিনিউ পায় এখাত থেকে। বিদেশী কোম্পানিকে সুযোগ না দিয়ে দেশের কারিগরের তৈরি সোনার অলংকার রপ্তানির সুযোগ দিলে আমাদের সরকারেরও বছরে কয়েক হাজার কোটি টাকা রেভিনিউ আয়ের সুযোগ থাকবে।

    প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষন করে শংকর বসাক বলেন, বিদেশী কোম্পানিকে ও বিদেশী গহনা আমদানি ঠেকান। নতুবা এ দেশের স্বর্ণ শিল্পীরা না খেয়ে মারা যাবে। সেই সঙ্গে দেশের রপ্তানিমুখী সম্ভাবনাময় এ শিল্প খাতটি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাবে।

    ঢাকা স্বর্ণ শিল্পী শ্রমিক সংঘের সভাপতি ও বাজুসের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি গঙ্গাচরন মালাকার বলেন, সারা বিশ্বের স্বর্ণ রপ্তানির প্রধান বাজার হলো দুবাই। সেখানে সব দেশের শো-রুম আছে। নেই শুধু বাংলাদেশের। আমরা যত দিন সোনার গহনা রপ্তানিতে না যাব তত দিন এ শিল্পের সাফল্য আসবে না। সরকারের রপ্তানি আয়ও বাড়বে না। সরকার এদেশে বিদেশী প্রতিষ্ঠানকে এনে ব্যবসার সুযোগ না দিয়ে আমাদের তৈরি করা গহনা রপ্তানির সুযোগ করে দিক। আমরা গার্মেন্টসের চেয়ে বেশি রপ্তানি আয় এনে দিব সরকারকে।

    তিনি বলেন, বর্তমানে ভারত সারা বিশ্বের সোনার গহনার মোট প্রায় ৭৫ শতাংশ রপ্তানি করে। এটা সম্ভব হয়েছে বাংলাদেশী কারিগরদের কারণে। বাংলাদেশ থেকে তারা হাজার হাজার কারিগর নিয়ে গেছে। অথচ এই কারিগরগুলোর উৎপাদিত সোনার গহনা আমরাই রপ্তানি করতে পারতাম।

    গঙ্গাচরন মালাকার বলেন, বর্তমানে ইতালি, তুরস্ক ও ইন্ডিয়া মেশিনে সোনার গহনা উৎপাদন করলেও আমাদের দেশে তৈরি অলংকারই সারা পৃথিবীর মধ্যে সেরা। এত সুক্ষ ও হালকা ওজনের গহনার পৃথিবীর কেউ বানাতে পারে না। তারপরও বিদেশী গহনা আমদানির কারণে আমাদের সোনার কারিগররা এখন অটো রিক্সা চালিয়েও জীবিকা নির্বাহ করে। এখন যদি মালাবার বাংলাদেশে আসে তাহলে লাখের অধিক কারিগর বেকার হয়ে যাবে । সরকার তাদের কর্মসংস্থান করবে কিভাবে? সুতরাং এদেশের স্বর্ণ শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা মালাবারকে বাংলাদেশে ব্যবসা করতে দিবে না।

    বাংলাদেশের গহনা সারা বিশ্বে রপ্তানির সুযোগ আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ বিষয়ে একাধিক বার উদ্যোগ নিয়েছিলাম আমরা। কিন্তু সরকার থেকে সাড়া পাই না। এখন বসুন্ধরা গ্রুপ যে উদ্যোগ নিয়েছে সরকারের উচিত একে পৃষ্ঠপোষকতা করে বড় করতে দেওয়া।

    সরজমিনে রাজধানীর তাঁতিবাজার ঘুরে দেখা গেছে, বিভিন্ন ভবনের ছোট-বড় কারখানাগুলো টুক টুক শব্দে গহনা বানানোতে ব্যস্ত কারিগররা। সেই সঙ্গে কপালে চিন্তার ভাজ। মালাবার বাংলাদেশে আসা খবরে বেকার হওয়ার আতংকে চিন্তিত আনন্দ গোল্ড ওয়ার্কসপের কারিগর ও মহাজন ৬৫ বছর বয়স্ক মদন পালকে বলা হয় তাঁতি বাজারের সবচেয়ে বয়স্ক ও সিনিয়র কারিগর।

    প্রায় ৪৫ বছর ধরে সোনার বালা বানিয়ে আসা এ কারিগর বলেন, এই শিল্পের এখন আর সুদিন নেই। কারণ বিদেশী রেডিমেট গহনা দেদারছে আসে। আগে তাঁতি বাজারে কারিগরদের জন্য হাটা যেত না। এখন তাঁতি বাজার ফাঁকা পড়ে আছে। গত কয়েকদিন শুনতেছি ভারতীয় প্রতিষ্ঠান মালাবার রেডিমেট গহনা এনে এ দেশে বিক্রি করবে। এটা হলে আমরা সবাই বেকার হয়ে যাব।

    তিনি বলেন, এ শিল্পের অনেক কারিগর ভারত আগেই নিয়ে গেছে। তারপরও আমারা এটি ধরে রেখেছি। এখন ভারত বাংলাদেশের স্বর্ণ শিল্পকে পুরোপুরি ধ্বংস করতে চায়।

    তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশী কারিগররা আট আনায় যে গহনা তৈরি করতে পারে ভারতে সেটা করতে প্রায় দেড় ভরি সোনা লাগে। এজন্য ভারতের ঈর্ষা হয়। বিদেশী ক্রেতারাও বাংলাদেশী গহনা কিনতে চান। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগের অভাবে আমাদের গহনা রপ্তানি করা সম্ভব হয় না।

    মা গোল্ড হাউজ কারখানার মহাজন ও কারিগর সুধীর কুমার পাল বলেন, একজন কারিগরের ৩ থেকে ৪ বছর সময় নিয়ে গহনা তৈরির কাজ শিখে। এই শিল্পে দেশ জুড়ে লাখের অধিক শ্রমিক আছে।

    তিনি বলেন, বিদেশী প্রতিষ্ঠান মালাবার বাংলাদেশে আসলে এই লক্ষাধিক শ্রমিক বেকার হয়ে যাবে। আমাদের কারখানাগুলোও বন্ধ হয়ে যাবে। এমনিতেই চোরাচালানে আসা রেডিমেট গহনার কারণে দেশের কারিগররা কাজ পায় না। তার উপর বিদেশি এ প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশে আসলে দেশের স্বর্ণ শিল্প একেবারে মরে যাবে। কারিগরদের ও দেশের স্বর্ণ শিল্প বাঁচাতে হলে বিদেশী রেডিমেট গহনা দেশে না আনতে সরকারকে কঠোর হতে হবে।

    সুদীর পাল বলেন, বিদেশী কোম্পানির বাংলাদেশে আসা ঠেকাতে প্রয়োজনে সারাদেশের সব স্বর্ণ কারিগররা আন্দোলনে মাঠে নামবে।

    তাঁতি বাজারের আরেক কারিগর পলাশ মালাকার আমিন জুয়েলার্সের জন্য গহনা তৈরি করেন জানিয়ে বলেন, এ শিল্প এখন ভাল নেই। বিদেশ থেকে রেডিমেট গহনা আসায় কাজের চাপ কম। পুরো মাস কাজ করতে পারলে দিন পরিবার ও সন্তানদের নিয়ে ভাল থাকতে পারি। না হলে সংসার চালাতে হিমশিম খাই। বিদেশী প্রতিষ্ঠান দেশে রেডিমেট গহনা এনে বিক্রি করলে পুরোপুরি বেকার হয়ে যাব।

    তাঁতিবাজারের সোনার কারিগর প্রকাশ বর্মন বলেন, আমাদের হাতে তৈরি করা গহনার বিদেশে অনেক চাহিদা আছে। সরকারীভাবে এ শিল্পকে পৃষ্ঠপোষকতা করলে দেশীয় কারিগরদের তৈরি করা গহনা বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব। তাই আমরা চাই সরকার কোন বিদেশী প্রতিষ্ঠানকে এদেশে আসার সুযোগ না দিক।

    সন্দীপ জুয়েলারি ওয়ার্কসপের মহাজন ও কারিগর বিশ্বজিৎ কর্মকার বলেন, আমার কারাখানার আপন জুয়েলার্সের গহনা তৈরি করা হয়। এই কারখানায় শ্রমিক কমতে কমতে এখন মাত্র ৩ জন আছে। তারপরও কাজ নেই। মাসে গড়ে ১৫ থেকে ২০ দিন কাজ থাকে। অর্ধেক মাসের আয় দিয়েতো পুরো মাস পরিবার নিয়ে চলে না। তাই এই শিল্প ছাড়ছে কারিগররা।

    বাংলাদেশ ছেড়ে কারিগররা ভারত চলে যাচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, সরকারকে যে কোন মূল্যে বিদেশী রেডিমেট গহনা দেশে আনা বন্ধ করে দেশী কারিগরের বানানো গহনাকে সুবিধা দিতে হবে। কারণ বাংলাদেশী কারিগরের তৈরি করা গহনার বিদেশীদের কাছে অনেক চাহিদা আছে। সরকার থেকে সুযোগ করে দেওয়া হলে আমাদের তৈরি গহনা রপ্তানি করে দেশ উন্নত হবে। আমরাও ভাল থাকবো।

    তাঁতিবাজারের সোনার কারিগর আফজাল তালুকদার ২০০২ সালে থেকে গহনা তৈরির কাজ করছেন জানিয়ে বলেন, বর্তমানে এ শিল্পের শ্রমিকরা ভাল নেই। কারণ দেশের বাজারে বিদেশী রেডিমেট গহনা ব্যাপক হারে ঢুকে। এ অবস্থায় বিদেশী প্রতিষ্ঠান দেশে আসলে পরিবার নিয়ে না খেয়ে মরতে হবে।

    পূর্বপশ্চিমবিডি/জেএস

    স্বর্ণ শিল্প
    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close