• শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
  • ||

গভীর সংকটে জ্বালানি নিরাপত্তা, বিপাকে বিপিসি

প্রকাশ:  ১৪ জুলাই ২০২২, ২২:১১ | আপডেট : ১৪ জুলাই ২০২২, ২২:১৯
নিজস্ব প্রতিবেদক

ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার নেই; তারা জ্বালানি তেল আমদানি করতে ব্যাংক ঋণপত্র খুলতে অপরাগতা প্রকাশ করছে। ফলে পাওনা পরিশোধে চাপ থাকলেও তেল সরবরাহকারী বিদেশি সংস্থার পাওনা পরিশোধ নিয়মিত করা যাচ্ছে না। এতে জ্বালানি তেল আমদানি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। সমস্যার সমাধানে সংস্থাটি দফায় দফায় চিঠি দিয়েও সমাধান পাচ্ছে না তারা।

এক বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়, পরিস্থিতি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, অর্থ বিভাগ ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে (ইআরডি) ৫ জুলাই একটি চিঠি দিয়েছে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ।

চিঠিতে বলা হয়, “প্রয়োজনীয় পরিমাণ ডলারের সংস্থানসহ চাহিদা অনুযায়ী এলসি (ঋণপত্র) খোলা সম্ভব না হলে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে মর্মে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে বিপিসি।”

বিষয়টি “অতীব জরুরি” উল্লেখ করে চিঠিতে আরও বলা হয়, দেশের চাহিদার প্রায় শতভাগ জ্বালানি তেল বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। পর্যাপ্ত পরিমাণ ডলারের সংস্থান ও ঋণপত্র খোলার বিষয়ে সহযোগিতা চেয়ে ইতিমধ্যে একাধিকবার বাংলাদেশ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।

জ্বালানি বিভাগের চিঠিতে বলা হয়, জ্বালানি তেল আমদানিতে প্রতি মাসে ১৬ থেকে ১৭টি আমদানি ঋণপত্র খুলতে হয়। ঋণপত্রগুলো সাধারণত সোনালী ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক ও ইস্টার্ণ ব্যাংকে খোলা হয়ে থাকে। অভ্যন্তরীণ বাজারে ডলারের ঘাটতি রয়েছে জানিয়ে ব্যাংকগুলো চাহিদা অনুযায়ী ঋণপত্র খুলতে প্রায়ই অপারগতা প্রকাশ করছে। বিপিসি এটি একাধিকবার চিঠি দিয়ে জানিয়েছে। এছাড়া ঋণপত্র খুললেও তেল সরবরাহকারীর মূল্য পরিশোধে দেরি হচ্ছে। একাধিক কিস্তিতে পরিশোধ করতে হচ্ছে। এতে করে জ্বালানি তেল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অবনতি হতে পারে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দামও ক্রমে বাড়ছে।

বিপিসি সূত্রে জানা যায়, গত এপ্রিলের শুরু থেকেই ঋণপত্র খোলা ও তেলের দাম পরিশোধ নিয়ে জটিলতা দেখা দেয়। বিষয়টি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা হয়। মন্ত্রণালয় থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি পাঠানো হলে কিছু ডলার ছাড় করা হয়। এরপর আবার ব্যাংকগুলো অস্বীকৃতি জানাতে থাকলে গত ১৭ মে ও ২৩ জুন দুই দফায় জ্বালানি বিভাগে চিঠি পাঠায় বিপিসি।

দেশে ৩৫ থেকে ৪০ দিনের জ্বালানি তেল মজুত করতে পারে বিপিসি। ঋণপত্র খোলা না গেলে নতুন করে জ্বালানি তেলের ক্রয়াদেশ দেওয়া যাবে না। এতে করে তেল আমদানি কমে যাবে। আর তাহলে সামনে সরবরাহ-সংকট তৈরি হতে পারে। দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার ৩৪% জ্বালানি তেলের ওপর নির্ভর করে। আর পরিবহন খাতের ৯০% এর বেশি নির্ভর করে জ্বালানি তেলের ওপর।

এই পরিস্থিতিতে সরকারি ব্যাংকগুলো বিমাতাসুলভ আচরণ করছে বলে জানান বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। তিনি সংবাদমাধ্যমটিকে জানান, সরকারি ব্যাংকগুলো বিমাতাসুলভ আচরণ করছে। বৈদেশিক মুদ্রা ধরে রাখার জন্য তারা এটি করছে। দেরি করার মানে হলো জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে দেওয়া। বাংলাদেশ ব্যাংককে বিষয়টি জানানো হয়েছে।

ব্যাংক-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল ও ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ায় আমদানি খরচ অনেক বেশি বেড়ে গেছে। অন্যদিকে রপ্তানি আয় বাড়লেও কমেছে প্রবাসী আয়। এতেই দেখা দিয়েছে মার্কিন ডলারের সংকট। ফলে ডলারের দাম বেড়ে হয়েছে ৯৩ টাকা ৯৫ পয়সা। ডলার সংকটের কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানিতে কড়াকড়ি আরোপ করেছে। ব্যাংকগুলোও ঋণপত্র খোলার বিষয়ে কঠোর অবস্থান নিয়েছে।

জ্বালানি খাতে শুধু তেল নয়; তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসও (এলএনজি) আমদানি করে সরকার। আর তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) আমদানি করে বেসরকারি খাতে।

বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই থেকে মে পর্যন্ত সময়ের চেয়ে ২০২১-২২ অর্থবছরের একই সময়ে পেট্রোলিয়াম পণ্যের আমদানি ব্যয় বেড়েছে ১১১%। জ্বালানি পণ্যের জন্য আগে ৩৯৬ কোটি ডলারের ঋণপত্র খোলা হলেও তা বেড়ে হয়েছে প্রায় ৮৩৭ কোটি ডলারে। একই সময়ে আগে পরিশোধ করা হয়েছে ৩৭৬ কোটি ডলার আর সর্বশেষ পাঁচ মাসে পরিশোধ করা হয়েছে ৭৭৭ কোটি ডলার। দুই মাস ধরে জ্বালানি তেলের দাম আরও বাড়ছে বিশ্ববাজারে। প্রতি মাসে ৭৩ থেকে ৭৫ কোটি ডলারের ঋণপত্র খোলা দরকার বলে জানিয়েছে বিপিসি।

বৈদেশিক মুদ্রা আয় কমে যাওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা মজুতের ওপরও চাপ তৈরি হয়েছে। দেশে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত এখন ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমেছে। এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নকে (এসিইউ) আমদানির অর্থ পরিশোধের পর রিজার্ভ কমে গেছে। গত বছরের ডিসেম্বরে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪৬.১৫ বিলিয়ন ডলার।

অর্থনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়া, সেই অনুপাতে রপ্তানি না বাড়া, রেমিটেন্স কমে যাওয়া এবং ডলারের তুলনায় টাকার অবমূল্যায়ন- প্রভৃতি কারণে রিজার্ভ কমে গেছে। আর জ্বালানি আমদানিতে ব্যয় আরও বেড়ে গেলে রিজার্ভে টান বাড়তেই থাকবে। সাধারণভাবে তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো রিজার্ভ থাকার কথা বলা হলেও রিজার্ভ কমে যাওয়া অর্থনৈতিক শক্তি কমে যাওয়াকে ইঙ্গিত করে। বাংলাদেশের এখনো পাঁচ-ছয় মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর মত রিজার্ভ থাকলেও তাতে আশ্বস্ত হওয়ার কিছু নেই। কারণ আমদানি ব্যয়ের তুলনায় রপ্তানি আয় কমতে থাকলে রিজার্ভও কমতে থাকবে। একই সঙ্গে প্রবাসী আয় কমতে থাকলেও পরিস্থিতি খারাপের দিকে যেতে পারে। বাংলাদেশকে গড়ে মাসে এখন সাত মিলিয়ন ডলারের বেশি আমদানি ব্যয় মেটাতে হয়।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. মীর্জা আজিজুল ইসলাম জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলেকে বলেন, “আশঙ্কার বিষয় না থাকলেও দ্রুতই রিজার্ভ আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে হবে। আমদানি কমাতে হবে। বিশেষ করে বিলাসপণ্যের। সরকার উদ্যোগ নিয়েছে। এলসি মার্জিন বাড়িয়েছে। কিন্তু সেটা কতটা কার্যকর হচ্ছে দেখা দরকার। রপ্তানি বাড়াতে হবে। আর রেমিটেন্স বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। প্রণোদনা বাড়ানো যেতে পারে। কার্ব মার্কেটে তো ডলারের দাম ব্যাংকের চেয়ে বেশি। তাই সব রেমিটেন্স ব্যাংকিং চ্যানেলে আনার ব্যবস্থা করতে হবে।”

প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ বছরে প্রায় ১৫ লাখ টন অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করে। সৌদি আরবের সৌদি অ্যারাবিয়ান অয়েল কোম্পানি (সৌদি আরামকো) ও আরব আমিরাতের আবুধাবি ন্যাশনাল অয়েল কোম্পানি লিমিটেড (অ্যাডনক) থেকে এ তেল কেনা হয়। তবে সবচেয়ে বেশি আমদানি হয় পরিশোধিত জ্বালানি তেল। বছরে ৪০ লাখ টন শুধু ডিজেল আমদানি করে বিপিসি। এছাড়া ফার্নেস অয়েল, পেট্রলসহ আরও কিছু তেল আমদানি করতে হয়। এসব তেল সরবরাহ করে কুয়েতের কুয়েত পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (কেপিসি), মালয়েশিয়ার পেটকো ট্রেডিং লাবুয়ান কোম্পানি লিমিটেড (পিটিএলসিএল), আরব আমিরাতের এমিরেটস ন্যাশনাল অয়েল কোম্পানি (ইনক), চীনের পেট্রোচায়না (সিঙ্গাপুর) পিটিই লিমিটেড ও ইউনিপেক (সিঙ্গাপুর) পিটিই লিমিটেড, ইন্দোনেশিয়ার পিটি বুমি সিয়াক পুসাকু (বিএসপি), থাইল্যান্ডের পিটিটি ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডিং পিটিই লিমিটেড, ভারতের নুমালিগড় রিফাইনারি লিমিটেড (এনআরএল)। এর বাইরে উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমেও জ্বালানি তেল কেনে বিপিসি।

তেল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্তত দুটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সতর্ক করে বিপিসিকে চিঠি দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিপিসির একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ব পরিস্থিতি বিবেচনায় কিস্তিতে টাকা পরিশোধের বিষয়টিও মেনে নিয়েছে সরবরাহকারীরা। এটিও করা যাচ্ছে না বলে তারা সতর্ক করে বলেছে, এমন হলে আর তেল সরবরাহ করা যাবে না। অথচ দফায় দফায় সরকারকে অবহিত করেও কোনো সমাধান মিলছে না।

জ্বালানি পণ্যের আমদানি কমলে বিদ্যুৎ ও পরিবহন খাতে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হবে বলে মনে করছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জ্বালানিবিষয়ক বিশেষ সহকারী ম. তামিম।

তিনি সংবাদ মাধ্যমটিকে বলেন, বিপিসির কাছে টাকা থাকলেও লাভ হচ্ছে না। জ্বালানির উচ্চ মূল্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ডলার-সংকট। এখনই তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র সব চালানো যাচ্ছে না। আমদানি কমলে সামনে আরও ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হবে। শুধু বিদ্যুৎ নয়, পরিবহন খাতও চাপে পড়বে। বড় ধরনের বিপর্যয় এড়াতে হলে তেলের দাম পরিশোধে ডলার দিতেই হবে।

পূর্বপশ্চিমবিডি/এআই

জ্বালানি সংকট,বিপিসি
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close