• শনিবার, ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||

৩৭শ’ কোটি টাকা লুটপাটে দায়ী পাঁচ ডেপুটি গভর্নর

প্রকাশ:  ১৭ অক্টোবর ২০২২, ১৮:১০
পূর্বপশ্চিম ডেস্ক

বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি লিমিটেড (বিআইএফসি) ও ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডে (আইএলএফএসএল) আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনায় দায় রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক পাঁচ ডেপুটি গভর্নরসহ ২৪৯ কর্মকর্তার। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তিনটি বিভাগের এই কর্মকর্তাদের যোগসাজশে বিপুল পরিমাণ অর্থ লুট করেছেন আলোচিত প্রশান্ত কুমার হালদার (পি কে হালদার) এবং মেজর (অব.) মান্নান। নজিরবিহীন এই অনিয়মের কারণ ও দায়ীদের চিহ্নিত করতে হাইকোর্টের নির্দেশে গঠিত উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটির আলাদা তদন্ত প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। মোট ১২শ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন দুটি এরই মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের কাছে জমা দেওয়া হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বিআইএফসি ও আইএলএফএসএল থেকে অবৈধভাবে জামানতবিহীন ঋণ নিয়ে মোট ৩ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এর মধ্যে আইএলএফএসএল শুধু ভারতে কারাবন্দি প্রশান্ত কুমার হালদার (পি কে হালদার) এবং তার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামেই নেওয়া হয়েছে ৩ হাজার ১৩০ কোটি টাকা। আর বিআইএফসি থেকে বিকল্পধারার মহাসচিব মেজর (অব.) মান্নান ও তার প্রতিষ্ঠান নিয়ে গেছে ৬০০ কোটি টাকা। বছরের পর বছর ধরে এই লুটপাটের ঘটনা ঘটলেও নিশ্চুপ ছিলেন প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা।

এতে বলা হয়, নজিরবিহীন এই লুটের ফলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান দুটির মোট সম্পদের তুলনায় দায়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় দ্বিগুণ। আইএলএফএসএলের মোট সম্পদ ৪ হাজার ৫৯৮ কোটি টাকা। আর বর্তমানে দায়ের পরিমাণ ৭ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। ভারতে কারাবন্দি আলোচিত প্রশান্ত কুমার হালদার (পি কে হালদার) এবং তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে নেওয়া হয়েছে ৩ হাজার ১৩০ কোটি টাকা। আর বিএফআইসির মোট সম্পদ ৯২৭ দশমিক ২৯ কোটি টাকা হলেও প্রতিষ্ঠানটির দায় ১ হাজার ৮৩৫ দশমিক ৯৬ কোটি টাকা। এ প্রতিষ্ঠান থেকে মেজর (অব.) আব্দুল মান্নান ও তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে নেওয়া টাকার পরিমাণ প্রায় ৬০০ কোটি।

প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে এভাবে লুটপাট ও আত্মসাতের সময় আর্থিক প্রতিষ্ঠান দুটির পরিচালনা পর্ষদে যারা ছিলেন তারা সবাই ছিলেন পি কে হালদার ও মেজর (অব.) মান্নানের নিজস্ব লোক। তারা বিভিন্ন ব্যাংক, অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি পর্যায় থেকে আমানত সংগ্রহ করেছেন। এরপর এসব টাকা ঋণের নামে নিজেদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে কোনো প্রকার জামানতবিহীনভাবেই ছাড় দেওয়া হয়েছে। এমনকি নিজেদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট নামসর্বস্ব ও কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামেও ঋণ দিয়েছে।

তদন্ত প্রতিবেদনে এই লুটপাটের জন্য প্রধানত নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগ এবং ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন বিভাগকে দায়ী করা হয়েছে। এতে আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগে ২০০৯ থেকে ২০২০ পর্যন্ত দায়িত্ব পালনকারী ৩ জন ডেপুটি গভর্নর, ৬ জন নির্বাহী পরিচালক, ১১ জন মহাব্যবস্থাপক (জিএম) এবং ১৫ জন উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) এবং বিভিন্ন পর্যায়ের আরও ১২৪ কর্মকর্তাকে দায়ী করা হয়েছে। এ ছাড়া ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন বিভাগের দুজন ডেপুটি গভর্নর, নির্বাহী পরিচালকসহ মোট ৫১ জনকে দায়ী করা হয়েছে। এ ছাড়া আর্থিক প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন বিভাগের দুজন ডেপুটি গভর্নর, ৮ জন নির্বাহী পরিচালক, ৫ জন জিএমসহ মোট ২৯ কর্মকর্তার নাম এসেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘সংঘটিত আর্থিক অনিয়ম ও অবৈধ কর্মকাণ্ড রোধ ও নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার জন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগে এবং পরিদর্শনের দায়িত্ব সম্পাদনকারী বিভাগে সংশ্লিষ্ট সময়ে সিদ্ধান্ত প্রদানকারী পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাগণের প্রত্যেকেই যার যার ক্ষমতা ও পদমর্যাদার ক্রমানুপাতে কর্মকালের ব্যাপ্তিভেদে দায়ী।’

পাশাপাশি যেসব ব্যাংক কোনো জামানত ছাড়াই এই দুটি প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিয়ে বছরের পর বছর ফেলে রেখেছে তাদেরও প্রতিবেদনে দায়ী করা হয়েছে। এ ছাড়া যথাযথ তদারকি না করায় রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এবং অডিট ফার্মগুলোকেও দায়ী করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৫ সালের পর থেকে মেজর (অব.) মান্নান ও তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও আত্মীয়স্বজনের নামে-বেনামে ২০১৪ পর্যন্ত ৫১৭ কোটি টাকার ঋণ নেওয়া হয়েছে। এরপর অদৃশ্য কারণে বিআইএফসিতে ২০১৫ সালে বিশেষ পরিদর্শন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০১৫ সালের আগে বিআইএফসির পরিচালনা পর্ষদে দায়িত্ব পালনকারী সবাইকেই দায়ী করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

আইএলএফএসএল সম্পর্কে বলা হয়েছে, ব্যাপক অনিয়ম, দুর্নীতি ও অবৈধ কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ২০১৫ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে পি কে হালদার ও তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট অস্তিত্ববিহীন কাগুজে প্রতিষ্ঠান উপযুক্ত জামানত ছাড়াই মোট ৩ হাজার ১২৯ কোটি ৬৩ লাখ টাকা স্থানান্তরের মাধ্যমে আত্মসাৎ করা হয়েছে। এক প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ মঞ্জুর দেখিয়ে ভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিতরণের মাধ্যমে এই টাকা নেওয়া হয়েছে। এসব আর্থিক অনিয়ম, জাল-জালিয়াতি ও মানি লন্ডারিং অপরাধে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং-এর ক্রেডিট কমিটি, এক্সিকিউটিভ কমিটিসহ পরিচালনা পর্ষদের সংশ্লিষ্ট সব সদস্য এবং ব্যবস্থাপনার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা যার যার ক্ষমতা ও পদমর্যাদার ক্রমানুযায়ী দায়ী।

বাংলাদেশ ব্যাংকের দুই বিভাগের দায়ী যারা

দুই প্রতিবেদনে ২০০৯ থেকে ২০২০ পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগে দায়িত্ব পালনকারী তিনজন ডেপুটি গভর্নরের নাম এসেছে। তারা হলেন—ডেপুটি গভর্নর সীতাংশু কুমার (এস কে) সুর চৌধুরী (১৩ জানুয়ারি, ২০১২ থেকে ৬ ডিসেম্বর, ২০১৬), এস এম মনিরুজ্জামান (৭ ডিসেম্বর, ২০১৬ থেকে ৩০ নভেম্বর, ২০২০), মো. নজরুল হুদা (৪ সেপ্টেম্বর, ২০০৯ থেকে ৩১ ডিসেম্বর, ২০১১)। এ ছাড়া এই বিভাগে বিভিন্ন মেয়াদে নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্বে থাকা এ এইচ এম কায়-খসরু, মো. নওশাদ আলী চৌধুরী, মো. মাহফুজুর রহমান, শেখ আবদুল্লাহ, জোয়ার্দার ইসরাইল হোসেন ও মো. শাহ আলম, ১১ জন মহাব্যবস্থাপক, ১৫ জন উপমহাব্যবস্থাপকসহ ১২৪ কর্মকর্তার নামও প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

একইভাবে ব্যাংক পরিদর্শন বিভাগের ডেপুটি গভর্নর মুরশিদ কুলি খান (৪ জানুয়ারি, ২০০৯ থেকে ৩১ ডিসেম্বর, ২০১১), আবু হেনা মো. রাজি হাসানকে (২৩ জানুয়ারি ২০১২ থেকে ৩১ ডিসেম্বর ২০১৫) দায়ী করা হয়েছে। এ ছাড়া এই বিভাগের নির্বাহী পরিচালক এ টি এম নাসির উদ্দিনসহ, জিএম ও ডিজিএম পর্যায়ের আরও ১৬ জন এবং নিচের দিকের আরও ৩৩ কর্মকর্তার নাম এসেছে প্রতিবেদনে।

আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার পরিদর্শন বিভাগের ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মোহাম্মদ রাজী হাসান (৭ জুলাই ২০১৫ থেকে ৬ ডিসেম্বর ২০১৬) ও ডেপুটি এস এম মনিরুজ্জামান (৭ ডিসেম্বর ২০১৬ থেকে ২০২ সালের ৩০ নভেম্বর), নির্বাহী পরিচালক শেখ আবদুল্লাহ, এ এন এম আবুল কাশেম ও সিরাজুল ইসলামসহ ৮ জন নির্বাহী পরিচালক, ৫ জন জিএম, ডিজিএমসহ বিভিন্ন পর্যায়ের ২৪ জনকে দায়ী করা হয়েছে।

বিএফআইসির ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন, ১৯৯৩ অনুযায়ী বিআইএফসিতে সংঘটিত কর্মকাণ্ডসহ তদারকি ও নিয়ন্ত্রণের সম্পূর্ণ দায়িত্ব ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগের। প্রতিষ্ঠানটি থেকে পাওয়া বিভিন্ন কার্যবিবরণী, মূলধন বিবরণী, তারল্য প্রতিবেদন, এফআইসিএল, ক্যামেলস সংক্রান্ত তথ্য, নিরীক্ষিত আর্থিক বিবরণী, বার্ষিক প্রতিবেদন ইত্যাদি এবং অনসাইট সুপারভিশন তথা ২০০৯ সালের পূর্বে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সম্পাদিত বছরভিত্তিক সরেজমিন পরিদর্শনে (বিশদ পরিদর্শন) প্রাপ্ত এবং ২০০৯ সালের পর থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ব্যাংক পরিদর্শন বিভাগ-২ (উপ-বিভাগ-৬)-এর সম্পাদিত বছরভিত্তিক সরেজমিন পরিদর্শনে (বিশদ পরিদর্শন) প্রাপ্ত তথ্যাদি পর্যালোচনা করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করার নিয়মিত দায়িত্ব ছিল। এ ছাড়াও বিশেষ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা দৃষ্টিগোচর হলে বিশেষ পরিদর্শন করার এবং প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতা ছিল।

বিআইএফসিতে প্রতিবছর সরেজমিন পরিদর্শন (বিশদ পরিদর্শন) ছাড়া ২০১৫ সালের আগে অন্য কোনো কার্যক্রম আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগ থেকে গ্রহণ করা হয়নি। প্রতিবছর সরেজমিন পরিদর্শন (বিশদ পরিদর্শন) দায়সারাভাবে করা হয়েছে। ২০০৫ সালের পর থেকে নিয়ম লঙ্ঘন করে পরিচালকদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও আত্মীয়স্বজনের অনুকূলে ঋণ মঞ্জুর ও বিতরণ করা হয়ে আসছিল কোনোরকম জামানত ছাড়াই। মঞ্জুরকৃত ঋণের চেয়ে বহুগুণ বেশি অর্থ ছাড় করা, এক প্রতিষ্ঠানের নামে মঞ্জুর করে ভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে চেক ইস্যু করা, কিস্তি আদায় না হওয়া সত্ত্বেও ঋণকে বিরূপ মানে শ্রেণীকরণ না করে নিয়মিত দেখানো ঋণ গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানের পরিচালক বা মালিকদের পরিচয় গোপন করে ঋণ মঞ্জুর ও বিতরণ করা হয়েছে। কিন্তু বিআইএফসিতে প্রতিবছর বিশদ পরিদর্শনসমূহ অত্যন্ত গুরুত্বহীনভাবে আনুষ্ঠানিকতা সম্পাদনের মতো করে করা হয়েছে, যা পরিদর্শনকারীদের দু-একজনের বক্তব্যে সুস্পষ্টভাবে এবং অন্যদের বক্তব্যেও পরোক্ষভাবে ফুটে উঠেছে। শুরু থেকেই অনিয়ম খতিয়ে দেখা হলে পরিচালকদের স্বার্থসংশ্লিষ্টতা, ঋণের প্রকৃত সুবিধাভোগী ও ঋণের প্রকৃত উদ্দেশ্য উদ্ঘাটিত হতো এবং অনিয়ম ও অবৈধ কর্মকাণ্ড বন্ধ করা যেত।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোনো কোনো বছরের বিশদ পরিদর্শনে পর্ষদ গঠন, ঋণ প্রদান ইত্যাদি বিষয়ে গুরুতর অনিয়মের চিত্র থাকলেও পরিদর্শন প্রতিবেদনে শাস্তির আওতায় আনার কঠোর ব্যবস্থা না করে নমনীয়ভাবে বিআইএফসিকে সুপারিশ বা পরামর্শ দিয়ে হালকা করে দেখানো হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিও আকর্ষণ করা হয়নি। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তরাও তেমনি নমনীয়ভাবে নোট দিয়ে পরিসমাপ্ত করেন এবং নোটসহ শুধু সারসংক্ষেপ অফসাইট সুপারভিশনে আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগে পাঠান। আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগও প্রতিবেদন ছাড়াই শুধু সেসব নোটসহ সারসংক্ষেপপ্রাপ্ত হয়েই যথেষ্ট মনে করে এবং সেসব নোটসহ সারসংক্ষেপ গভীরভাবে বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা না করেই নথিভুক্তির মাধ্যমে পরিসমাপ্ত করে দায় সারে। ২০১৫ সালের বিশেষ পরিদর্শনের আগে পর্যন্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগে দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তাদের বক্তব্য থেকেও তা প্রমাণিত হয়।

আইএলএফএসএলের অনিয়মে বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়

তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, আইএলএফএসএলে ২০০৮ সালে মুনাফা বেশি দেখিয়ে মূলধন সংরক্ষণের পরিমাণও বেশি দেখানো হয়। ফলে প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক অবস্থা ভুয়াভাবে অধিকতর ভালো দেখানো হয়েছে। এটি উপেক্ষা করার মতো তুচ্ছ অনিয়ম নয়। এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করা এবং পুনরাবৃত্তিরোধে নির্দেশনা দেওয়া আবশ্যক ছিল। কিন্তু তা করা হয়নি। এ ছাড়া মেয়াদি আমানত ২০০৫, ২০০৬, ২০০৭ এবং ২০০৮ সালে ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়ে যথাক্রমে ৯৩ কোটি ৪৮ লাখ, ১৫৩ কোটি ৭৪ লাখ, ১৯২ কোটি ৬২ লাখ এবং ২৭১ কোটি ৪০ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে। এ সত্ত্বেও প্রতিষ্ঠানটির বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে গৃহীত তহবিল ২০০৬, ২০০৭ ও ২০০৮ সালে যথাক্রমে ১ কোটি ৩০ লাখ, ৩ কোটি ৩৩ লাখ ও ৪ কোটি ৪৬ রাখ টাকা, যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। দীর্ঘমেয়াদি আমানত এবং বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করে বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ খাতে ঋণ বিতরণ করে ২০০৬, ২০০৭ এবং ২০০৮ সালে যথাক্রমে ১৬.২০ শতাংশ, ৩০.০৯ শতাংশ ও ২৪.৬৭ শতাংশ সম্পদের বৃদ্ধি দেখানো হয়েছে বলে ২০০৮ সালের পরিদর্শনে উদ্ঘাটিত হয়। কিন্তু এ বিষয়ে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়েও বিআইএফসির মতোই প্রতিবছর অফসাইট সুপারভিশন একেবারেই গুরুত্বহীনভাবে করা হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়, যা ইতোপূর্বে বিআইএফসি-সংক্রান্ত তদন্তকালে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বক্তব্যে পাওয়া গেছে। বিভিন্ন ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠান থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ নানা অনিয়ম, কারসাজি, যোগসাজশ ও অবৈধ কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সংগ্রহ করে বহু বছর ধরে অনাদায়িভাবে ফেলে রাখা হয়। এই অর্থ আদায়ে কোনো আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। ব্যাংক পরিদর্শন বিভাগ বরাবরই এ বিষয়টি এড়িয়ে গেছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগও বরাবরই এ বিষয়টি এড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের অফসাইট সুপারভিশন বিভাগও বরাবরই এ বিষয়টি এড়িয়ে গেছে।

বিএফআইসি এবং আইএলএফএসএলে সংঘটিত আর্থিক অনিয়ম ও অবৈধ কর্মকাণ্ড রোধ ও নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার জন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগ এবং পরিদর্শনের দায়িত্ব সম্পাদনকারী বিভাগে সংশ্লিষ্ট সময়ে সিদ্ধান্ত প্রদানকারী পর্যায় পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা প্রত্যেকেই যার যার ক্ষমতা ও পদমর্যাদার ক্রমানুপাতে কর্মকালের ব্যাপ্তিভেদে দায়ী বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

তহবিল সরবরাহকারী ব্যাংকগুলোর দায়

বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে কলমানি, ট্রেজারি লাইন, সঞ্চয়ী এবং মেয়াদি ঋণ হিসেবে বিআইএফসি ও আইএলএফএসএল শত শত কোটি টাকা নিয়েছে। ব্যাংক থেকে বিনা জামানতে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ সহজে পেয়ে যাওয়া দুটি প্রতিষ্ঠান থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাতের অন্যতম কারণ বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এসব ঋণ একসময় খেলাপি হলেও তা আদায়ে ব্যাংকগুলো দৃশ্যমান কোনো কার্যক্রম গ্রহণ করেনি। এমনকি খেলাপি তথ্য সময় মতো সিআইবিতে দেয়নি। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দায় এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

আরজেএসসি এবং বিএসইসির দায়

বছরের পর বছর ধরে প্রকৃত সত্য গোপন করে মিথ্যা তথ্য দিয়ে আর্থিক প্রতিবেদন তৈরি করে কোম্পানির প্রকৃত অবস্থা আড়াল এবং কাল্পনিক মুনাফা দেখিয়েছে এই দুই প্রতিষ্ঠান। কিন্তু রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ (আরজেএসসি) এবং বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড একচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) কখনো কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে বলে দেখতে পাওয়া যায়নি। তারা সময় মতো পদক্ষেপ নিলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান দুটিতে এ ধরনের অনিয়ম বছরের পর বছর ধরে চলে আসতে পারত না। তাই এ দুটি প্রতিষ্ঠানও দায় এড়াতে পারে না।

তদন্ত শুরুর প্রেক্ষাপট

বিএফআইসির শেয়ারহোল্ডার বিদেশি অংশীদারি প্রতিষ্ঠান ‘টিজমার্ট ইনকরপোরেটেড’ রুহুল আমিনের নেতৃত্বাধীন তৎকালীন পরিচালনা পরিষদের বিরুদ্ধে আইন পরিপন্থি কর্মকাণ্ড ও ফান্ড আত্মসাতের অভিযোগে পরিচালনা পর্ষদ অপসারণের দাবিতে হাইকোর্টের কোম্পানি কোর্টের কাছে আবেদন করেন। শুনানি নিয়ে ২০২০ সালে হাইকোর্টের বিচারপতি খুরশিদ আলম সরকারের একক বেঞ্চ হাইকোর্ট প্রত্যাশা ব্যক্ত করে বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের অসৎ কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় অসৎ ব্যবসায়ীদের দ্বারা আর যেন পাবলিকের অর্থ তছরুপ না হয় সে জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক জাতির বৃহত্তর স্বার্থে বিষয়টি খতিয়ে দেখবে। পরে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর এ কে এম সাজেদুর রহমান খানকে সভাপতি ও বৈদেশিক মুদ্রা পরিদর্শন বিভাগের উপমহাব্যবস্থাপক মো. সারোয়ার হোসেনকে সদস্য সচিব করে ৫ সদস্যের ‘কারণ উদ্ঘাটন’ (ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং) কমিটি গঠন করেন। কমিটির সদস্যরা হলেন—বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক এ কে এম ফজলুর রহমান, ফাইন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি ডিপার্টমেন্টের মহাব্যবস্থাপক মো. কবির আহাম্মদ, ব্যাংক পরিদর্শন বিভাগ-৪-এর মহাব্যবস্থাপক মো. নুরুল আমীন। পরে স্বাধীন সদস্য হিসেবে সচিব নুরুর রহমান এবং সাবেক সাবেক জেলা ও দায়রা জজ মঈদুল ইসলামকে কমিটিতে যুক্ত করা হয়।

গভীর অনুসন্ধান করে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত— ড. সালেহউদ্দীন

তদন্ত প্রতিবেদন সম্পর্কে অবহিত করা হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দীন আহমেদ বলেন, ‘হাইকোর্টের নির্দেশে প্রতিবেদন দেওয়া হলে তা নিয়ে বিস্তারিত মন্তব্য করা ঠিক হবে না। তবে আরও গভীর অনুসন্ধানের মাধ্যমে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারে। এক্ষেত্রে দুই ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। যদি ব্যাংকের লোক জড়িত থাকে তাহলে প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে পারে। সেই সাথে আইনি ব্যবস্থাও নিতে পারে। কেননা আমাদের দেশে এ রকম অনেক তথ্যই বের হয়। কিন্তু সেই অনুযায়ী যৌক্তিক ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। ফলে সমস্যাগুলো থেকেই যায়। আর যারা সমস্যাগুলো তৈরি করে তারাও উৎসাহ পায়। কেননা ধরা পড়লেও এসব বিষয়ে কোনো ব্যবস্থাই তো নেওয়া হয় না। আদালত থেকে এ বিষয়টি নিশ্চিত করা উচিত। যাতে আইনের শাসন সুনিশ্চিত হয়, তাহলে এই বিষয়ে সবাই ভয় পাবে।’ সূত্র: কালবেলা।

পূর্বপশ্চিমবিডি/এসএম

গভর্নর,লুটপাট,টাকা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close