• রোববার, ১৯ মে ২০২৪, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
  • ||

রিজার্ভ নামছে ৩০ বিলিয়নে

প্রকাশ:  ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১১:৩২ | আপডেট : ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:৫২
নিজস্ব প্রতিবেদক

বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রিতে নতুন রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অস্থির ডলারের বাজার সুস্থির করতে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (২০২২ সালে ১ জুলাই থেকে ২৩ ফেব্রুয়ারি) প্রায় ১ হাজার (১০ বিলিয়ন) ডলার বিক্রি করা হয়েছে। এর আগে কোনো অর্থবছরের (১২ মাস) পুরো সময়েও রিজার্ভ থেকে এত ডলার বিক্রি করা হয়নি।

সর্বশেষ গত সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবারও রাষ্ট্রায়ত্ত কয়েকটি ব্যাংকের কাছে ১২ কোটি ডলারের মতো বিক্রি করা হয়েছে। বুধবার পর্যন্ত বিক্রি করা হয়েছিল ৯৮০ কোটি (৯.৮০ বিলিয়ন) ডলার। সব মিলিয়ে এই অর্থবছরে রিজার্ভ থেকে ৯৯২ কোটি (৯.৯২ বিলিয়ন) ডলার বিক্রি করা হয়েছে। এর ফলে রপ্তানি আয় ও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স বৃদ্ধি এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বহুলপ্রতীক্ষিত ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার পাওয়ার পরও বর্তমান বিশ্ব পেক্ষাপটে অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর সূচক কমছেই। বৃহস্পতিবার দিন শেষে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩২ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলার।

এক বছর আগে গত বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪৫ দশমিক ৮৪ বিলিয়ন ডলার। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) নভেম্বর-ডিসেম্বর মেয়াদের ১ দশমিক ১২ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ কমে ৩২ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছিল। তার আগে ছিল প্রায় ৩৪ বিলিয়ন ডলার।

মার্চের প্রথম সপ্তাহে আকুর জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মেয়াদের আমদানি বিল পরিশোধ করতে হবে। সেই বিল ১ বিলিয়ন ডলার হলেও রিজার্ভ কমে ৩০ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসবে বলে আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা।

অথচ গত ২০২১-২২ অর্থবছরের পুরো সময়ে (১২ মাস, ২০২১ সালের জুলাই থেকে ২০২২ সালের জুন) রিজার্ভ থেকে ৭৬২ কোটি (৭.৬২ বিলিয়ন) ডলার বিক্রি করেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তার আগের অর্থবছরে (২০২০-২১) ডলারের সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় বাজার থেকে উল্টো প্রায় ৮০০ কোটি (৮ বিলিয়ন) ডলার কিনেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।

অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ২০২১ সালের আগস্টে রিজার্ভ যে ৪৮ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করেছিল, তাতে বাজার থেকে ডলার কেনার অবদান ছিল বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর। আবার এখন যে রিজার্ভ কমছে, তাতে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি একটি বড় কারণ বলে মনে করছেন এই অর্থনীতিবিদ।

করোনা মহামারি পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করায় ২০২১ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে দেশে আমদানি বাড়তে শুরু করে; লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে অর্থনীতির এই সূচক। তাতে বাজারে ডলারের চাহিদা বেড়ে যায়, বাড়তে থাকে দাম। সেই চাহিদা মেটাতে ডলার বিক্রি শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক।

২০২১-২২ অর্থবছরের পুরো সময় ধরে চলে এই বিক্রি। রিজার্ভ থেকে ডলার বাজারে না ছাড়লে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম আরও বেড়ে যাবে- এ বিবেচনায় ডলার বিক্রি অব্যাহত রাখে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। শেষ পর্যন্ত ৭ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার বিক্রির মধ্য দিয়ে অর্থবছর শেষ হয়।

গত অর্থবছরের ধারাবাহিকতায় চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরেও রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি অব্যাহত রাখে বাংলাদেশ ব্যাংক। আগে সব ব্যাংকের কাছে প্রয়োজনীয় ডলার বিক্রি করলেও তিন মাস ধরে শুধু সরকারি কেনাকাটা ও জ্বালানি তেল, সারসহ অন্যান্য অতিপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির জন্য এলসি বা ঋণপত্র খুলতে রাষ্ট্রায়ত্ত কয়েকটি ব্যাংকের কাছে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করা হচ্ছে। বর্তমানে ১০১ টাকা দরে ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর বেসরকারি ব্যাংকগুলো আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজার থেকে ডলার কিনে আমদানি খরচ মেটাচ্ছে। বৃহস্পতিবার আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজারে টাকা-ডলারের বিনিময় হার ছিল ১০৭ টাকা। অর্থাৎ যে ব্যাংকের ডলার প্রয়োজন হয়েছে, সে ব্যাংকগুলো ১০৭ টাকা দরে অন্য ব্যাংক থেকে ডলার কিনে চাহিদা মিটিয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক বলেন, ‘চলতি অর্থবছরের বুধবার পর্যন্ত রিজার্ভ থেকে ৯ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করা হয়েছিল। বৃহস্পতিবারও কয়েকটি ব্যাংকের কাছে কিছু ডলার বিক্রি করা হয়। তবে ঠিক কত ডলার বিক্রি করা হয়েছে, সে তথ্য এখন আমার কাছে নেই। কাল (রোববার) অফিসে গেলে বলতে পারব।’

ফরেক্স রিজার্ভ অ্যান্ড ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘বৃহস্পতিবার কয়েকটি ব্যাংকের কাছে মোট ১২ কোটি ডলারের মতো বিক্রি করা হয়েছে।’

বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, ইরান, মিয়ানমার, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ বর্তমানে আকুর সদস্য। এই দেশগুলো থেকে বাংলাদেশ যেসব পণ্য আমদানি করে তার বিল দুই মাস পরপর আকুর মাধ্যমে পরিশোধ করতে হয়। মহাসংকটে পড়ায় শ্রীলঙ্কা অবশ্য মাস দেড়েক আগে আকুর থেকে বেরিয়ে এসেছে।

আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রা মজুত থাকতে হয়। গত ডিসেম্বরে ৬ বিলিয়ন ডলার আমদানি খরচ হিসাবে বর্তমানের রিজার্ভ দিয়ে সাড়ে পাঁচ মাসের আমদানি খরচ মেটানো যাবে।

ডলারসংকট কাটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। তার পরও সংকট কাটছে না। ফলে জরুরি আমদানির দায় মেটাতেই রিজার্ভ থেকে ডলার সহায়তা দিতে হচ্ছে। তবু আটকে থাকছে কোটি কোটি ডলারের পণ্য। ডলারসংকটে আমদানিকারকদের চাহিদা মেটাতে পারছে না ব্যাংকগুলো। সে কারণেই বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করছে। গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সব ব্যাংকের কাছে ডলার বিক্রি করলেও রিজার্ভ কমে যাওয়ায় পাঁচ মাস ধরে শুধু সরকারি আমদানি ব্যয় মেটাতে রাষ্ট্রায়ত্ত কয়েকটি ব্যাংকের কাছে ডলার বিক্রি করা হচ্ছে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘আশার কথা হচ্ছে, তিন মাস ধরে ৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি রপ্তানি আয় দেশে এসেছে। রেমিট্যান্সও কিছুটা ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে। এই দুই সূচক যদি না বাড়ত আর আইএমএফের ঋণের প্রথম কিস্তি যদি না আসত, তাহলে কিন্তু রিজার্ভ আরও কমে যেত। এখন কথা হচ্ছে, আগামী দু-এক মাসের মধ্যে আইএমএফের ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। বিদেশি ঋণও কমছে। আগামী মাসগুলোতে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্সপ্রবাহ যদি কমে যায়, তখন কিন্তু রিজার্ভ আরও কমে যাবে।’

সে কারণে রিজার্ভ বাড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকারকে বিদেশি মুদ্রা সরবরাহের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করার পরামর্শ দিয়ে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স বাড়ানোর পাশাপাশি বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকাসহ অন্য দাতাদের কাছ থেকে ঋণ-সহায়তা পাওয়ার ক্ষেত্রেও জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে সরকারকে। যুদ্ধের ধাক্কায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিও বেশ চাপে পড়েছে। অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলোর পাশাপাশি রিজার্ভও কমছে। এই চাপ সামাল দিতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন এখন কম সুদের বিদেশি ঋণ-সহায়তা। সে ক্ষেত্রে কম সুদের ঋণের সুদের হার যদি কিছুটা বেশিও হয়, তার পরও এই ঋণ বাড়াতে হবে।’

দীর্ঘদিন আইএমএফের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করে আসা আহসান মনসুর বলেন, ‘ডলারের অস্থির বাজারই আসলে আমাদের অর্থনীতির সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে। রাশিয়া যুদ্ধের এক বছরে টাকার ২৫ শতাংশ দরপতন হয়েছে। ৮৬ টাকার ডলার ১০৭ টাকায় উঠেছে। এক লাফে টাকার এই বড় অবমূল্যায়ন ধারণ করার মতো ক্ষমতা আমাদের অর্থনীতির ছিল না। আমরা সবচেয়ে বড় যে ভুলটা করেছিলাম, সেটা হলো দুই বছরের বেশি সময় আমরা টাকা-ডলারের বিনিময় হার ৮৪ টাকায় আটকে রেখেছিলাম। সেটা না করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো ধীরে ধীরে যদি আমরা আমাদের টাকার অবমূল্যায়ন করতাম, তাহলে এত বড় ধাক্কা লাগত না।’

ডলার
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close