• রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

কমেছে প্রবৃদ্ধি বেড়েছে মূল্যস্ফীতি

প্রকাশ:  ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১১:০৪
নিজস্ব প্রতিবেদক

দেশদ প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে মূল্যস্ফীতির পরিমাণ। তাই চলমান এই উচ্চ মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে নীতি সুদহার বাড়ানোসহ নানা উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি সুদহার বাড়ানোর সুফল হিসেবে গত নভেম্বর-ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতি আগের মাসগুলোর তুলনায় কিছুটা কমেছিল। তবে অন্যান্য সময়ে মূল্যস্ফীতি কমানোর চেষ্টাও ব্যর্থ হয়েছে। ওই দুই মাসে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমলেও ফের বেড়েছে জানুয়ারিতে।

এদিকে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে সরকারের মোট দেশজ উৎপাদন তথা জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৫ শতাংশের মধ্যে রাখার লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও বছর শেষে তা দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৭৮ শতাংশে। দেশের কৃষিতে উৎপাদন বাড়লেও শিল্প ও সেবা খাতে উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে জিডিপি প্রবৃদ্ধি। একই সঙ্গে প্রান্তিকের হিসাবেও অনেকটা কমেছে প্রবৃদ্ধি।

অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, করোনার ধকল কাটিয়ে উঠতে পারেনি বাংলাদেশ। টানা উচ্চ মূল্যস্ফীতি, রপ্তানি কমে যাওয়া, দেশের শিল্প ও সেবা খাতের সবচেয়ে উৎপাদন ও কার্যক্রম কমে যাওয়ায় এর প্রভাব পড়েছে জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে।

সিপিডির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান কালবেলাকে বলেন, বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা, আমদানি এবং শিল্পের উৎপাদন কমে যাওয়ার কারণে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। পাশাপাশি বৈদেশিক এবং ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় শিল্পের উৎপাদন কমে গেছে। সার্বিকভাবে সামিষ্টিক অর্থনীতির পরিস্থিতিতে যে অস্থিতিশীলতা আছে সেটার কারণে মূল্যস্ফীতি এবং প্রবৃদ্ধির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে এটাই স্বাভাবিক।

তিনি বলেন, প্রবৃদ্ধির থেকে এখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। এ ক্ষেত্রে যে সমন্বয় দরকার হবে সেটা করতে হবে। সামনের দিনে প্রবৃদ্ধিটা বাড়াতে হলে অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা এবং প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসনটা দরকার। এখানে স্থিতিশীলতা আসলে বিনিয়োগ বাড়বে, সাথে সাথে প্রবৃদ্ধিও বাড়বে।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আমরা এখনও সফল হয়নি উল্লেথ করে তিনি বলে, বৈদেশিক মুদ্রা এবং সুদের হার এখনও বাজারভিত্তিক করা হয়নি। এটাকে বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হবে।

গতকাল বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) চলতি বছরের জানুয়ারির ভোক্তা মূল্যসূচকের (সিপিআই) হালনাগাদ প্রতিবেদন এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরের পূর্ণাঙ্গ এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকের (জুলাই-সেপ্টেম্বর) জিডিপি তথ্য প্রকাশ করেছে। সে তথ্য পর্যালোচনা করে জিডিপি এবং মূল্যস্ফীতির এ তথ্য পাওয়া গেছে।

বিবিএসের মূল্যস্ফীতির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত দুই মাস মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমলেও ফের বেড়েছে জানুয়ারিতে। এ মাসে মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশে। যা ডিসেম্বরে ছিল ৯ দশমিক ৪১ শতাংশ। মাসের ব্যবধানে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে শূন্য দশমিক ৪৫ শতাংশ।

খাদ্য বহির্ভূত পণ্যেও মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। কয়েক মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমলেও বেড়েছে খাদ্য বহির্ভূত মূল্যস্ফীতি। ডিসেম্বরে খাদ্য বহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ৫২ শতাংশ, জানুয়ারিতে তা বেড়ে ৯ দশমিক ৪২ শতাংশে উঠেছে। তবে খাদ্য মূল্যস্ফীতি সামান্য কমে ৯ দশমিক ৫৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

বিবিএসের তথ্যে দেখা যায়, এবার গ্রামের চেয়ে শহরে মূল্যস্ফীতি বেশি হয়েছে। জানুয়ারিতে শহর এলাকায় মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৯৯ শতাংশে, ডিসেম্বরে যা ছিল ৯ দশমিক ১৫ শতাংশ। শহরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৯৮ শতাংশ এবং খাদ্য বহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৪৩ শতাংশ।

এদিকে গ্রামে জানুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৭০ শতাংশে, ডিসেম্বরে যা ছিল ৯ দশমিক ৪৯ শতাংশ। গ্রামে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমে ৯ দশমিক ৪১ শতাংশে নেমেছে যা ডিসেম্বরে ছিল ৯ দশমিক ৬৬ শতাংশ। খাদ্য বহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ১৯ শতাংশ হয়েছে, যা ডিসেম্বরে ছিল ৮ দশমিক ৪১ শতাংশ।

দেশের মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের মধ্যে আনার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে সরকারের। তবে কোনোভাবেই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছে না। দেশের বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা, সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা এবং শিল্প উৎপাদন কমে যাওয়াকে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে দেখছেন অর্থনীতিবিদরা।

কমেছে জিডিপি প্রবৃদ্ধি: মূল্যস্ফীতি বাড়ার সাথে সাথেই কমতে শুরু করেছে দেশের প্রবৃদ্ধি। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সরকারের মোট দেশজ উৎপাদন তথা জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৫ শতাংশের মধ্যে রাখার লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও বছর শেষে তা এসে দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৭৮ শতাংশে।

বিবিএসের প্রকাশিত জিডিপির হিসাবে দেখা যায়, দেশের কৃষিতে উৎপাদন বাড়লেও শিল্প এবং সেবা খাতে উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে কৃষিতে জিডিপির প্রবৃদ্ধি বেড়ে হয়েছে ৩ দশমিক ৩৭ শতাংশ, যেটি আগের অর্থবছর অর্থাৎ ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ৩ দশমিক ০৫ শতাংশ।

কৃষিতে প্রবৃদ্ধি বাড়লেও হতাশার চিত্র দেখা যায় শিল্প এবং সেবায়। শিল্প খাতে গত অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি কমে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ, আগের বছরে ছিল ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশ। সেবা খাতেও প্রবৃদ্ধি কমে দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৩৭ শতাংশে, যেটি ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ৬ দশমিক ২৬ শতাংশ।

অর্থবছরের পাশাপাশি প্রান্তিকের হিসেবেও অনেকটাই কমেছে প্রবৃদ্ধি। ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকের থেকে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমেছে প্রায় আড়াই শতাংশ। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরের প্রথম প্রান্তিকে জিডিপি কমে দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশে। যেটি আগের বছরের একই প্রান্তিকে ছিল ৮ দশমিক ৭৬ শতাংশ।

অর্থনীতিতে চলমান চ্যালেঞ্জ বিবেচনায় ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস (জিডিপি) ৭ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ করা হয়। চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শেষে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পূর্বাভাস ইতিবাচক থাকবে বলে জানিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে নেতিবাচক ধরা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

অন্যদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস ৬ শতাংশ হবে বলে আভাস দিয়েছিল। আর বিশ্বব্যাংকও চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস কমিয়ে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ করেছে।

জিডিপির প্রান্তিক হিসাব প্রকাশের বিষয়ে বিবিএস বলেছে, সরকারের গত ২৬ নভেম্বর ২০২০ তারিখের সিদ্ধান্ত ও পরবর্তীতে আইএমএফের পরামর্শ মোতাবেক বিবিএসের ত্রৈমাসিক স্থুল দেশজ উৎপাদন প্রাক্কলনের কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বিবিএসও উৎপাদন পদ্ধতিতে কিউজিডিপি প্রাক্কলন করছে। তবে, বার্ষিক জিডিপি উৎপাদন এবং ব্যয় পদ্ধতিতে প্রাক্কলনও প্রকাশ করা হয়। ত্রৈমাসিক প্রাক্কলনের অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির হ্রাস বৃদ্ধির প্রবণতা পরিমাপ করা।

এদিকে, মাথাপিছু আয় ২০২১-২২ অর্থবছরের তুলনায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে টাকার অংকে বেড়েছে। বিবিএসের হিসেবে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে জনপ্রতি ২ লাখ ৭৩ হাজার ৩৬০ টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ২ লাখ ৪১ হাজার ৪৭ টাকা।

প্রবৃদ্ধি,মূল্যস্ফীতি,অর্থনীতি,বাংলাদেশ ব্যাংক
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close