চকবাজার অগ্নিকাণ্ড,পানির ট্যাংকে আলমগীরের রুদ্ধশ্বাস দুই ঘণ্টা
পুরান ঢাকার চকবাজারে চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ডে মারা গেছেন অন্তত ৬৭জন সরকারি হিসেবে ১১ জনের নিখোঁজের তথ্য দেয়া হলেও রেড ক্রিসেন্ট কর্মীরা জানিয়েছেন, তাদের হিসেবে এখনও ৬২ জনের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। এখনও হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন অনেকেই । সেই দুঃসহ ঘটনার কথা বলছিলেন ষাটোর্ধ্ব মো. আলমগীর হোসেন।
বুধবার (২১ ফেব্রুয়ারি)রাত ৮টার দিকে বন্ধ হয়ে যায় বেশির ভাগ দোকান। এরপর হাতে কিছু কাজ ছিল।
সম্পর্কিত খবর
শেষ করতে দেরি হয়ে যায়। তখন সাড়ে ১০টা। হঠাৎ আগুন দেখে ভয় পেয়ে যাই। কী করব হিতাহিত জ্ঞান হারাই। দোকানের সামনের পানের খাঁচিটা সরানোর পরই আর টিকতে পারছিলাম না। এমন সময় মনে পড়ে, আমার দোকানের নিচে পানির ট্যাংকি আছে। একপর্যায়ে ঢাকনাটা খুলে সেখানে লুকিয়ে পড়ি। এরপর এই পানির ট্যাংকির ভেতরেই দুই ঘণ্টা থাইক্যা জীবন বাঁচাইছি। এতে নিজের জীবন বাঁচলেও ঘটনার পর তাঁর ছেলে পারভেজের কোনো খোঁজ পাননি তিনি।
বৃহস্পতিবার দুপুরে পুরান ঢাকার চকবাজারের চুরিহাট্টা শাহি মসজিদের সামনে নিজের পান-সিগারেটের দোকানে বসে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে সেই দুঃসহ ঘটনার কথা বলেন মো. আলমগীর হোসেন।
ভেজা চোখে তিনি বলেন, ২৫ বছর ধরে এখানে ব্যবসা করছি। কখনো এত বিপদে পড়িনি। এত বড় আগুনও কখনো দেখিনি। পানির ট্যাংকির মধ্যে দুই ঘণ্টা থাকাটাও একপর্যায়ে তাঁর জন্য কঠিন হয়ে পড়েছিল। ওই সময় ঢাকনা তুলে বারবার মাথা উঁচু করে দোয়া-দরুদ পড়ছিলাম। আগুন দেখছিলাম আর মাবুদ আল্লাকে ডাকছিলাম। এই করতে করতে একসময় আর পারছিলাম না। ট্যাংকির পানিও খাইছি। এরপর আগুন কিছুটা কমলে কোনোমতো প্রাণডা নিয়া বাইর হই। পরে ফায়ার সার্ভিসের মাধ্যমে রক্ষা পাই।
এই বলে কিছুক্ষণ থামলেন এই ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। এরপর ছেলের কথা জানতে চাইলে চোখ ভিজে যায় আলমগীর হোসেনের। তিনি বলেন, পোলাডারে এহনও পাই নাই। বাঁইচা আছে, না মরে গেছে তাও বুঝতে পারতাছি না। তয় খোদা যেন ওরে আমার কাছে ফিরাইয়া দেয়।
আলমগীর হোসেনের তিন ছেলে। এর মধ্যে বড় ছেলের নাম পারভেজ।সে শারীরিক প্রতিবন্ধী জানিয়ে আলমগীর বলেন, পোলাডা আমার সঙ্গেই দোকানে থাকত। আগুন লাগার কিছুক্ষণ আগে বাসায় যাওয়ার কথা বলে আর ফেরেনি। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেও খুঁইজা পাই নাই। এহন কেউ যদি পোলাডার খোঁজ দিত। কত মানুষ যে মরছে। পানির ট্যাংকির থাইকা বাইর হইয়া দেহি কত লাশ পুইড়া পড়ে আছে রাস্তায়। এরপর ভোর হতে হতে আরো কত লাশ। কাউকে চেনা যায়নি। পুইড়া কয়লা হইয়া গেছে। তহন নিজের পোলারে খুঁজছি। তয় পাই নাই।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে আলমগীর বলেন, আগুন লাগার পরপরই মানুষের কান্না-চিৎকার হুনতাছিলাম। বাঁচাও বাঁচাও বলে তারা চিৎকার করছিল। তখনো ফায়ার সার্ভিস আসেনি। বিকট শব্দে প্লাস্টিক ফোটার শব্দ শুনে মনে হচ্ছিল রোজ কিয়ামত নাইমা আইছে।
দোকানে পান-সিগারেটের পাশাপাশি আরো বিভিন্ন ধরনের জিনিস বিক্রির কথা জানিয়ে আলমগীর বলেন, এ এলাকায় অনেক প্লাস্টিকের কারখানা আছে। সেই সঙ্গে কেমিক্যালও আছে। একটার সঙ্গে আরেকটি হোটেল। সেখানেও গ্যাসের সিলিন্ডার। এরপর গত রাতে (বুধবার) এই হানে (ঘটনাস্থল) এত জ্যাম (যানজট) ছিল যে, মানুষ এমনিতে আটকে ছিল। এরপর যহন আগুন ধরে তহন তো মানুষ বাইর হতে পারে নাই। আগুন নিচের কোনো জায়গায় লাগছিল বলে মনে হয়। সবাই এই কথাই বলাবলি করতাছে। আমারও তাই মনে হইতাছে। তানালে নিচের মানুষ এত মরল কেমনে।
পিবিডি/জিএম