• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

কেউ স্বেচ্ছায় প্রতিবন্ধী হয়ে জন্মগ্রহণ করে না

প্রকাশ:  ১৮ মার্চ ২০১৯, ২১:৩১ | আপডেট : ১৮ মার্চ ২০১৯, ২১:৩৯
খুজিস্তা নূর-ই–নাহারিন (মুন্নি)

এক মাসের বেশি সময় হচ্ছে পা’ ভেঙ্গে বিছানায় পড়ে আছি। এই একমাস সময় যেন একযুগেরও বেশি, ফুরাতে চায় না কিছুতেই। পত্রিকার পর পত্রিকা পড়ছি, টেলিভিশন দেখছি, ইন্টারনেট দুনিয়ায় ঘুরাঘুরি করছি কিন্তু তবুও দিন কাটে না।

আমেরিকায় থাকা পরিচিত এক ভাবী এলো আমায় দেখতে, ভাবী বলল, ‍‍‘আমারও পা ভেঙ্গেছিল, তবে আমি ঘরে বসে না থেকে পুরো আমেরিকা চষে বেড়িয়েছি।’ আমি মনে মনে ভাবলাম কি ভাবে ! পা’ ভাঙ্গার ৭ দিনের মাথায় হুইল চেয়ার কিনেছি বাইরে বের হব বলে কিন্তু একদিনও সম্ভব হয়নি তা।

সম্পর্কিত খবর

    ৯০ দশকের মাঝামাঝিতে প্রথম যখন ইউরোপে যাই, যা আমায় বিস্মিত করলো তা হল পার্ক, খেলার মাঠ, মার্কেট, ট্রেন, বাস যেখানেই যাই প্রেমএ চড়া শিশু আর হুইল চেয়ারে বসা বৃদ্ধ-বৃদ্ধা যা একসাথে বাংলাদেশে চোখে পরা অসম্ভব।

    আমি হুইল চেয়ার কিনলাম, কারণ হুইল চেয়ারে করে আমার বাসা থেকে বাইরে বের হওয়া সহজ, কিন্তু আমার অফিস, মার্কেট কিম্বা অন্য আরও কাজের জায়গায় কোথাও রেম্প অর্থাৎ হুইল চেয়ার উঠতে পারে এমন সুবিধা নেই। আমার অফিসে যে ওয়াসরুম আছে তাও একটু উঁচু যা কিনা হুইল চেয়ার ফ্রেন্ডলি না। অফিসের ইন্টেরিওর ডিজাইন করেছে একজন ইঞ্জিনিয়ার, আর আমি মাথাই ঘামাইনি কারণ কোনদিন সমস্যায় পড়তে পারি এই চিন্তাটা মাথায়ই ছিল না। পা’ বাদ দিয়ে আমি সম্পূর্ণ সুস্থ একজন মানুষ অথচ কাজ করতে পারছি না। আমার এই অপারগতার সুযোগ নিয়ে সুযোগসন্ধানীরা আমায় ঠকিয়ে যাচ্ছে ইচ্ছেমতন, কারণ আমার চলাচল সীমাবদ্ধ। ঘরে বসে থাকতে থাকতে অবসাদগ্রস্থ হয়ে পরছে মন। কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হয় না, সুন্দর একটা কাপড় পরার সাধ জাগে না, ছোট ছোট চুল তবুও চিরুনি দেওয়ার ইচ্ছেটা যেন মরে গেছে, কেবল মাত্র খাওয়া আর ঘুম। কিন্তু প্লাস্টারের জন্য পা’ অনেকটা ভারি হওয়ায় ঘুম ভেঙ্গে যায় বারবার। সবসময়ই রাতের ঘুমটুকু আমার কাছে ভীষণ দামি, এইজন্য যথা সম্ভব চেষ্টা করি দিনের সবটুকু সময় সজাগ থাকতে।

    ছোটবোনসম ‘বিস্ক্যান’ এর সাবরিনা, সালমা, ওদের মত অসংখ্য ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জড মানুষদের কথা ভাবি। যারা জন্ম থেকেই প্রতিবন্ধী তাঁদের কথা ভাবি, ক্র্যাচে হাঁটার কষ্টটা বুঝতে পারি।কিন্তু কিভাবে ওদের জীবন এগুবে ! স্কুলে রেম্প নেই, বাসে বা ট্রেনে চড়াও সম্ভব নয়, ওদের ব্যাবহার উপযোগী ওয়াসরুমও নেই । কিভাবে উন্নত হচ্ছে বাংলাদেশ ! ওদেরকে ফেলে রেখে ! অথচ মুক্ত স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে প্রতিটি মানুষের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মক্ষেত্র এবং উপযুক্ত বাসস্থানের অধিকার আছে।

    কাছে থেকে দেখেছি, ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জড অনেকের মধ্যে গান গাওয়া, ছবি আঁকা সহ বুদ্ধি বৃত্তিক অনেক মেধা আছে কিন্তু চলাচলের বাঁধাগ্রস্থতায় অঙ্কুরেই বিনষ্ট হচ্ছে। ওদের ভবিষ্যতের চিন্তায় কেবল ওরা একা নিজেরা নয়, পুরো পরিবারটি যারপর নাই কষ্টের ভেতর দিনযাপন করছে।

    অথচ বিদেশে যখন কেউ ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জড হয় রাষ্ট্র স্বয়ং এই দায়ভার গ্রহণ করে। কারণ কেউ স্বেচ্ছায় প্রতিবন্ধী হয়ে জন্ম গ্রহণ করে না এটা কেবলই ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, কিংবা হতে পারে সৃষ্টির পেছনে লুকিয়ে থাকা অজানা কোন রহস্য । বিজ্ঞান বলে, বাবা-মায়ের বহন করা জিনগত সমস্যার কারণে সন্তানের এই কষ্ট । এই জন্য উন্নত সব দেশে বিয়ের আগে এমন কি সন্তান ধারণের আগে রক্ত পরীক্ষা করা বাধ্যতামূলক । কিন্তু আমাদের দেশে অসচেতনতায়, অনেক ক্ষেত্রে বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়ার ভয়ে চরম এই সত্যটি লুকায়িতই রয়ে যায়।

    অন্যভাবে ‘শারীরিক সামর্থ্য সম্পন্ন’মানুষেরও মানসিক এবং শারীরিক চাহিদা আছে যা সবসময় প্রায় সবক্ষেত্রে অবহেলিত এবং উপেক্ষিতই রয়ে যায়।

    আমেরিকার ভাবীর কথা বলছিলাম, আমিরিকা-ইউরোপের প্রতিটি ক্ষেত্র সবার কথা মাথায় রেখেই রাস্তাঘাট, শপিং মল, ট্রেন, বাস স্কুল, কলেজ,অফিস, বসত বাড়ি সবকিছু ডিজাইন করা হয়। যার কারণে ‘ডিফারেন্টলি এইবল’ অর্থাৎ ‘অন্য ভাবে সক্ষম’ ব্যক্তিকে অতোখানি প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয় না। তাছাড়াও প্রতিটি ব্যক্তিকে কর্মের উপযুক্ত করে গড়ে তুলে তাঁকে মূল ধারায় সম্পৃক্ত করার দায়িত্বও রাষ্ট্রের।

    রাষ্ট্রীয় সাপোর্ট বা অনুকূলতার পাশাপাশি এদেরকে পুণর্বাসণ করার জন্য সবচেয়ে আগে প্রয়োজন মানসিকতা তথা দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। সমাজের একটি অংশকে বাদ দিয়ে দেশের সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। ২০২৪ সালের মধ্যে আমাদের দেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে পদার্পণ করতে যাচ্ছে অল্প কয়েক বছর ব্যবধানে হয়তোবা উন্নত দেশের কাতারে যেয়ে দাঁড়াবে, কিন্তু সামাজিক উন্নয়ন সাধিত না হলে উন্নত দেশ হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো সম্ভব নয় কিছুতেই।

    এনই

    খুজিস্তা নূর-ই–নাহারিন (মুন্নি)
    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close