• শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

একজীবনে আবদুল গাফফার চৌধুরী

প্রকাশ:  ১৯ মে ২০২২, ১৬:৩১ | আপডেট : ১৯ মে ২০২২, ১৬:৪৪
নিজস্ব প্রতিবেদক

‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানের রচয়িতা বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিস্ট আবদুল গাফফার চৌধুরী মারা গেছেন। রেখে গেছেন তার কর্মমুখর জীবনের নানা কীর্তি।

বৃহস্পতিবার (১৯ মে) আনুমানিক সকাল ৭টায় যুক্তরাজ্যের লন্ডনে বার্নেট হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। আবদুল গাফফার চৌধুরী বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় ভুগছিলেন।

যুক্তরাজ্যপ্রবাসী স্বনামধন্য এ সাংবাদিক স্বাধীনতা যুদ্ধে মুজিবনগর সরকারের মাধ্যমে নিবন্ধিত স্বাধীন বাংলার প্রথম পত্রিকা সাপ্তাহিক জয় বাংলার প্রতিষ্ঠাতা নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন। এক বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী ছিলেন তিনি। যুক্তরাজ্যপ্রবাসী স্বনামধন্য এ ব্যক্তিত্ব বাংলাদেশের ইতিহাসের নানা বাঁক বদলের সাক্ষী। তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধে মুজিবনগর সরকারের মাধ্যমে নিবন্ধিত স্বাধীন বাংলার প্রথম পত্রিকা সাপ্তাহিক জয় বাংলার প্রতিষ্ঠাতা নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন। ভাষা আন্দোলনের স্মরণীয় গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’র রচয়িতা হিসেবে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী বাঙালির হৃদয়ে চিরদিন বেঁচে থাকবেন।

১৯৩৪ সালের ১২ ডিসেম্বর বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার উলানিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন আবদুল গাফফার চৌধুরী। তার বাবা হাজি ওয়াহিদ রেজা চৌধুরী ও মা মোসাম্মৎ জহুরা খাতুন। তিন ভাই, পাঁচ বোনের মধ্যে বড় ভাই হোসেন রেজা চৌধুরী ও ছোট ভাই আলী রেজা চৌধুরী। বোনেরা হলেন মানিক বিবি, লাইলী খাতুন, সালেহা খাতুন, ফজিলা বেগম ও মাসুমা বেগম।

আবদুল গাফফার চৌধুরী উলানিয়া জুনিয়র মাদরাসায় ক্লাস সিক্স পর্যন্ত লেখাপড়া করে হাইস্কুলে ভর্তি হন। ১৯৫০ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। ১৯৫৩ সালে তিনি ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৮ সালে বিএ অনার্স পাস করেন।

১৯৪৬ সালে তার পিতার মৃত্যুর পর তাকে চলে আসতে হয় বরিশাল শহরে। ভর্তি হন আসমত আলী খান ইনস্টিটিউটে। সেসময়ে আর্থিক অনটনের শিকার হয়ে উপার্জনের পথ খুঁজতে থাকেন। ১৯৪৭ সালে তিনি কংগ্রেস নেতা দুর্গা মোহন সেন সম্পাদিত 'কংগ্রেস হিতৈষী' পত্রিকায় কাজ শুরু করেন। বরিশাল শহরে তিনি কিছুদিন একটি মার্কসবাদী দল আরএসপি'র সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ছাত্র জীবনেই তার সাহিত্য চর্চা শুরু হয়। ১৯৪৯ সালে সওগাত পত্রিকায় তার প্রথম গল্প ছাপা হয়। বরিশালের সন্তান শামসুদ্দীন আবুল কালামের লেখা তখন কলকাতার প্রধান পত্রিকাগুলোতে ছাপা হতো।

আব্দুল গাফফার চৌধুরীর কর্মজীবন পরিপূর্ণভাবে শুরু হয় ১৯৫০ সালে। এ সময় তিনি 'দৈনিক ইনসাফ' পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। তখন বেতন পেতেন ৭০ টাকা। মহিউদ্দিন আহমদ ও কাজী আফসার উদ্দিন আহমদ তখন দৈনিক ইনসাফ পরিচালনা করতেন।

১৯৫১ সালে 'দৈনিক সংবাদ' প্রকাশ হলে গাফফার চৌধুরী সেখানে অনুবাদকের কাজ নেন। জুনিয়র ট্রান্সলেটর হিসেবে মাসিক বেতন পেতেন ১শ' টাকা। এরপর তিনি বহু পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৫৩ সালে মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের 'মাসিক সওগাত' পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হন গাফফার চৌধুরী। এসময় তিনি 'মাসিক নকীব'ও সম্পাদনা করেন। একই বছর তিনি আবদুল কাদির সম্পাদিত 'দিলরুবা' পত্রিকারও ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হন।

১৯৫৬ সালে দৈনিক ইত্তেফাকের সহকারী সম্পাদক নিযুক্ত হন। ওই বছরই তিনি প্যারামাউন্ট প্রেসের সাহিত্য পত্রিকা 'মেঘনা'র সম্পাদক হন। ১৯৫৮ সালে আবদুল গাফফার চৌধুরী দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার রাজনৈতিক পত্রিকা 'চাবুকের সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পান। কিন্তু কিছুদিন পর সামরিক শাসন চালু হলে সেটা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর তিনি মওলানা আকরম খাঁ'র 'দৈনিক আজাদ'-এ সহকারী সম্পাদক পদে যোগ দেন। এ সময়ে তিনি মাসিক 'মোহাম্মদীর'ও স্বল্পকালীন সম্পাদক হয়েছিলেন।

১৯৬২ সালে তিনি দৈনিক 'জেহাদ'-এ বার্তা সম্পাদক পদে যোগ দেন। ১৯৬৩ সালে তিনি সাপ্তাহিক 'সোনার বাংলা'র সম্পাদক হন। পরের বছর ১৯৬৪ সালে সাংবাদিকতা ছেড়ে দিয়ে ব্যবসায় নামেন এবং অণুপম মুদ্রণ' নামে একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। দু'বছর পরই আবার ফিরে আসেন সাংবাদিকতায়। ১৯৬৬ সালে ৬ দফা আন্দোলনের মুখপত্র হিসেবে 'দৈনিক আওয়াজ' বের করেন। সেটি বছর দুয়েক চলেছিল। ১৯৬৭ সালে আবার তিনি 'দৈনিক আজাদ'-এ ফিরে যান সহকারী সম্পাদক হিসেবে। ১৯৬৯ সালে পত্রিকাটির মালিকানা নিয়ে সহিংস বিবাদ শুরু হলে তিনি আবার যোগ দেন দৈনিক ইত্তেফাকে'।

১৯৬৯ সালের পয়লা জানুয়ারি ইত্তেফাক সম্পাদক মানিক মিয়া মারা গেলে তিনি আগস্ট মাসে হামিদুল হক চৌধুরীর অবজারভার গ্রুপের দৈনিক 'পূর্বদেশ'-এ যোগ দেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে সপরিবারে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আগরতলা হয়ে কলকাতা পৌঁছান। সেখানে মুজিবনগর সরকারের মুখপত্র 'সাপ্তাহিক 'জয়বাংলা'য় লেখালেখি করেন। এ সময় তিনি কলকাতায় 'দৈনিক আনন্দবাজার' ও 'যুগান্তর' পত্রিকায় কলামিস্ট হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর 'দৈনিক জনপদ' বের করেন। ১৯৭৩ সালে তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলজিয়ার্সে ৭২ জাতি জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে যান। দেশে ফেরার পর তার স্ত্রী গুরুতর রোগে আক্রান্ত হলে তাকে চিকিৎসার জন্য প্রথমে কলকাতা নিয়ে যান। সেখানে সুস্থ না হওয়ায় তাকে নিয়ে ১৯৭৪ সালের অক্টোবর মাসে লন্ডনের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান। এরপর তার প্রবাস জীবনের ইতিহাস শুরু হয়।

যুক্তরাজ্য যাওয়ার পর প্রথম দিকে তিনি বিভিন্ন গ্রোসারি দোকানে কাজ করেন। এরপর ১৯৭৬ সালে তিনি 'বাংলার ডাক' নামে এক সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদনা করেন। 'সাপ্তাহিক জাগরণ' পত্রিকায়ও তিনি কিছুদিন কাজ করেছেন। ১৯৮৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি সাতজন অংশীদার নিয়ে 'নতুন দিন' পত্রিকা বের করেন। এরপর ১৯৯০ সালে 'নতুন দেশ' এবং ১৯৯১ সালে 'পূর্বদেশ' বের করেন। প্রবাসে বসে গাফফার চৌধুরী বাংলাদেশের প্রধান পত্রিকাগুলোতে নিয়মিত লিখতেন। বাংলাদেশের শীর্ষ দৈনিকগুলোতে প্রকাশিত আবদুল গাফফার চৌধুরীর রাজনীতি, সমসাময়িক ঘটনা ও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী নিয়ে লেখা কলাম অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলো।

পূর্বপশ্চিম- এনই

আবদুল গাফফার চৌধুরী
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close