• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

পোড়া শুঁটকির ঘ্রাণ: মোহাম্মাদ জাকারিয়ার ছোটগল্প

প্রকাশ:  ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১৮:৩৪ | আপডেট : ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১৮:৪৫
মোহাম্মাদ জাকারিয়া
মোহাম্মাদ জাকারিয়া।

জোনাকি রোড, হ্যাঁ, এ এলাকার নাম জোনাকি রোড। কবে, কখন, কে—এই নাম রেখেছিল তা জানতে পারা যায় না। কী ভেবেই বা এই রোডের নাম জোনাকি রোড রাখা হয়েছিল— তা অমিমাংসিত ব্যাপার। হতেও পারে দূর অতীতে এই এলাকা গ্রাম ছিল; কলাগাছ ছিল; পথের দু'ধারে কলাগাছের পাতা দিয়ে ঘেরা দেওয়া মলুয়া বিবির ঘরখানা ছিল। সন্ধ্যা হলে আমবাগানে হাজার হাজার জোনাকি পোকা জ্বলত আর নিভত। হতেও পারে। আমরা ধারণা করতেই পারি। আমরা এও ধারণা করতে পারি যে, শাক-লতা ভাজতে গিয়ে গরম কড়াইয়ের উপর মলুয়া বিবি কাঁচের বোতল উপুড় করে ভেজাল তেল দেওয়ার ফলে ছ্যাঁত করে একটা শব্দ হত। ইলিশ মাছ হাতে নিয়ে পাশের এলাকার কোন পথিক যেতে যেতে এই শব্দ শুনত।

এখন আর গাছ নেই। মাটির রাস্তা নেই।

সম্পর্কিত খবর

কলাগাছের পাতা দিয়ে ঘেরা মলুয়া বিবির গোসল খানা নেই। কেবলই বিল্ডিং আর বিল্ডিং, উঁচু কিংবা নিচু। বৈদ্যুতিক বাতি আছে। রাস্তার মোড়ে। প্যাঁচানো তার। সন্ধ্যা হলেই জ্বলে ওঠে। আলোকিত হয় জোনাকি রোড।

পঞ্চাশের বেশি বয়সী আব্দুল মজিদ এ এলাকায় তা প্রায় বছর বিশেক ধরেই আছে। বউ বাচ্চা নিয়ে থাকে। সকাল বেলা যখন বগলের নিচে অফিসের ব্যাগটা চাপিয়ে বের হয় তখন জোনাকি রোডের চা-দোকানকার শুক্কুর আলী আব্দুল মজিদকে ডাক দেয়। ইন্টারমিডিয়েট পড়ুয়া নুরুন্নাহার দেরি হচ্ছে দেখে ভেজা চুলে এক প্রকার দৌড়াতে দৌড়াতে কলেজের দিকে চলে যায়। রঞ্জু ভুরুম ভুরুম আওয়াজ করে, ধুলোবালি তুলে মোটর বাইক চালিয়ে যায়। আব্দুল মজিদ কাছে যেতেই শুক্কুর আলী বলে, ভাই সাব কী সেন্ট মারছেন গায়ে, এলাকাতো গেরানে ভইরা গেছে।

আব্দুল মজিদ হাসে। চা খায়। শেষে, গোলাপি জর্দা দিয়ে পান মুখে দিয়ে পানের বোটার আগার চুন মুখে পুরে বলে, জর্দার গিরান ভালো না হইলে চলে না।

শুক্কুর আলী বলে, হ। পান খাওয়া লোকের গায়ে কুনু দুর্গন্ধ অয় না।

আব্দুল মজিদ শুক্কুর আলীকে বলে, তুমি জানো তাইলে? আমার দাদী, বুঝলা শুক্কুরালী, পান খাইতো, হের গায়ে কোন দিন দুর্গন্ধ পাই নাই। হে তো আর গায়ে সেন্ট মারতো না, বাসনাওয়ালা সাবান দিয়া গোসলও করতো না। তাইলে ক্যামনে কী? পরে ভাইবা দেইখলাম, পান খাওয়ার জন্য-ই হের গায়ে দুর্গন্ধ অয় না।

পান চিবুতে চিবুতে আব্দুল মজিদ হাঁটা ধরে। মনোহারি দোকান থেকে ছায়াছবির গান ভেসে আসে: জীবন ফুরিয়ে যাবে, ভালোবাসা ফুরাবে না জীবনে... শুক্কুর আলী গানের তালে তালে টুংটাং আওয়াজে চা বানাতে থাকে।

পরদিন সকালবেলা আব্দুল মজিদকে একই কায়দায় হেঁটে আসতে দেখা যায়। গলির মধ্যে সে বিরিয়ানির গন্ধ পায়। এই বিরিয়ানির গন্ধ কোন বিল্ডিং থেকে ভেসে আসে তা কেউ বুঝতে পারে না। আব্দুল মজিদও না। বিরিয়ানির কড়া গন্ধ পেয়ে রিকশা চালক ঘাড়ের উপর রাখা গামছা দিয়ে মুখ ঢাকে। বিরিয়ানির গন্ধ বোধ হয় তার পেটে সহ্য হয় না। আমরা এটা ধারণা করতেই পারি। ধারণা করা দোষের কিছু না।

আব্দুল মজিদ শুক্কুর আলীর চায়ের দোকানে গিয়ে বসে। শুক্কুর আলী কোন কথা বলছে না দেখে আব্দুল মজিদ বলে, কী মিয়া মনডা কি আজ বালা না?

শুক্কুর আলী বলে, সাত সকালে এমুন বিরানির গেরান পাইলে আমার মাতামুতা ঠিক থাহে না।

শুনে আব্দুল মজিদ হাসে। পান মুখে দিয়ে বিদায় নেয়। মনোহারি দোকান থেকে আজকে গান ভেসে আসে: হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস...

দুপুরবেলার চড়া রোদ খেলে যায় জোনাকি রোডে। জোনাকি রোডের কুকুরগুলো দেয়াল ঘেঁষে ছায়ায় শুয়ে হাপাতে থাকে। সন্ধ্যার আগে আব্দুল মজিদকে অফিস শেষে হেঁটে আসতে দেখা যায়। শুক্কুর আলীর চা-দোকানে বসে। চা খায়। পান মুখে দেওয়ার সময় হঠাৎ-ই বিদঘুটে একটা গন্ধ পায় আব্দুল মজিদ। শুক্কুর আলীও নাকে গন্ধটা পায়। ওয়াক করে মুখটা চেপে ধরে। কোন বাসা থেকে এমন বিশ্রী শুটকি পোড়া গন্ধ আসছে তা কেউ বুঝতে পারে না। শুক্কুর আলী জোরে চিল্লানি দিয়ে বলে, এই মাইয়ালোক! বেশি কইরা কড়াইয়ে ত্যাল দ্যাও। উঁহু! এমনে কেউ শুঁটকি ভাজে? অ্যাঁ? ব্যাক্কোল বেটিছাওয়ল জানি কোনহানকার!

আব্দুল মজিদ আজকে আর পানের রস গিলে খেতে পারে না। শুঁটকি পোড়ার গন্ধ নাকে লাগায়; নাড়ীভুরি উল্টিয়ে ওয়াক করে বমি করে দেয়। আব্দুল মজিদ মাটিতে গড়িয়ে পড়ে। জোনাকি রোডের সবাই নাক ধরে বসে থাকে। শুক্কুর আলী আব্দুল মজিদকে টেনে তুলতে গিয়ে ঘ্রাণ পায়। আব্দুল মজিদের শরীর থেকে গোলাপ ফুলের ঘ্রাণ ভেসে আসে।

(এই গল্পের সাথে নিমতলী কিংবা চকবাজারের অগ্নিকান্ডের কোন সম্পর্ক নেই)।

লেখক: চিত্রনির্মাতা ও সাহিত্যিক।

পিবিডি/ এইচ কে

মোহাম্মাদ জাকারিয়া,ছোটগল্প,পোড়া শুঁটকির ঘ্রাণ
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close