• বৃহস্পতিবার, ১৬ মে ২০২৪, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
  • ||

সড়ক দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান রাখে না বিআরটিএ

প্রকাশ:  ০৮ জানুয়ারি ২০২৩, ২১:০৬
নিউজ ডেস্ক

সড়ক ও মহাসড়কে প্রতিদিন ঘটছে কোনো না কোনো দুর্ঘটনা। বিভিন্ন সময়ে রেল ও নৌপথেও দুর্ঘটনার শিকার হন যাত্রীরা। এতে প্রাণহানির পাশাপাশি গুরুতর আহত কিংবা পঙ্গুত্বের শিকার হতে হচ্চে অনেককে। সেই সঙ্গে রয়েছে বড় ধরণের আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি। তবে প্রতিবছর দেশে সড়ক, রেল ও নৌপথে ঠিক কত সংখ্যক দুর্ঘটনা ঘটছে তার কোনো পরিসংখ্যান সরকারিভাবে প্রকাশ করা হয় না।

সরকারের কোনো মন্ত্রণালয়, বিভাগ বা সংস্থা থেকে এসব তথ্য সংগ্রহও করা হয় না। এমনকি সড়কে চলাচলকারী যানবাহনের সার্বিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষও (বিআরটিএ) রাখছে না সড়ক দুর্ঘটনার কোনো পরিসংখ্যান। শুধু প্রয়োজন হলে সরকারি অন্যান্য সংস্থা যেমন, পুলিশ এবং ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মতো প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে বিআরটিএ। অথচ সংস্থাটির রোড সেফটি উইং নামে আলাদা একটি বিভাগই রয়েছে।

বেসরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন সংগঠন অবশ্য শুধু সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে সড়ক দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান তৈরি করে থাকে। তবে সেখানেও রয়েছে বড় ধরণের হেরফের। ২০২৩ সালের শুরুতে তিনটি সংগঠনের প্রকাশিত পরিসংখ্যানের তুলনামূলক পর্যালোচনা করে এ ধরনের পার্থক্য দেখা যায়।

সরকারিভাবে সঠিক পরিসংখ্যান প্রকাশিত না হওয়া এবং ভিন্ন ভিন্ন সংস্থার ভিন্ন ভিন্ন তথ্য প্রকাশের কারণে ঘটছে নানা বিপত্তি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনুমোদিত সংস্থার কাছ থেকে সঠিক পরিসংখ্যান প্রকাশিত না হওয়ায়, সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা অন্যান্য প্রতিষ্ঠান এমনকি ব্যক্তি পর্যায়েও নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। সঠিক পরিসংখ্যান না থাকায় বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বিভিন্ন গবেষণা, দুর্ঘটনা প্রতিরোধ ও পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নে কাজ করা বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাকেও নানা প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হচ্ছে।

বেসরকারি তিন প্রতিষ্ঠানের ভিন্ন ভিন্ন তথ্য প্রকাশ

সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠন বার্ষিক পরিসংখ্যান প্রকাশ করে থাকে। এসব সংগঠনের মধ্যে নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা), যাত্রী কল্যাণ সমিতি (জেকেএস) এবং রোড সেফটি ফাউন্ডেশন (আরএসএফ) ২০২৩ সালের শুরুতে বিদায়ী বছর সংঘটিত সড়ক দুর্ঘটনার আলাদা আলাদা পরিসংখ্যান প্রকাশ করে।

নিসচার প্রতিবেদন

২০২২ সালে দেশে সড়ক, নৌ, রেল ও বিমানপথে সাত হাজার ২৪টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহত হয়েছে আট হাজার ১০৪ জন। আহত হয়েছে ৯ হাজার ৭৮৩ জন। নিহতদের মধ্যে পাঁচ হাজার ২৪২ জন পুরুষ এবং ৯৯২ জন নারী। ১১টি জাতীয় দৈনিক, ইলেকট্রনিক মিডিয়া, অনলাইন নিউজ পোর্টাল, শাখা সংগঠনের রিপোর্ট ইত্যাদির ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।

যাত্রী কল্যাণ সমিতি

২০২২ সালে ছয় হাজার ৭৪৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৯ হাজার ৯৫১ জন নিহত এবং ১২ হাজার ৩৫৬ জন আহত হয়েছে। একই সময়ে রেলপথে ৬০৬টি দুর্ঘটনায় ৫৫০ জন নিহত এবং ২০১ জন আহত হয়েছে। নৌপথে ২৬২টি দুর্ঘটনায় ৩৫৭ জন নিহত, ৩১৮ জন আহত এবং ৭৪৩ জন নিখোঁজ হয়েছে। সড়ক, রেল ও নৌপথে মোট সাত ৬১৭টি দুর্ঘটনায় ১০ হাজার ৮৫৮ জন নিহত এবং ১২ হাজার ৮৭৫ জন আহত হয়েছে। জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ের ৬০ টিরও বেশি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর যাচাই করে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশন

গতবছর সড়ক, নৌ ও রেলপথের ছয় হাজার ৮২৯টি দুর্ঘটনায় সাত হাজার ৭১৩ জন নিহত হয়েছেন। এই হিসাব অনুযায়ী, ২০২২ সালে প্রতিদিন শুধু সড়কেই গড়ে প্রাণ হারাচ্ছেন ২১ দশমিক ১৪ জন। একই বছর আহত হয়েছেন ১২ হাজার ৬১৫ জন। ৯টি জাতীয় দৈনিক, সাতটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।

দুর্ঘটনা

নিসচার হিসাবে ২০২২ সালে দেশে মোট দুর্ঘটনার সংখ্যা ছিল সাত হাজার ২৪টি। জেকেএসের হিসাবে সাত হাজার ৬১৭টি। আরএসএফ বলছে, এই সংখ্যা ছিল ছয় হাজার ৮২৯টি।

নিহতের সংখ্যা

নিসচার হিসাবে আট হাজার ১০৪ জন, জেকেএসের হিসাবে ১০ হাজার ৮৫৮ জন এবং আরএসএফের হিসাবে সাত হাজার ৭১৩ জন।

আহতের সংখ্যা

নিসচার হিসাবে ৯ হাজার ৭৮৩ জন, জেকেএসের হিসাবে ১২ হাজার ৮৭৫ জন, আরএসএফের হিসাবে ১২ হাজার ৬১৫ জন।

দৈনিক গড়

নিসচার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে দৈনিক গড়ে ১৯ দশমিক ২৪টি দুর্ঘটনা ঘটে। দিনে নিহত হয় গড়ে ২২ দশমিক ২ জন আর আহত হয় ২৬ দশমিক ৮ জন। জেকেএসের পরিসংখ্যান বলছে, দিনে গড়ে ২০ দশমিক ৮৭টি দুর্ঘটনা ঘটে। এতে ২৯ দশমিক ৭৫ জন নিহত এবং ৩৫ দশমিক ২৭ জন আহত হয়। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, দৈনিক গড়ে ১৮ দশমিক ৭১টি দুর্ঘটনা ঘটে। এতে ২১ দশমিক ১৩ জন নিহত এবং ৩৪ দশমিক ৫৬ জন আহত হয়। নিসচার তথ্য সংগ্রহের উৎস ছিল ১১টি, জেকেএসের প্রায় ৬০টি এবং রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের ১৬টি।

পরিসংখ্যান পর্যালোচনা

নিসচার প্রতিবেদনে উল্লেখিত মোট দুর্ঘটনার সংখ্যা যাত্রী কল্যাণ সমিতির প্রতিবেদনে উল্লিখিত সংখ্যার চেয়ে ৫৯৩টি কম এবং রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের (আরএসএফ) প্রতিবেদনে উল্লেখিত সংখ্যা থেকে ১৯৫টি বেশি। অন্যদিকে জেকেএসের উল্লিখিত মোট সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা আরএসএফের প্রতিবেদনের তুলনায় ৭৮৮টি বেশি।

নিসচা’র প্রতিবেদনে মোট নিহতের সংখ্যা জেকেএসের উল্লিখিত সংখ্যা থেকে দুই হাজার ৭৫৪ জন কম এবং আরএসএফের উল্লিখিত সংখ্যা থেকে ৩৯১ জন বেশি। অন্যদিকে জেকেএসের উল্লিখিত নিহতের সংখ্যা আরএসএফের প্রতিবেদনের চেয়ে তিন হাজার ১৪৫ জন বেশি।

প্রকাশিত পরিসংখ্যান প্রতিবেদনে মোট সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহত এবং ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেশি দেখিয়েছে যাত্রী কল্যাণ সমিতি। এ প্রসঙ্গে সংগঠনটির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘আমরা প্রায় ৬০টির অধিক জাতীয় ও আঞ্চলিক দৈনিক পত্রিকা এবং অনলাইন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত দুর্ঘটনার তথ্য সংগ্রহ করে বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকি। প্রতিটি তথ্য যথাযথভাবে যাচাই করা হয়। আমাদের প্রতিবেদন যে সড়ক দুর্ঘটনার প্রকৃত চিত্র প্রকাশ করেছে সেটাও দাবি করছি না। কারণ প্রকৃত চিত্র আরও অনেক বেশি। অনেক দুর্ঘটনার খবর প্রকাশিত হচ্ছে না।’

অন্যান্য সংগঠনের প্রকাশিত প্রতিবেদন সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘অন্যদের প্রতিবেদন ভুল, এমন দাবি করবো না। আমরা মূলত দেশের সড়ক ব্যবস্থার একটা চিত্র প্রকাশ করছি। এটা আনুমানিক চিত্রও বলতে পারেন।’

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের রোড সেফটি উইংয়ের পরিচালক শেখ মো. মাহবুব-ই-রাব্বানি বলেন, আমাদের কাছে সড়ক দুর্ঘটনার কোনো পরিসংখ্যান নেই। আমাদের সংস্থা এ বিষয়ে কাজ করে না। যখন প্রয়োজন হয় কিংবা আপনারা (সংবাদমাধ্যম) চাইলে আমরা পুলিশের কাছ থেকে সংগ্রহ করে দেই।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক এবং বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক ড. এম শামসুল হক।

তিনি বলেন, প্রতিটি সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য সংগ্রহ এবং তার পরিসংখ্যান তৈরি করে প্রকাশের দায়িত্ব পুলিশকে দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে বিআরটিএ এবং সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের রোড সেফটি নামের আলাদা উইং রয়েছে। অথচ সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত এই তিন সংস্থার কেউ সড়ক দুর্ঘটনার সঠিক তথ্য সংরক্ষণ করছে না। যখন কেউ এই তথ্য চাইছেন, তখন দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর দেওয়া অসত্য তথ্য প্রতিনিয়ত বলা হচ্ছে।

ড. এম শামসুল হক বলেন, এসব সংস্থা আসলে কারো কাছে দায়বদ্ধ বলে মনে হচ্ছে না। কারণ যার যে দায়িত্ব সে তো সেটা পালন করছে না। বাংলাদেশ সরকারকে ২০৩০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা অর্ধেকেরও নিচে নামিয়ে আনতে হবে। বিষয়টি মাথায় রেখে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো তাদের ইচ্ছামাফিক মিথ্যা প্রতিবেদন তৈরি করছে। অথচ প্রকৃত চিত্র ভিন্ন। সড়কে তুলনামূলক দুর্ঘটনা প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে। সড়ক দুর্ঘটনাকে সরকার যদি জাতীয় সমস্যা হিসেবে দেখতো তাহলে অবশ্যই এ বিষয়ে তারা কাজ করতো। আমি সেসব বেসরকারি সংস্থাকে সাধুবাদ জানাবো যে, তারা অন্তত সড়কের চিত্র কিছুটা হলেও দেখাতে পারছেন।

শামসুল হক বলেন, কোভিডকে চিকিৎসক বা স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টরা কখন মহামারি ঘোষণা করেছে? যখন তাদের কাছে আক্রান্তের সংখ্যা, আক্রান্তের ধরণ ও স্থান সম্পর্কে সঠিক তথ্য ছিল। যখন সঠিক পরিসংখ্যান থাকে তখন যেকোনো সমস্যা সমাধানের সঠিক উপায় ও পন্থা অনুসরণ করা সম্ভব। যেহেতু সড়ক দুর্ঘটনাকে সরকার জাতীয় সমস্যা হিসেবে মনেই করছে না, সেহেতু তারা এটির সঠিক পরিসংখ্যান রাখা এবং সেটি প্রকাশ করাকে দায়িত্ব মনে করছে না।’

দুর্ঘটনা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close