• সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

জাফরুল্লাহর বর্ণাঢ্য জীবন

ফিল্ড হাসপাতাল থেকে ওষুধ নীতি, স্বাস্থ্য থেকে রাজনীতি

প্রকাশ:  ১২ এপ্রিল ২০২৩, ১০:০০
নিজস্ব প্রতিবেদক

ছিলেন চিকিৎসক। কিন্তু চিকিৎসা-গবেষণা তো বটেই, প্রান্তিক মানুষের কাছে সুলভে কীভাবে চিকিৎসাব্যবস্থা পৌঁছে দেয়া যায়, কাজ করেছেন তা নিয়েও। একাত্তরের রণাঙ্গনে যেমন ছিলেন সক্রিয়, তেমনি যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে ভূমিকা রেখেছেন জাতীয় ওষুধ নীতি প্রণয়নে। সেখানেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না, জাতীয় ও রাজনৈতিক বিভিন্ন ইস্যুতেও ছিলেন সবসময় সরব। বার্ধক্য আর নানা শারীরিক জটিলতা নিয়েও জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত চেষ্টা করে গেছেন জাতীয় বিভিন্ন ইস্যুতে ভূমিকা।

তিনি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে যুদ্ধাহতদের জন্য ফিল্ড হাসপাতাল নির্মাণের উদ্যোক্তা। গণমুখী জাতীয় ওষুধ নীতির পক্ষে সম্মুখসারির যোদ্ধা। এরকম নানা অভিধায় অভিহিত করা যায় আজীবন দেশের জন্য নিবেদিত এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে, যিনি সদ্যই পাড়ি জমিয়েছেন না ফেরার দেশে।

কিডনির জটিলতায় ভুগছিলেন দীর্ঘ দিন ধরেই। নিয়মিত ডায়ালাইসিস করতে হতো। এর মধ্যেই হানা দেয় বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন জটিলতা। রাজধানীর ধানমন্ডিতে নিজের গড়ে তোলা গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালেই ভর্তি হতে হয়। চিকিৎসকরা জানাচ্ছিলেন, তার রক্তে প্রদাহ ছড়িয়ে পড়েছে। নিতে হয়েছে লাইফ সাপোর্টে। শেষ পর্যন্ত সেই লাইফ সাপোর্ট থেকে আর ফিরিয়ে আনা যায়নি ৮১ বছর বয়সী ডা. জাফরুল্লাহকে। চিকিৎসকদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে মঙ্গলবার রাত সোয়া ১১টায় না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন তিনি।

এক বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী জাফরুল্লাহ চৌধুরী। মা-বাবার ১০ সন্তানের মধ্যে সবার বড় ছিলেন। জন্ম ১৯৪১ সালের ২৭ ডিসেম্বর, চট্টগ্রামের রাউজানে। তবে বেড়ে ওঠা ঢাকায়। বকশীবাজার স্কুল থেকে মাধ্যমিক আর ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন ভর্তি হন ঢাকা মেডিকেল কলেজে। ১৯৬৪ সালে সেখান থেকে পাস করে এফআরসিএস পড়তে চলে যান ইংল্যান্ডে। রয়্যাল কলেজ অব সার্জনস থেকে জেনারেল ও ভাস্কুলার সার্জারিতে এফআরসিএস প্রাইমারি পরীক্ষাতে উত্তীর্ণও হন। কিন্তু চূড়ান্ত পর্ব আর শেষ করা হয়নি তার। কারণ ততদিনে যুদ্ধের দামামা শুরু হয়েছে দেশে। তাই পড়ালেখা শেষ না করেই যুদ্ধে যোগ দিতে ফিরে আসেন দেশে।

যুদ্ধক্ষেত্রে তখন যুদ্ধাহতদের চিকিৎসার সংকট ছিল বড় সমস্যা। ২ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ ও ভারতের জিবি হাসপাতালের প্রধান সার্জন ডা. রথিন দত্তের সহযোগিতায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ছাত্র সংসদের প্রথম সাধারণ সম্পাদক ডা. এম এ মবিনকে নিয়ে আগরতলার বিশ্রামগঞ্জে জাফরুল্লাহ চৌধুরী গড়ে তোলেন প্রথম ফিল্ড হাসপাতাল ‘বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল’। এর কমান্ডিং অফিসার ছিলেন ডা. সিতারা বেগম বীরপ্রতীক। প্রশিক্ষিত নার্স না থাকায় নারী স্বেচ্ছাসেবীদের প্রাথমিক চিকিৎসার প্রশিক্ষণ দেন ডা. জাফরুল্লাহ। সে হাসপাতালের দুই স্বেচ্ছাসেবী ছিলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল ও তার বোন সাঈদা কামাল। ৪৮০ শয্যার এই ফিল্ড হাসপাতাল মুক্তিযুদ্ধের সময় অসংখ্য মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলে দেশের সাধারণ মানুষের জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার সংগ্রাম শুরু করেন জাফরুল্লাহ। যুদ্ধকালীন ফিল্ড হাসপাতালটি প্রথমে কুমিল্লায় ও পরে রাজধানীর সাভারে স্থানান্তর করেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরামর্শে তার নাম দেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। এখানেই প্রাইমারি কেয়ার কনসেপ্ট পাইলট প্রকল্প আকারে বাস্তবায়ন করেন তিনি। তারই ভিত্তিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও জাতিসংঘ আলমাআতা কনফারেন্সের মাধ্যমে বৈশ্বিক সার্বজনীন প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রকল্পের ঘোষণা দেয়। মিনি ল্যাপারোটমির মাধ্যমে লাইগেশন সার্জারির উদ্ভাবনও করেছেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। বিশ্বখ্যাত মেডিকেল জার্নাল ল্যানসেটে প্রকাশিত হয় তার এ সংক্রান্ত গবেষণা প্রবন্ধ। বিভিন্ন দেশের বিখ্যাত সব জার্নালে তার এমন স্বাস্ব্যবিষয়ক প্রবন্ধ-নিবন্ধেন সংখ্যা অসংখ্য।

জনস্বাস্থ্য চিন্তাবিদ হিসেবেও ডা. জাফরুল্লাহর ভূমিকা অনন্য। ১৯৮২ সালে দেশে পূর্ণাঙ্গ জাতীয় ওষুধ নীতি কার্যকর হয়। ওই নীতির অন্যতম কারিগর ছিলেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী। ওই নীতির কারণেই বিদেশি ওষুধের আমদানি ২২৫টিতে নেমে আসে। বর্তমানে যে ৯০ শতাংশ ওষুধ দেশেই উৎপাদিত হয় এবং বাংলাদেশ থেকে ওষুধ যে রপ্তানিও হচ্ছে, তার বীজ রোপিত ওই ওষুধ নীতিতেই। দেশের প্রথম স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়নেও তার ভূমিকা অনস্বীকার্য।

ডা. জাফরুল্লাহ ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতিতে সক্রিয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ শাখা ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এরপর আর কখনো সক্রিয়ভাবে রাজনীতি করেননি, তবে সবসময়ই রাজনৈতিক নানা ধরনের কর্মকাণ্ডে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন। আশি ও নব্বইয়ের দশকের সরকারগুলোর সঙ্গে জাতীয় বিভিন্ন ইস্যুতে তিনি কাজ করেছেন। ১৯৮০ সালে জিয়াউর রহমানের গড়া প্রথম জাতীয় মহিলা উন্নয়ন কমিটির দুই পুরুষ সদস্যের একজন ছিলেন তিনি। ওই কমিটির মাধ্যমে প্রাথমিকে ৫০ শতাংশ নারী শিক্ষক ও উচ্চ শিক্ষায় ৩০ শতাংশ ছাত্রী নেয়ার সুযোগ করেছিলেন, যা কার্যকর হয়েছিল এরশাদ আমলে। জিয়াউর রহমানের আমলে পুলিশে নারীদের নিয়োগ দেয়া শুরু হলে দেশের প্রথম দুই নারী পুলিশ হিসেবে নিয়োগ পান গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের কর্মী হোসনে আরা ও চামেলী বেগম। তার পরামর্শেই এরশাদ আমলে পোস্টার, বিলবোর্ড বাংলায় লেখা ও সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলন এবং উপজেলাব্যবস্থা চালু করেন। তবে এরশাদ তাকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব দিলেও তা গ্রহণ করেননি তিনি।

ডা. জাফরুল্লাহ গণমুখী সব ধরনের আন্দোলন-সংগ্রামেই সমর্থন দিয়ে গেছেন। তবে কোনো রাজনৈতিক দলে যোগ দেননি। গত এক দশকে প্রায় সব ধরনের সামাজিক আন্দোলন ও রাজনৈতিক ঐক্য প্রক্রিয়াতেই তিনি ভূমিকা রাখার চেষ্টা করেছেন। ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিরোধী দলগুলোকে নিয়ে গড়ে ওঠে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। ওই জোট গঠনে ডা. জাফরুল্লাহ ভূমিকা রেখেছিলেন। ওই জোটের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি হলেও তিনি আবার সেই দলের সমালোচনা করতেও ছাড়েননি। তবে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির পক্ষে তিনি কথা বলেছেন। এর আগে শিক্ষার্থীদের গড়ে তোলা নিরাপদ সড়ক আন্দোলনেও তিনি আকুণ্ঠ সমর্থন দিয়ে গেছেন।

ডা. জাফরুল্লাহ নানা সময়ে রাজনৈতিকভাবে হয়রানির শিকার হয়েছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের। ২০১৮ সালে ১৫ অক্টোবর রাতে আশুলিয়া থানায় জমি দখলের চেষ্টা, ভাঙচুর ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলা করেন মানিকগঞ্জ জেলার হরিরামপুরের মোহাম্মদ আলী ও নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের আনিছুর রহমান। পরে ওই মামলায় জামিন পান জাফরুল্লাহ চৌধুরী। ওই সময় তিনি ঐক্যফ্রন্ট গড়ে তোলার প্রক্রিয়ায় সক্রিয় ছিলেন। এমন সময়ে এই মামলাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতই মনে করেন তার সমর্থকরা। এ ছাড়া করোনাভাইরাস সংক্রমণে যখন গোটা বিশ্ব করোনা শনাক্ত করার প্রক্রিয়া নিয়ে হাঁসফাঁস করছে, তখন গণস্বাস্থ্য সুলভে করোনা শনাক্তের কিট উদ্ভাবনের দাবি জানালেও সেই কিট শেষ পর্যন্ত সরকারি অনুমোদন পাওয়ার সব প্রক্রিয়া অতিক্রম করতে পারেনি।

রাজনৈতিকভাবে তর্ক-বিতর্ক থাকলেও মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে বিভিন্ন প্রসঙ্গে ডা. জাফরুল্লাহর ভূমিকা প্রশ্নাতীত। ১৯৭২ সালে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য তিনি, প্রথম বৈঠকে সভাপতিত্বও করেন তিনি। ১৯৭৮-৮০ সালে তিনি মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৭২ সালে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও প্রথম মিটিংয়ে সভাপতিত্ব করেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী। ১৯৭৮-৮০ সালে তিনি মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

দেশের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে অবদান রাখার স্বীকৃতি হিসেবে সরকার ১৯৭৭ সালে স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করে ডা. জাফরুল্লাহকে। ১৯৮৫ সালে ফিলিপাইন থেকে পেয়েছেন রামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কার, ১৯৯২ সালে সুইডেন থেকে পেয়েছেন বিকল্প নোবেলখ্যাত রাইট লাভলিহুড পুরস্কার। এত পুরস্কার আর স্বীকৃতি নিয়ে অতি সাধারণ কিন্তু বর্ণাঢ্য এক জীবন কাটিয়ে দেয়া ডা. জাফরুল্লাহ এখন সবকিছুরই ঊর্ধ্বে।

ডা. জাফরুল্লাহ
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close