• রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

তিস্তার চরে ছাগলের গ্রাম!

প্রকাশ:  ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ২১:৩০
পূর্বপশ্চিম ডেস্ক

শহিদুল ইসলাম। তিস্তার নিষ্ঠুর আগ্রাসনে বাপ-দাদার ভিটেমাটি হারিয়েছেন। নিঃস্ব শহিদুল থাকেন অন্যের জমিতে। নিজের বলতে কিছুই নেই। এক সময় ছিল জমি, ছিল হালের গরু, ঘরভর্তি ছিল দেশি জাতের ছাগল। এখন দিন কাটে অন্যের জমিতে। সেই শহিদুল এখন নতুন স্বপ্ন দেখছেন। মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে তার ঘরে একটি ছাগল থেকে হয়েছে ৬টি ছাগল।

মাহিনুর বেগম। ঘরে তিন সন্তান। স্বামী-স্ত্রী আর তিন সন্তান মিলে পাঁচজনের পরিবার। স্বামী আব্দুর রহিমের এক সময় ভিটেমাটি আর কিছু আবাদি জমি থাকলেও সেই ভিটে গেছে তিস্তার পেটে। এখন দিনমজুরিতে দিন চলে মাহিনুর-রহিম দম্পতির। অভাবের সংসারে কষ্টে কাটছিল তাদের। কিন্তু ছাগলে সেই কষ্টের জায়গা দখলে নিয়েছে হাসিতে। তার ঘরেও আছে চারটি ছাগল।

বৃদ্ধ জহির উদ্দিন। বয়সের ভারে অন্যের জমিতে খুব একটা কাজ করতে পারেন না। ছেলেদের সংসারে থাকেন তিনি। মাঝে মাঝে তিনিও অন্যের জমিতে কাজ করেন। উপহারের একটি ছাগল থেকে তার ঘরে এখন তিনটি। এই ছাগল নিয়েই দিন কাটে জহির উদ্দিনের।

গল্পটি শহিদুল, মাহিনুর আর জহির উদ্দীনের শুধু নয়। রংপুরের তিস্তা নদীবেষ্টিত পশ্চিম ইচলি গ্রামের ৪০টি পরিবারের গল্প প্রায় সবার একই। সবার ঘরে ঘরে এখন দুটি থেকে ৫-৬টি করে দেশীয় ছাগল রয়েছে। যাদের প্রত্যেককে বিনামূল্যে একটি করে ছাগল দেওয়া হয়েছিল। ওই গ্রামকে এখন সবাই ছাগলের গ্রাম বলেই চেনে।

স্থানীয় নুরুল ইসলাম জানান, বছর দুয়েক আগে যুক্তরাষ্ট্র থেকে এমন কয়েকজন বাংলাদেশি তারা আমাদের এখানে কিছু লোকজন পাঠিয়েছেন যে, তারা এই গ্রামের অসহায় কিছু মানুষকে সহযোগিতা করবেন। রংপুরের রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু লোকজন আমার সঙ্গে যোগোযাগ করে। আমি এই গ্রামের একদম গরিব মানুষের তালিকা করি, তারাও বেশ কিছুদিন খোঁজখবর নিয়ে তারপর প্রতিটি পরিবারে একটি করে ছাগল দিয়েছে। এখন সবার ঘরে ঘরে দুই থেকে চারটা এমনকি ছয়টি করে ছাগল আছে। আমরা উপকৃত হয়েছি।

সুবিধাভোগী শহিদুল ইসলাম বলেন, একদিন নুরুল ভাই বলেন, তোর নাম দিছি একজন ছাগল দিয়ে যাইবে। আমি খুব খুশি হইছি। ওই একটা ছাগল দিয়ে চারটা ছাগল হইসে। আল্লাহ চাইলে কোরবানির ঈদে দুইটা খাশি বিক্রি করতে পারব।

জহির উদ্দিন বলেন, আমি বয়স্ক মানুষ। ছাগল পেয়ে খুবি খুশি হইছি। ছেলেরা মাঠে কাজ করে, আমি ছাগলগুলো দেখাশোনা করি। একটা ছাগল দিছিল এখন ঘরে তিনটা হইসে। আল্লাহ দেয় তো দুই মাস পর আবার দুইটা হবে। এখন আমার এলাকায় সবার ঘরে ঘরে ছাগল।

মাহিনুর বেগম বলেন, ওমরা ( স্বামী) গিয়ে ছাগলটা আনি দিয়ে কয়, এই ছাগলটা বিদেশি একজন লোক দিছে। তোমরা লালন-পালন করো। সেই ছাগল ছয় মাসের মধ্যে গাভিন (গর্ভবতী) হয়। একসঙ্গে তিনটা বাচ্চা দিছে। পরের বছর আরও একটা দিছে। বছর বছর গাভিন হচ্ছে ছাগল। এমন করি হইলে মেলা ( অনেক) ছাগল হইবে। কয়েক বছর পর কিছু ছাগল বেঁচে গরু কিনব। সেই গরু দুধ দিলে অভাব থাকবে নয়।

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. রফিউল আলম নিসার খান প্রান্তিক নামে একটি ফাউন্ডেশন দেখভাল করে। তিনি বলেন, আমরা পুরো দেশ পরিবর্তন করতে পারব না কিন্তু চাইলে একটি গ্রামের কিছু মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে সহায়তা করতে পারি। এরই অংশ হিসেবে সেকরামেন্টো এরিয়া আমেরিকান বাংলাদেশি অ্যাসোসিয়েশনের আর্থিক সহায়তায় প্রান্তিক ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে তিস্তা নদী তীরবর্তী ইছলি চরের প্রান্তিক মানুষদের বিকল্প আয়ের উৎসের জন্য এই পরিবারগুলোকে ছাগল ও হাঁস দেওয়া হয়। বর্তমানে প্রত্যেকটি পরিবারের দুই থেকে পাঁচটি ছাগল রয়েছে। আমরা ভবিষ্যতে এই প্রকল্প সম্প্রসারণ করতে চাই। যাতে এ পরিবারগুলো স্বাবলম্বী হয়ে ওঠে। সমবায় ভিত্তিতে দুগ্ধ খামার করে দেওয়ার পরিকল্পনা আমাদের বিবেচনায় রয়েছে।

তিনি বলেন, আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের রাজধানী স্যাকরামেন্টো এরিয়ার প্রবাসী বাংলাদেশিদের আর্থিক সহায়তায় বিনামূল্যে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। গত কয়েক বছর ধরে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের সহায়তা, বন্যাকবলিতদের সহায়তা, রমজান সহায়তা, মেন্টালি চ্যালেঞ্জড স্কুলে সহায়তা, আদিবাসীদের সহায়তা, হিজড়া সম্প্রদায়দের সহায়তা, করোনাকালে ত্রাণ বিতরণ ও অক্সিজেন সরবরাহ প্রভৃতি কাজ করে আসছে।

স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল হাদী বলেন, আমি শুনেছি পশ্চিম ইচলি চরে এখন অনেকে ছাগল পালন করছেন, অনেকে বিক্রি করছেন। এটা খুবই ভালো উদ্যোগ। আমি মনে করি আমাদের এই চরে দানশীল ব্যক্তিরা যদি এভাবে এগিয়ে আসে তাহলে অনেক নিঃস্ব পরিবার আবার ঘুরে দাঁড়াবে।

রংপুর,তিস্তা চর,ছাগল
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close