• সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

এখনই কাজে না লাগালে ভবিষ্যতে জনশক্তির সংকটে পড়বে বাংলাদেশ, বলছেন বিশেষজ্ঞরা

প্রকাশ:  ০২ মার্চ ২০২৪, ১৬:৫৪ | আপডেট : ০২ মার্চ ২০২৪, ১৭:১৭
পূর্বপশ্চিম ডেস্ক

বাংলাদেশে এখন কর্মক্ষম জনশক্তি যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করেন, এই জনশক্তিকে এখন কাজে লাগাতে না পারলে ভবিষ্যতে কর্মক্ষম জনশক্তির সংকট হবে। তখন চাইলেও অর্থনৈতিক উন্নয়নে তাদের কাজে পাওয়া যাবে না, বয়স্ক লোকের সংখ্যা বেড়ে যাবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. নূর-উন-নবী বলেন, “বাংলাদেশ এখন ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সর্বশেষ জনগণনার হিসেবে ১৫ থেকে ৫৯ বছর বয়সের জনসংখ্যা ৬৫ থেকে ৬৬%। এরাই কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী।”

তার কথা, “২০৪১ সালের মধ্যে যদি আমরা এদের কাজে লাগাতে না পারি, তাহলে আমরা কিন্তু আমাদের ট্রেন মিস করব। কারণ, মানুষের গড় আয়ু বেড়ে যাচ্ছে, জন্মহার কমছে। তখন প্রতি পাঁচজনে একজন বয়স্ক মানুষের বয়স হবে ৬০ বছরের বেশি। ফলে কর্মক্ষম লোকের সংখ্যা তখন কমে যাবে।”

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অনলাইন জব সাইট বিডিজবসডটকমে বেসরকারি খাতে চাকরির সবচেয়ে বেশি বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়। নিয়োগ দাতাদের সিভি বাছাইয়ের কারিগরি সহায়তাও দেয় তারা।

প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফাহিম মাশরুর বলেন, “আইটিসহ সেবাখাতগুলোতে চাকরি গত দুই বছর ধরে স্থিতিশীল আছে। ম্যানুফ্যাকচারিং ও পোশাক খাতে চাকরি ২০%-এর মতো কমে গেছে।” তবে তারা গ্র্যাজুয়েট লেভেল নিয়ে কাজ করে, যারা ওই পর্যায়ের জনশক্তি নিয়োগ করে তাদের ব্যাপারেই তাদের ভালো ধারণা রয়েছে। গ্র্যাজুয়েটদের জন্য প্রতি বছর আইটি ও সেবা খাতে তিন লাখের মতো চাকরির সুযোগ তৈরি হচ্ছে। আর শিল্পখাতে চার থেকে পাঁচ লাখ লোকের চাকরির সুযোগ তৈরি হয়।

বাংলাদেশে বেসরকারি খাতই কর্মসংস্থানের সবচেয়ে বড় জায়গা। এরপর হলো যারা বিদেশে যান। আর সবার শেষে আছে সরকারি চাকরি।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর হিসেবে, দেশে কৃষি খাতে সবচেয়ে বেশি তিন কোটি ১৭ লাখ ৮০ হাজার নারী-পুরুষ কাজ করেন। শিল্পে এ সংখ্যা এক কোটি ২৪ লাখ ৯০ হাজার আর সেবা খাতে ২ কোটি ৬৮ লাখ ৪০ হাজার। ২০২৩ সালে বিদেশে বাংলাদেশ থেকে কাজের জন্য গিয়েছেন ১৩ লাখ পাঁচ হাজার ৪৫৩ জন। ২০২২ সালে এই সংখ্যা ছিল ১১ লাখ ৩৫ হাজার ৮৭৩ জন।

সর্বশেষ স্ট্যাটিসটিকস অব সিভিল অফিসারস অ্যান্ড স্টাফসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের সরকারি চাকরিজীবীর সংখ্যা ১৫ লাখ ৫৪ হাজার ৯২৭ জন। তাদের মধ্যে নারী চার লাখ চার হাজার ৫৯১ জন, যা মোট সরকারি চাকরিজীবীর প্রায় ২৬%। ২০১০ সালে নারী চাকরিজীবীর সংখ্যা ছিল ২১%।

ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, সরকারের অধীনে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, অধিদপ্তর, পরিদপ্তর ও সরকারি কার্যালয়গুলোতে বেসামরিক শূন্যপদ এখন তিন লাখ ৫৮ হাজার ১২৫টি। এর মধ্যে প্রথম শ্রেণির পদ ৪৩,৩৩৬টি, দ্বিতীয় শ্রেণির ৪০,৫৬১, তৃতীয় শ্রেণির এক লাখ ৫১ হাজার ৫৪৮ এবং চতুর্থ শ্রেণির শূন্যপদ এক লাখ ২২ হাজার ৬৮০টি।

বিবিএস-এর হিসেব বলছে, দেশে এখন মোট বেকারের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৩ লাখ ৫০ হাজার। এর মধ্যে পুরুষ ১৫ লাখ ৭০ হাজার এবং নারী সাত লাখ ৮০ হাজার। ২০২২ সালে বেকারের সংখ্যা ছিল ২৩ লাখ ১০ হাজার। বিবিএসের হিসেব সঠিক ধরে নিলেও এক বছরে দেশে ৪০ হাজার বেকার বেড়েছে।

বিবিএস ২০২২ সালের জরিপে বলেছে, উচ্চশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর ১২% বেকার। সংখ্যার হিসেবে এটা আট লাখ। এরা সবাই স্নাতকোত্তর, চিকিৎসক, প্রকৌশলী।

ফাহিম মাশরুর বলেন, “আমরা যেসব চাকরির সিভি পাই, তা বাছাই করে দেখা গেছে, তাদের ৮০%-ই আনফিট। তাদের আসলে অ্যাকাডেমিক ডিগ্রি থাকলেও ওই কাজ করার মতো প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও যোগ্যতা নাই।

তিনি বলেন, “এখন যেসব খাত, বিশেষ করে আইটি, সেবা ও ম্যানেজারিয়াল লেভেলে চাকরির সুযোগ তৈরি হচ্ছে, যেখানে আইটি জ্ঞানসম্পন্ন লোক দরকার। আইটি মানে, শুধু কম্পিউটার জানলেই হবে না, কোনো একটি সেক্টরে তার বিশেষ জ্ঞান থাকতে হবে।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক মো. মজিবুর রহমান বলেন, “আসলে আমাদের দেশে সঠিক পরিকল্পনা নেই। আগামী ২০ বছরে আমাদের কোন খাতে কত লোক লাগবে, কোন ধরনের যোগ্যতার লোক লাগবে, সেই পরিকল্পনা আমাদের নেই। ফলে সবাই চাচ্ছে উচ্চ ডিগ্রি নিতে, কিন্তু তা বাস্তবে কাজে আসছে না।”

“এই যে আমরা বিদেশে জনশক্তি পাঠাচ্ছি, তাদের কোনো পেশাগত দক্ষতা নাই। ফলে তারা শ্রমিকের কাজ করছেন। তাদের আয়ও কম। তাদের প্রশিক্ষিত করে পাঠাতে পারলে তারা ভালো কাজ পেতেন, রেমিট্যান্সও বেশি আসত।”

ফাহিম মাশরুর বলেন, “বাংলাদেশের শিল্পখাতে একটি লেভেলে বিদেশি লোকজন কাজ করেন। এর কারণ আমাদের ওই কাজের দক্ষ লোক নেই। আমাদের দেশে যে কাজ আছে, তা করার জন্যই দক্ষ জনবল আমাদের নেই।”

বিবিএস বলছে, দেশে বছরে ২০ লাখ মানুষ চাকরির বাজারে প্রবেশ করছে। তার মধ্যে ১৩-১৪ লাখের দেশের অভ্যন্তরেই কর্মসংস্থান হয়। বাকিরা দেশের বাইরে চলে যান।

২০২৩ সালে দেশে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ছিল সাত কোটি ৩৪ লাখ ৫০ হাজার, ২০২২ সালে দেশে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী ছিল সাত কোটি ৩০ লাখ ৫০ হাজার, ২০২৩ সালে কর্মে নিয়োজিত মানুষের সংখ্যা সাত কোটি ৯ লাখ ৮০ হাজার। বিবিএসের হিসাবে বেকারের বাইরে দেশের বড় একটি জনগোষ্ঠী শ্রমশক্তির বাইরে রয়েছে। সেই সংখ্যাটি প্রায় চার কোটি ৭৪ লাখ। যাদের বড় অংশই শিক্ষার্থী, অসুস্থ, অবসরপ্রাপ্ত বা বয়স্ক লোক।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এবং সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)-এর নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান বলেন, “বিবিএসের জরিপে দেশে এখন বেকারত্বের হার চার থেকে সাড়ে চার ভাগ। কিন্তু এই জরিপ থেকে দেশের বেকারত্বের প্রকৃত চিত্র বোঝা যাবে না। কারণ, এখানে শ্রম শক্তির ৮০% অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন। সেখানে মজুরি কম, কাজের পরিবেশ ভালো নয় আবার চাকরি নিশ্চয়তা নেই। ফলে সেখানে ছদ্ম বেকারত্ব আছে। কৃষি খাতে ছদ্ম বেকারত্ব আছে।

“আরেকটি জনগোষ্ঠী আছে, যাদের কোনো শিক্ষাও নাই, কোনো ধরনের প্রশিক্ষণও তাদের নেই। এই সংখ্যাটাও বেশ বড়। তারাও সংকটের কারণ,” বলেন এই অর্থনীতিবিদ। তার কথা, গত ১০ বছর ধরে বিনিয়োগ নিম্নমুখী, বৈদেশিক বিনিয়োগেও ভাটা। ফলে কর্মসংস্থানের জায়গা তৈরি হচ্ছে না। বিনিয়োগ না বাড়লে কর্মসংস্থান বাড়বে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. নূর-উন-নবী বলেন, “আমরা ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশে প্রবেশ করব। ২০৩০ সালে আমাদের সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল অর্জন করতে হবে। ২০৪১ সালে উন্নত দেশ হওয়ার স্বপ্ন আছে। সেটা হতে হলে আমাদের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগাতে হবে। তার মানে হলো, ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডকে কাজে লাগাতে হবে। অর্থাৎ, এটাকে ক্যাপিটালে রূপান্তরিত করতে হবে।”

তার মতে, “নানা উদ্যোগ আছে কর্মসংস্থান তৈরির। দক্ষতা বাড়ানোরও নানা প্রকল্প আছে। কিন্তু তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম।”

বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান সম্প্রতি সংসদে বলেছেন, “আগামী পাঁচ বছরে সরকার ৬০ লাখ লোককে বিদেশে পাঠানোর পরিকল্পনা করেছে। বাংলাদেশ থেকে ১৭৬ দেশে এখন লোক পঠানো হচ্ছে।” কিন্তু এখন যারা যাচ্ছেন, তাদের অধিকাংশই অদক্ষ কর্মী। বিএমইটির জেলায় জেলায় প্রশিক্ষণ কেন্দ্র আছে। আছে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রও। তবে যে মানের দক্ষ কর্মী দরকার, সেই মানের দক্ষতা তৈরি করার জন্য তা পর্যাপ্ত নয়। আর শিক্ষা ব্যবস্থাই সেইভাবে সাজানো দরকার।

বাংলাদেশে সরকারি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের ইন্টার্নশিপের সুযোগ দেওয়া হবে। আর এজন্য নীতিমালাও তৈরি করা হয়েছে। তাতে ওই সময়ে শিক্ষার্থীরা কী সুবিধা পাবেন, শর্ত কী হবে তার বিস্তারিত আছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের জন্যও নীতিমালা হচ্ছে। অবশ্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ইন্টার্নশিপের সুযোগ আগে থেকেই আছে। তবে সেটা আরও বিস্তৃত এবং নীতিমালার মধ্যে আনতে চায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক মো. মজিবুর রহমান বলেন, “আসলে এই ইটার্নশিপ একটি ভালো দিক। এর মাধ্যমে তরুণরা দক্ষতা অর্জন করতে পারবে। তবে সবচেয়ে ভালো হয় শিল্প উদ্যোক্তারা যদি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে চুক্তি করেন তাদের প্রয়োজনীয় জনশক্তির জন্য। তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সেভাবে শিক্ষার কাজ করত। বাইরের দেশে এমনকি আমাদের পাশের দেশেও এভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের পাঠক্রম ঠিক করছে।”

তার কথা, “শিক্ষার দর্শনগত দিক তো আছেই, কিন্তু শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার দিকেও খেয়াল রাখতে হবে।” আর অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, “বিনিয়োগ বাড়ানোর পাশাপাশি এর বৈচিত্র্য এবং বহুমুখীতা দরকার। অর্থনৈতিক সংস্কার করে বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি করতে হবে। বিনিয়োগ ছাড়া কর্মসংস্থানের আশা করা যায় না।”

ফাহিম মাশরুর বলেন, “তরুণদের সরকারি চাকরি, বিশেষ করে বিসিএস-এর প্রতি ঝোঁক প্রমাণ করে, বেসরকারি খাত গুরুত্ব হারাচ্ছে। এখানে নিরাপত্তা নেই। এখানে বেতন কম। আর সরকারি চাকরিতে অবৈধ আয়ের সুযোগ আছে। এটা কোনো ভালো লক্ষণ নয়। বেসরকারি খাতের আকর্ষণ না থাকলে বুঝতে হবে বড় সংকট তৈরি হয়েছে।”

সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি এম এ মান্নান বলেন, “পাঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় কর্মসংস্থান ও দক্ষ জনশক্তি গড়ার বিস্তারিত পরিকল্পনা আছে। তবে করোনাভাইরাস, ইউক্রেন যুদ্ধ, বিশ্ব মন্দা- এসব কারণে ছন্দপতন হয়েছে। তবে আশা করি, এটা আমরা কাটিয়ে উঠতে পারব।”

তার কথা, “সরকার প্রযুক্তি শিক্ষায় জোর দিয়েছে। জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করছে। এর উদ্দেশ্যই হলো দক্ষ জনবল গড়ে তোলা।”

সরকারি চাকরি,বেসরকারি চাকরি,বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো-বিবিএস
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close