• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

প্রাণহীন গুমোট হাওয়া বইছে

প্রকাশ:  ০৯ এপ্রিল ২০১৯, ২২:৫৬ | আপডেট : ১০ এপ্রিল ২০১৯, ২০:০৫
পীর হাবিবুর রহমান

প্রকৃতিতে কালবৈশাখী ঝড় আসা শুরু হয়েছে। কখনোসখনো শিলাবৃষ্টিও দেখা যাচ্ছে। দেশের কৃষকসমাজ হাওরাঞ্চলের ফসল নিরাপদে ঘরে তোলার তুমুল উত্তেজনা নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় দিন যাপন করছে। রাজনীতি ও সমাজজীবনেও কি এক অস্থিরতা! কখনোসখনো মনে হয়, প্রাণহীন সমাজজীবনে গুমোট হাওয়া বইছে; যেন কোনো অজানা ঝড়ের পূর্বাভাস লক্ষ্য করছেন অনেকে। এক ধরনের প্রাণহীনতা বিরাজ করছে সমাজজুড়ে। রাজনীতি নিস্তরঙ্গ হয়ে গেছে। সমাজকে এখন আর জবাবদিহিমূলক গণতান্ত্রিক সমাজ বলা যাবে না। বুকে পাথর, গলায় ফাঁস, হাত বাঁধা কেউ কেউ অনুভব করছেন। হাত-পা ছুড়ে তাই প্রতিবাদ করতে ভুলে গেছেন। না হয় অন্যায়-অনিয়মের বিরুদ্ধে স্লোগান তুলতে শানিত ভাষায় লিখতে ভয় পাচ্ছেন। কণ্ঠ ছেড়ে কথা বলছেন না। চারদিকে সত্যবাবুকে মেরে মিথ্যার জয়গান চলছে।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর জাতীয় সংসদ আকর্ষণ জাগানো দূরে থাক, অতীতের সকল সময়ের চেয়ে আকষর্ণহীন দৃশ্যপট হয়ে দেখা দিয়েছে। সরকারে নতুনত্বের চমক থাকলেও প্রবীণের সমন্বয় না ঘটায় কোথায় যেন ছন্দপতন ঘটছে। দেশজুড়ে বিক্ষিপ্ত বিচ্ছিন্ন ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে সমাজে অস্থিরতা বিরাজ করছে। গণতন্ত্রহীনতা, বিরোধী দলকে নিপীড়নে স্থবির করে রাখা, সবাই রাতারাতি সরকারপক্ষের হয়ে উন্নাসিকতার দম্ভে সমাজকে নিস্তব্ধ, শ্বাস-প্রশ্বাসহীন করে দিয়েছে। জাতীয় নির্বাচনের পর উপজেলা নির্বাচন এমনকি একতরফা ঢাকা উত্তরের মেয়র নির্বাচন ভোটারদের টানতে পারেনি। ভোটের আকর্ষণ হারিয়েছে মানুষ। এ নিয়ে কোথাও কারও ভ্রুক্ষেপ নেই। গণতন্ত্র চাইলে সব মত-পথের কথা শুনতে হবে। সব দলের কর্মকা চালাতে দিতে হবে। নির্বাচনের প্রতি মানুষের আগ্রহ ফিরিয়ে আনতে হবে। গণতান্ত্রিক সমাজে শক্তিশালী সরকারের সঙ্গে শক্তিশালী বিরোধী দল, অবাধ কর্মকা ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের বিকল্প নেই। গণতান্ত্রিক সমাজ ছাড়া কোনো মহাউন্নয়নের চিত্রপটও মানুষকে সুখী করতে পারবে না। সুশাসন ছাড়া, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করা ছাড়া মানুষের বিশ্বাস অর্জন করা যাবে না।

সম্পর্কিত খবর

    সুমহান মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকারিত্ব বহন করা দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ মুজিবকন্যা শেখ হাসিনাকে আবারও ক্ষমতায় দেখতে চেয়েছে। টানা তৃতীয়বার মিলিয়ে তিনি চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হয়ে ইতিহাস গড়েছেন। এ ইতিহাস গড়তে গিয়ে সেই বিভীষিকাময় কালরাতে পরিবার-পরিজন হারিয়ে দীর্ঘ নির্বাসিত জীবনের অবসান ঘটিয়ে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী হিসেবে এক অন্ধকার অশুভ অগণতান্ত্রিক শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তথা মার্শাল ল জমানার বিরুদ্ধে উজানে সাঁতার কেটে তাকে দীর্ঘ সংগ্রামের অগ্নিপরীক্ষা দিতে হয়েছে। শেখ হাসিনার ৩৭ বছরের সংগ্রামমুখর রাজনৈতিক নেতৃত্বের জীবনে নিরন্তর লড়াই করেছেন। বার বার মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরেছেন। কারানির্যাতন ভোগ করেছেন। এমনকি প্রকাশ্য দিবালোকে তাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে ভয়াবহ একুশে গ্রেনেড হামলা হয়েছে। তার সফরসূচি ঘিরে বোমা পুঁতে রাখা হয়েছে। জীবন-মৃত্যু পায়ে পায়ে তার সঙ্গে হেঁটেছে। মৃত্যুর আঘাতকে পরাস্ত করে ষড়যন্ত্রের জালকে ছিহ্ন করে সংগ্রাম-লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে তিনি বার বার বিজয়ের পতাকা উড়িয়েছেন।

    বঙ্গবন্ধু হত্যাকাে র পর চরম দমননীতি ও অনেক অতিবিপ্লবী প্রগতিশীল রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তির অপপ্রচার, প্রচ বিরোধিতা, রাজনীতির ময়দানে আওয়ামী লীগকে নিঃসঙ্গ ও একঘরে করে রেখেছিল। শেখ হাসিনা লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে নিজের ইমেজকেই উচ্চতায় তোলেননি, মানুষের আস্থা ও ভালোবাসায় প্রতিষ্ঠিত করেননি, আওয়ামী লীগকেও বঙ্গবন্ধুর পর গণমুখী জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলে পরিণত করেন। দ্বিতীয় দফায় দলটির চূড়ান্ত বিকাশ ঘটে তার হাত ধরে। কিন্তু আওয়ামী লীগের জন্য গৌরবের বিষয় হচ্ছে দলের ত্যাগী নেতা-কর্মীদের আপসহীন লড়াই, আদর্শিক সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের বিনিময়ে কর্মীদের বুকের তাজা রক্তে গণতান্ত্রিক সংগ্রামে ও নির্বাচনী যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসার পর একদল সুবিধাভোগী নানা শ্রেণি-পেশার সুযোগসন্ধানীরা মোসাহেবি চাটুকারিতায় দলের ওপর ভর করে বসে। ক্ষমতার ছায়ায় সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করে ফুলে ফেঁপে বড় হয়। আর প্রকৃত বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি অনুগত এবং দলের প্রতি নিবেদিত নেতা-কর্মীরা দূরে সরে যায়।

    একুশ বছর পর ক্ষমতায় এসে মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা ’৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত একটি অসাধারণ উন্নয়নবান্ধব গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা জাতিকে উপহার দিয়েছিলেন। জাতীয় ও স্থানীয় রাজনীতিতে আলোকিত, গণমুখী, অভিজ্ঞ, দক্ষ, রাজনীতিবিদ এবং জাতির মেধাবী সন্তানদের নিয়ে শক্তিশালী সরকার গঠন করেছিলেন। সে সময় তার সব বিস্ময়কর অর্জন ধূসর করে দিয়েছিল দু-একটি অঞ্চলে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা দলের কোনো কোনো আঞ্চলিক নেতা। আর সুবিধাভোগী সুযোগ-সন্ধানী শ্রেণিটি শেয়ারবাজার লুটের মতো নানা অপকর্ম ঘটিয়ে। তবু জনমত তার অনুকূলে ছিল। ২০০১ সালে নির্বাচনে তার পরাজয় ঘটেছিল। আওয়ামী লীগের একলা চল ভ্রান্ত নীতির বিপরীতে গড়ে ওঠা বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট এবং ধর্মীয় রাজনীতির ইস্যুর সঙ্গে নানান ষড়যন্ত্রের কারণে।

    বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকার গণতন্ত্রের নবযাত্রায় ’৯১ থেকে ’৯৬ সাল পর্যন্ত এরশাদ ও তার জাতীয় পার্টির ওপর কঠোর দমননীতি ছাড়া উত্তম গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা উপহার দিয়েছিল। কিন্তু ২০০১ সালের নির্বাচনে জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে ক্ষমতায় আসা সেই খালেদা জিয়া ও তার বিএনপি আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করার উন্নাসিক, দাম্ভিক শাসন কায়েম করেছিল। যেখানে বিএনপির আলোকিত নেতারাই হয় দল ছেড়েছিলেন, নয় লাঞ্ছিত হয়েছিলেন। অথবা কোণঠাসা হয়েছিলেন। বিএনপির সেই পাপের শাসনামলের খেসারত এখনো তাদের দিতে হচ্ছে।

    ক্ষমতার আবহটা এতটাই গরম যে সেখানে থাকলে যত দূর চোখ যায় কাচের দেয়ালে বন্দী থেকে শুধু মোসাহেবদের চাটুকারিতা, সুযোগ-সন্ধানীদের তোষামোদী, দলে অনুপ্রবেশকারীদের জয়ধ্বনি। আর ক্ষমতায় চিরস্থায়ীর স্বপ্নই দেখা যায়। রাষ্ট্রীয় প্রশাসনযন্ত্র থেকে সমাজের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ যেন তখন সরকারি দল হয়ে যায়। বিএনপি-জামায়াতের শাসনামলে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের ওপর ধর্ষণ, নির্যাতন, হামলা-মামলা, কারাদহন, এমনকি বোমা হামলা, গ্রেনেড হামলার মতো ভয়াবহ ঘটনাই ঘটানো হয়নি, সংবিধানের ওপর ভর করে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনযন্ত্রকে ব্যবহার করে ক্ষমতায় থাকার অদম্য বাসনা জেগেই ওঠেনি; অনেকের মনে চিরস্থায়ী রূপ নিয়েছিল। আওয়ামী লীগের সেই দুঃসময়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নেতা-কর্মীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে কঠিন সময় মোকাবিলা করেছেন। প্রথমে ১৪ দল পরে মহাজোট গঠন করেছেন।

    একতরফা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতার পথে অগ্রসর বিএনপি-জামায়াতের শক্তিকে গণআন্দোলনে প্রতিরোধ করলে রক্তাক্ত সহিংসতার পথে গোটা দেশ কার্যত অচল হয়ে পড়েছিল। সেই সময় অনিবার্য পরিণতিতে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় এসে একতরফা নির্বাচন বাতিল করেছিল। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগই সেই সরকারকে সমর্থন দেয়নি- জনগণও অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল। কিন্তু সেই সরকারও গ্রহণযোগ্য নির্র্বাচনের পথ পরিহার এবং রাজনৈতিক সংস্কারের নামে মানুষকে বিভ্রান্ত করে ক্ষমতায় থাকার উচ্চাভিলাষে মগ্ন হয়ে দাম্ভিকতার চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছিল। দুই নেত্রীকেই কারাগারেই নেওয়া হয়নি, রাজনীতিবিদ ও তাদের পরিবার-পরিজনকে হয় গ্রেফতার করে কারাগার, নয় দেশান্তরীই করা হয়নি, দেশের ব্যবসায়ীদেরও পর্যন্ত ইজ্জত হরণ করেছিল। নানা শ্রেণি-পেশার মানুষকে আতঙ্কগ্রস্ত করেছিল।

    একটি গ্রহণযোগ্য ভোটার তালিকা ও নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিলেও সেই দাম্ভিক শাসকদের করুণ পরিণতি ঘটেছে। সেই দুঃসময় মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা অমিত সাহস নিয়ে তেজস্বী নেতৃত্বের গুণে বৈরী সময়কে মোকাবিলা করে কারামুক্তই হননি, নির্বাচনে ব্যালট বিপ্লবে ক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের যেমন ফাঁসিতে ঝুলিয়েছেন, তেমনি একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের ফাঁসি দিয়েছেন। জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যেমন জয়ী হয়েছেন, তেমনি প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে করুণ দুরবস্থায় ফেলে দিয়েছেন। আর জামায়াত নামের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর দোসর দলটিকে শোচনীয় অবস্থায় দুর্বল করে অঘোষিতভাবে নিষিদ্ধই করে ফেলেছেন। বাংলাদেশকে উন্নয়নের কর্মযজ্ঞে মুখরই করেননি, অর্থনৈতিক উন্নয়নে পশ্চিমাদের কাছেও বিস্ময়কর উঁচুতে নিয়ে গেছেন। কিন্তু যে মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার জীবন-যৌবন মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও গণতন্ত্রের জন্য উৎসর্গ করেছিলেন কঠিন লড়াইয়ে, যে শেখ হাসিনার সংগ্রামও ছিল গণতন্ত্রের, যে আওয়ামী লীগ আজীবন গণতন্ত্রের সংগ্রাম করেছে, যে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা একটি আদর্শিক গণমুখী সাহসী চরিত্র নিয়ে লড়াই-সংগ্রামে শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন ধারণ করেছে, সেই আওয়ামী লীগ যেন আজ তার চরিত্র হারিয়ে ফেলেছে। গণতন্ত্র ও মানুষের ভোটের অধিকার বেমালুম ভুলে যাচ্ছে। সারা দেশের এমপি-মন্ত্রীদের কাঁধে ভর করে ১০ বছরের শাসনামলে বানের স্রোতের মতো সুবিধাবাদীরা দলে আশ্রয় নিয়েছে। আর দল ও সরকার সব রাজনৈতিক দলের সমান স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক অধিকার, কর্মকা , সভা-সমাবেশ-মিছিলের পথ রুদ্ধ করে দিয়ে রাজনীতিকে মরুকরণ করেছে।

    শাসকদল বা তার সমর্থকদের একচ্ছত্র কর্মকা দাম্ভিক আচরণ অন্যদিকে বিরোধী দলের কর্মকাে র নিস্তব্ধতা বা ব্যর্থতা সমাজকে দমবন্ধ অবস্থায় ফেলে দেয়। এর পরিণতি কখনো ভালো হয় না। সুখের হয় না। এতে যে কোনো সময় যে কোনো ইস্যুতে গণবিস্ফোরণ ঘটার আশঙ্কা থেকে যায়। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সব মত-পথের মানুষ বুকভরে শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়। জামায়াত শেষ হয়ে যাক। নিষিদ্ধ হয়ে যাক। কিন্তু ধর্মান্ধ উগ্রবাদী শক্তির উত্থান রুখতে কার্যকর শক্তিশালী বিরোধী দলের জন্যও জায়গা ছেড়ে দিতে হবে। না হয় ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়। ক্ষমতা হারালেই কেবল ক্ষমতাবানরা বুঝতে পারেন পরিণতি কত কঠোর ও কঠিন। সরকারে যতটা সুসময় বিরোধী দলে তার চেয়ে তীব্র দুঃসময়। কেবল ক্ষমতার অন্ধত্ব ও দমন কখনো কল্যাণ আনতে পারে না। রাজনীতিকে রাজনীতিতেই মোকাবিলা করতে হয়।

    রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল থেকে গণমাধ্যম এমনকি আওয়ামী লীগের দলীয় ফোরামেও এ বিশাল সুবিধাবাদী অংশের অনুপ্রেবেশ নিয়ে নেতারা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা এবং ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলেছেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ কার্যত দলে অনুপ্রবেশকারী সুবিধাবাদীদের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না। প্রশাসনসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার অতি উৎসাহীরা শেখ হাসিনার চেয়ে আজ বড় আওয়ামী লীগার হয়ে উঠেছেন।

    সিভিল সোসাইটি থেকে গণমাধ্যম শক্তিশালী সরকারের পাশাপাশি জবাবদিহিমূলক শাসনব্যবস্থা নিশ্চিতকরণে উপযোগী শক্তিশালী বিরোধী দলের অনুপস্থিতির কারণে হয় নীরব নিথর হয়ে পড়েছে, নয় কেউ কেউ অতিমাত্রায় আওয়ামী লীগ হয়ে উঠেছেন

    স্বাধীনতা-উত্তরকালে আমাদের পূর্বসূরিরা সরকারের চতুর্দিকে বা শাসক দলের অভ্যন্তরে যে চিত্রপট দেখেছিলেন এখন তার অনেকটাই তাদের উত্তরসূরিরা পর্যবেক্ষণ করছেন। বলছেন, সবখানে সব পথে সবাই আজ আওয়ামী লীগ সরকার সমর্থক। এই আলামত ভালো নয়। আদর্শ বিশ্বাসে এরা আজ সরকার ও শাসক দলের পক্ষে কোরাস গাইছেন। সুবিধা আদায়ে অথবা স্বার্থ উদ্ধারে সরকারের জয়ধ্বনি দিচ্ছেন। পঁচাত্তরের পর এদের পাওয়া যায়নি। ২০০১ সালের পর দেখা মেলেনি। কাল ক্ষমতায় না থাকলে পরশু দেখা মিলবে না।

    বিশ্বমোড়লদের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে শেখ হাসিনা একাত্তর ও পঁচাত্তরের ঘাতকদের ফাঁসি দেন। বিশ্বব্যাংকের অভিযোগকে মিথ্যা প্রমাণিত করে তাদের সহযোগিতা ছাড়াই পদ্মা সেতুর মতো বিশাল প্রকল্প শেষ করছেন। দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে ইতিহাস গড়তে যাচ্ছেন। কিন্তু এতসবের মধ্যেও সেই ২০১০ সালে শেয়ার কেলেঙ্কারি ঘটে যাওয়ার পর তার ঝড়ের কবল থেকে এখনো পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকে অবাধ লুণ্ঠন হয়েছে। মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়েছে। তবু সেখানে সংস্কার কমিশন এখনো হয়নি। সাবেক অর্থমন্ত্রী সংসদে দাঁড়িয়ে যেটি উত্তরসূরিদের জন্য রেখে গিয়েছিলেন তার কোনো আলো এখনো আর্থিক খাতে পড়েনি। শেয়ারবাজারে উত্থান-পতন মিলিয়ে ভয়াবহ অবস্থা। প্লেসমেন্ট শেয়ার নিয়ে কারসাজি বা ষড়যন্ত্র রুখে দাঁড়ানোই যাচ্ছে না। বিনিয়োগকারীদের বুকভরা হতাশা আর্তনাদ। অন্যদিকে একটি শ্রেণি মুনাফা লুটে নিয়ে যাচ্ছে। ব্রোকার হাউসগুলোর অনেকের বাতি নিভে যাচ্ছে। একসময় ’৯৬ ও ২০১০ সালের বিপর্যয়, লুটপাট নিয়ে বলা হতো আওয়ামী লীগ যত উন্নয়নই করুক, তাদের সময়ই শেয়ারবাজার লুট হয়। পরে যোগ হয় ব্যাংক লুট। বিদেশে টাকা পাচার। এ দুটিতে সংস্কার ও শক্তিশালী করা অনিবার্য এখন।

    শিল্পবান্ধব ব্যাংকিং খাতের জন্য প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পরও সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে আসছে না। দুদক চেয়ারম্যান পাগলের মতো ছুটছেন। শেখ হাসিনা পিতার মতো লোভ-লালসা ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে বার বার আর্তনাদ করছেন। যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। কিন্তু সমাজের সর্বস্তরে ক্যান্সারের মতো ছড়িয়ে পড়া ঘুষবাণিজ্য দুর্নীতি কোনো থেরাপিতে নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না।

    বেসরকারি খাতকে শেখ হাসিনা প্রাধান্য দিলেও, সহযোগিতা দিলেও দেশি বিনিয়োগ কমে গেছে। বিদেশি বিনিয়োগ অর্ধেকে নেমেছে। দেশের অর্থ বিদেশে পাচার হয়েছে। কারা পাচার করেছেন? অনৈতিকভাবে কারা লুটপাট করে ১০ বছরে অগাধ বিত্তবৈভব করেছেন? তাদের আইনের আওতায় আনা যাচ্ছে না। লুটেরা গোষ্ঠী নিরাপদে ধনবান হয়ে যাচ্ছে। তদবিরবাজ সুবিধাবাদী শ্রেণি ধনাঢ্য হচ্ছে।

    দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখা শিল্পকারখানার মালিকরা এবং পেশিবহুল কৃষক হিমশিম খাচ্ছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি যেমন সুশাসন নিশ্চিত হয়নি, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা তেমনি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি। তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিপ্লব ঘটে গেলেও সমুদ্র জয়, আকাশ জয় হয়ে গেলেও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন বা রাজদুর্নীতির এ যুগে মূল্যবোধ নীতিনৈতিকতা নির্বাসিত হয়ে যাচ্ছে। লোভের ফণা দিকে দিকে তুলতে দেখা যাচ্ছে। রাতারাতি বড়লোক হওয়ার উগ্র বাসনা সমাজের সর্বস্তরে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে তৈরি হয়েছে।

    একসময় শিক্ষা ভবনের গেট থেকে ভিতর পর্যন্ত ঘুষবাণিজ্য ছিল রমরমা। এখন দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় দুর্নীতির অভিযোগের তীরে, অনিয়মের অভিযোগের তীরে, এমনকি প্রশাসনিক ব্যর্থতার প্রশ্নে বিদ্ধ হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মর্যাদাবান সবার কাছে শ্রদ্ধার আসনে অভিষিক্ত উপাচার্যের বদলে শাসকদলের কর্মীর চেহারার শিক্ষকরা স্থান পাচ্ছেন। একেকটি বিশ্ববিদ্যালয় তার ইমেজ সংকটের মধ্যে পতিত হয়েছে। যুবলীগ করা, ছাত্রলীগ করা, জেলা আওয়ামী লীগের সংগঠনে থাকা শিক্ষকরা এমনকি সরাসরি সরকারি দল করা কর্মীর মতো আচার আচরণে অভ্যস্ত মেরুদ হীন, ব্যক্তিত্বহীন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা একেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হচ্ছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দলবাজ শিক্ষকরা বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এখন। সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারবিরোধী কোনো ছাত্র আন্দোলন নেই। তবু তারা সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের ক্যাডারদের লালন করেন। ছাত্রলীগের ইমেজ নষ্ট করেন তাদের ব্যক্তিস্বার্থে। রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি মাসের পর মাস অনুপস্থিত থাকেন। ক্যাম্পাসে থাকেন না এমন অনিয়ম নির্লজ্জতা কখনো হয়নি। শিক্ষক-কর্মচারী থেকে সব নিয়োগ প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ হয়। ভিসিবিরোধী আন্দোলন হয়।

    জ্ঞানের তীর্থক্ষেত্র বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন আর আলো ছড়ায় না। ক্ষমতার সুযোগ-সুবিধা ব্যক্তিগত লাভ-লোকসানের হিসাব-নিকাশেই প্রশাসনিক দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকরা ব্যস্ত। তাই এখন আর মেধাবী সন্তানরা অযত্নে অবহেলায় রুগ্ন হয়ে বের হয়। একদল শিক্ষকের জন্য সব শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয় আজ ইমেজ সংকটে।

    ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একসময় জাতির জনককেই নয়, জাতীয় নেতাদেরই নয়, আজকের প্রধানমন্ত্রীই নয়, অসংখ্য রাজনৈতিক নেতা-কর্মীর জন্ম দিয়েছে। অসংখ্য মেধাবী দেশপ্রেমিক পেশাদার সরকারি কর্মকর্তা, শিল্পী, সাহিত্যিক, কবি, সাংবাদিক উপহার দিয়েছে। সমাজের সকল শ্রেণি-পেশায় আত্মমর্যাদাসম্পন্ন মেধাবী সন্তানদের উপহার দেওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এখন দলবাজ শিক্ষক ও দলদাস, দলকানা, দলদাসী মানুষ উপহার দেয়।

    অনেকের মধ্যে দেশজুড়ে ভাবখানা এমন এসেছে যে, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আনবেন, আমরা দাম্ভিক চেহারা দেখাব। আমরা পাপাচারে লিপ্ত হব। আমরা সীমাহীন দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হব। অনিয়মকে নিয়মে পরিণত করব। মাদকের আগ্রাসনে গোটা দেশ এখন আক্রান্ত। শেখ হাসিনা মাদকের বিরুদ্ধে লড়ছেন। র‌্যাব মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাজ করছে। কিন্তু মাদকের বিরুদ্ধে সমাজে যে গণজাগরণ হওয়া উচিত, সামাজিক যে দায়বদ্ধতা থেকে জনগণের এগিয়ে আসা উচিত, তা ঘটছে না।

    একটা আবেগ-অনুভূতিহীন, বোধহীন লালসায় পরিণত নিষ্প্রাণ সমাজে আমরা বাস করছি।

    দুর্নীতি ও দখলবাজির বিষ রাজধানী থেকে নগর-শহর হয়ে গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ছে, রাজনৈতিক প্রশাসনিক ও সুবিধাভোগী শ্রেণির সিন্ডিকেট ঘিরে।

    পরিবহন খাতের নৈরাজ্য বা সড়ক শৃঙ্খলা এত মৃত্যু এত তুমুল প্রতিবাদের পরও ফিরে আসছে না। ঢাকা আজ বসবাস-অনুপযোগী এক মৃত নগরীতে পরিণত। যানজটে স্থবির ঢাকায় নোংরা ময়লা ও মশার উপদ্রবে নগরবাসী পরিবেশ দূষণেরও শিকার হচ্ছেন। জলাবদ্ধতা শুরু হয়েছে। আদালতের রায়কে পরিবহন মালিক সন্ত্রাসী কর্মকা বলে ঔদ্ধত্য দেখাচ্ছেন।

    এলিভেটেড এক্সপ্রেস, ফ্লাইওভারসহ মেগা প্রকল্প নিয়েছে শেখ হাসিনার সরকার। কিন্তু জনবসতিঘন ঢাকা নগরীর মেয়ররা এত সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকেও অকালপ্রয়াত আনিসুল হক কীভাবে আশার আলো জাগিয়েছিলেন তা যেমন খেয়াল করেন না, তেমনি রাজশাহীর মেয়র খায়রুজ্জামান লিটন কীভাবে একটি পরিচ্ছন্ন আধুনিক তিলোত্তমা নগরী গড়ে তুলেছেন, তাও দেখে আসেন না। প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণসহ নানা পদক্ষেপে ঢাকামুখী মানুষের প্রবণতাও কমানো যাচ্ছে না।

    বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মর্যাদা ফিরিয়ে আনতে ইমেরিটাস প্রফেসর আনিসুজ্জামান, ড. এ কে আজাদ চৌধুরী, প্রফেসর জামিলুর রেজা চৌধুরী, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্ত, জাফর ইকবালদের মতো শিক্ষাবিদদের নিয়ে একটি কমিশন গঠন করে তাদের সুপারিশের ভিত্তিতে পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। এখনো শেখ হাসিনার পাশে রাজনীতিতে অভিজ্ঞ প্রবীণ রাজনীতিবিদ আমির হোসেন আমু, ঊনসত্তরের নায়ক মেধাবী ওয়েল কানেকটেড তোফায়েল আহমেদ, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, রাশেদ খান মেনন, মতিয়া চৌধুরী, হাসানুল হক ইনুর মতো নেতারা রয়েছেন। ইতিহাসের তৈরি তোফায়েল আহমেদরা বার বার আসেন না। এদের দক্ষতা-অভিজ্ঞতা-যোগ্যতার বিকল্প নেই। আওয়ামী লীগ থেকে ছিটকে পড়লেও বঙ্গবন্ধুর প্রতি নিঃশর্ত অনুগত একাত্তরের বঙ্গবন্ধুর ডাকে মুক্তিযুদ্ধে রণাঙ্গন কাঁপিয়ে দেওয়া টাইগার সিদ্দিকী খ্যাত বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম শেখ হাসিনার প্রতি বড় বোনের মমত্ববোধ, শ্রদ্ধা-ভালোবাসা হারাননি।

    মাঝেমধ্যে পাশে থাকা নেতাদের নিয়মিত ডেকে পরামর্শ করা, কাজে লাগানো যেমন সম্ভব তেমনি দল ও সরকারের বাইরে থাকা কাদের সিদ্দিকীই নয়, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বরেণ্য আইনজীবী শিক্ষাবিদসহ অবসরে যাওয়া মেধাবী, প্রশাসনিক কাজে অভিজ্ঞ চৌকস ব্যক্তিদের এবং দলকানা নন এমন সব সিনিয়র সাংবাদিক এবং বিশিষ্ট শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী নেতাদের চায়ের দাওয়াত দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নানা বিষয়ে পরামর্শ নিতে পারেন। যেমন করে আলেম-ওলামাদের সঙ্গে তার বৈঠক বিফলে যায়নি, ইতিবাচক ফল এনেছে। তেমনি এদের সঙ্গে বৈঠকও কিছু না কিছু ফল এনে দেবে। লাখো শহীদের রক্তে ও লাখো মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশটা তো আমাদের সবার। দেশের জন্য সবার ভালোবাসা আছে বলেই যখন আমাদের ক্রিকেটাররা বিশ্বকাপজয়ীদের পরাস্ত করে তখন আমরা একসঙ্গে আনন্দে লাফ দিয়ে উঠি। তুমুল করতালি, আনন্দধ্বনি দিই।

    লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন। সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close