• শুক্রবার, ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||

শাবিপ্রবিতে ছাত্র আন্দোলন; কারণ এবং প্রভাব

প্রকাশ:  ২৭ জানুয়ারি ২০২২, ১৮:৫৫
সজীব ওয়াফি
সজীব ওয়াফি

সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে(শাবিপ্রবি) ছাত্র আন্দোলন চলছে বেশ কয়েকদিন হলো। শিক্ষার্থীদের সাথে বেগম সিরাজুন্নেছা চৌধুরী হলের প্রাধ্যক্ষের দুর্ব্যবহার থেকে এই আন্দোলনের সূত্রপাত। ছাত্রদের দাবিদাওয়া খুব একটা বেশি ছিলো না, একেবারেই সামান্য। তারা হলে একটু ভালো থাকা, কোনরকমে খেয়ে বাঁচার জন্য প্রাধ্যক্ষের স্মরণাপন্ন হয়েছিলো। ঘটনাক্রমে হলের দায়িত্বশীল প্রাধ্যক্ষের দুর্ব্যবহার শিক্ষার্থীদের মর্মাহত করে। হল প্রাধ্যক্ষের আচরণে হতাশাগ্রস্ত ছাত্রদের তখন দাবি গিয়ে দাঁড়ায় উক্ত হল প্রাধ্যক্ষ কমিটির পদত্যাগ, দায়িত্বশীল ও ছাত্রীবান্ধব প্রাধ্যক্ষ কমিটি নিয়োগ এবং হলের যাবতীয় অব্যবস্থাপনা নির্মূল করে সুস্থ স্বাভাবিক পরিবেশ নিশ্চিত করা। দাবির তোয়াক্কা না করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ছাত্রদের উপর পুলিশ লেলিয়ে দেয়। গুলি, টিয়ারগ্যাস, সাউন্ড গ্রেনেড এবং লাঠিচার্জে আক্রান্ত হয় ছাত্ররা। অতঃপর তৈরি হয় একদফার দাবি– উপাচার্যের পদত্যাগ।

খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের(কুয়েট) একটি বিভাগের ছাত্ররা স্নাতক বর্ষের শেষ কয়েদি পোশাকে উৎযাপন করে সামনে আসলো। তারা তাদের আয়োজনে শুধুমাত্র কয়েদি পোশাকেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, তারা তাদের খাওয়া থেকে শুরু করে উৎযাপনের সমস্ত পর্যায় জেলখানার দৃশ্য দেখিয়েছে। তারা নজরুলের প্রতিবাদী গানের মাধ্যমে জয়ধ্বনি করেছে। সেখানকার শিক্ষার্থীরা করোনা বিষয় অবতারণা করলেও এই যে প্রতীকি মুক্তির প্রতিবাদ, এর থেকে কি আমাদের অভিভাবক, আমাদের রাষ্ট্রের কর্ণধাররা আলাদা কোন বার্তা পাচ্ছেন? পাচ্ছেন কিনা জানি না, তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন ডাইনিং টেবিলে খাবার সামনে নিয়ে সব সময়ে ভাবতাম এই জেলখানা থেকে কবে মুক্তি মিলবে! শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাও সেই সমস্যাগুলো সমাধান করার জন্য সামনে এসেছিলো। যে সমস্যাগুলো নিজ থেকেই সমাধান করা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের একান্ত দায়িত্ব এবং কর্তব্য। অথচ সমস্যার তো কোন সুরাহ করলেনই না, বরং ছাত্ররা যখন বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্যের কাছে গিয়ে ক্ষোভে ফেটে পরলেন তখন তাদের উপর পুলিশি আক্রমণের নির্দেশ দেন। ছাত্রদের বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে ঠেলে দিয়ে নিয়ে আসা হলো রায়টকার–জলকামান। ছাত্রদের দমনে প্রস্তুত রাখা হয়— র‌্যাব, পুলিশ এবং সোয়াট টিমসহ একাধিক বাহিনী। শিক্ষার্থীদের রক্তাক্ত করে আবার সেই শিক্ষার্থীদের নামেই দেওয়া হয়েছে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের মামলা। এতোকিছুর ভিতরে দাড়িয়েও ছাত্ররা প্রতিবাদ করছে; শাহজালালের মাটি কামড়ে ধরে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়েছে, আমরণ অনশন করেছে। শিক্ষার্থীরা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমানে কর্মরত তেমন কোন শিক্ষক তাদের ন্যায্যতার পক্ষে দাঁড়ায়নি। বিপত্তি ঘটেছে– শিক্ষকরা ছাত্রদের পাশে না দাড়ালেও, পরোক্ষভাবে যৌক্তিক আন্দোলনের বিপক্ষে দাড়িয়েছেন; বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে মানববন্ধনে দাড়িয়ে বক্তব্য দেওয়ার সময়ে একজন শিক্ষিকা 'চাষাভুষা' বলে অপমানিত করেছেন স্বয়ং কৃষকদের। অথচ নারীদের নিয়ে উপাচার্য মহোদয়ের কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য প্রকাশিত হলেও প্রতিবাদ সভায় শিক্ষকরা ছিলেন প্রতিবাদহীন।

সম্পর্কিত খবর

    ১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশ স্বাধীন হয়েছে। তার আগে আমরা ছিলাম ব্রিটিশদের উপনিবেশিক শাসনের অন্তর্গত। দুই'শ বছরের বৃটিশ শাসনামলে ব্রিটিশ শাসকেরা তৈরি করেছিলো জমিদারি কুপ্রথা। খাজনা আদায়ে কৃষকদের উপর নামে বেনামে চলতো অত্যাচার-অবিচার। নীলকরদের নির্যাতনের ইতিহাস সকলেরই জানা। এই জমিদার শ্রেণী কৃষকের ঘরের নারীকেও রক্ষা দেয়নি, ধরে নিয়ে নির্যাতন করেছে যখন খুশি তখন। কৃষককে তারা উপহাস করতো; ফেটে পরতো অট্টহাসিতে। অন্যদিকে পরাধীন ভূমিতে নৃ-তাত্বিকগতভাবে আমাদের পূর্ব পুরুষ সকলেই কৃষির সাথে জড়িত। এমনকি বর্তমানে বাংলাদেশের ৮০ ভাগেরও বেশি মানুষ কৃষি কাজ করেন। জিডিপির অন্যতম মাধ্যম হচ্ছেও এই কৃষি সেক্টর। কৃষকেরা সন্তান লালন-পালনের মতো পরম যত্নে ফসল উৎপাদন করেন। নানান প্রক্রিয়ায় সেই ফসল পৌছায় দূরের শহরে, যা ভোগ করে টিকে আছেন আমাদের শহুরে কথিত শিক্ষিত ভদ্র সমাজ। সেই কৃষকদের উৎপাদিত ফসল খেয়ে, তাদের চাষাভুষা বলতে আমাদের এতো দম্ভ!

    দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক, ছাত্র এবং শিক্ষাকে আদর্শ মানদণ্ড ধরা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বা ছাত্র শুনলে তাদের প্রতি সাধারণ মানুষের আলাদা সমীহ-সম্মান থাকে। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে ছাত্র শিক্ষকের ভিতরে নেই বন্ধুসুলভ আচরণ, গবেষণা তো নামমাত্র। উপরন্তু শিক্ষার মান গিয়ে ঠেকেছে একেবারে তলানিতে, শূন্যের কোঠায়। ছাত্ররা যেন শিক্ষকদের কাছে অচ্ছুৎ। ছাত্রদের থেকে দূরে থাকতে তারা ব্যবহার করবেন আলাদা বাস, আলাদা লিফট, আলাদা টয়লেট। ছাত্রদের সাথে এক ক্যান্টিনে বসে খেতেও তাদের অনিহা। বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর ভিতরে তৈরি করা হয়েছে অলিখিত জমিদার-প্রজার সম্পর্ক। প্রজাদের খাওয়ার জন্য এক থালা ভাতের ভেতরে গোটা চারেক কাঁকড় পাওয়াই যেন স্বাভাবিক, তারা যে ডাল খাবে ওটা বুড়িগঙ্গার পঁচা পানি। এসকল সমস্যার সমাধানে ব্যতিক্রমী দু'একজন প্রাধ্যক্ষ ছাড়া কেউ কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন না। জমিদার প্রজার এই সম্পর্ক চর্চার পরিণামেই কৃষকদের চাষাভুষা বলে আঘাত করতে আমাদের শিক্ষকদের একটুও লাগেনি। অধঃপতন এতোটাই গুরুতর হয়েছে যে এ সকল শিক্ষকবৃন্দই টাকার বিনিময়ে বিক্রি হয়ে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিতে যান। নগদ টাকার বিনিময়ে ক্লাস নিতে গিয়ে নিজ প্রতিষ্ঠানের মতো ছাত্র-শিক্ষকের দূরত্ব তৈরীর কৃত্রিম নিয়মকানুনের তখন আর বালাই রাখেন না। তারা ভুলে যান তিনি আসলে কোন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক।

    শাবিপ্রবির শিক্ষিকা বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেছেন, 'আমরা চাষাভুষা নই যে আমাদের যা খুশি তাই বলবে'। তার মতে এর অর্থ দাড়ায় নিম্নশ্রেণীর চাষাভুষা বলে যাদের অবজ্ঞা করেছেন তাদের যা খুশি তাই বলা যাবে। সত্যি বলতে আন্দোলনকারী ছাত্ররা গুরুতর এমন কিছু বলেন নাই যার জন্য তাদের মর্যাদা ক্ষুন্ন হয়েছে এবং সেই মর্যাদা ক্ষুন্নের কারণে আন্দোলনকারী ছাত্রদের বিরুদ্ধে মানববন্ধন করেছেন। বরঞ্চ তাদের মর্যাদা ক্ষুন্ন হওয়ার কথা ছিলো শুরু থেকেই ছাত্রদের ন্যায্য দাবির আন্দোলনে সংহতি প্রকাশ না করায়। যে কৃষকদের চাষাভুষা বলে অভিহিত করেছে, চাষাভুষা বলে গালি দিয়েছেন; মনে রাখা দরকার সেই কৃষকদের ঘাম ঝরানো ট্যাক্সের পয়সায় তাদের বেতন হয়। কৃষকেরা বা ছাত্ররা কি এই ধরনের শিক্ষকদের প্রজা? চাষাভুষা'তে যদি তার এতোই আপত্তি তবে কৃষদের ঘাম ঝরানো ফসল কেন তিনি ভোগ করবেন? কৃষকের ট্যাক্সের পয়সায় বেতন দিয়ে তাকে এখনো কেন শিক্ষকতা পেশায় বহাল রাখা হবে? অভিভাবকদের বলি— একজন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়ার থেকে দেশের জন্য অনেক আশা করেন; কিন্তু পুষ্টিহীন কাঁকড়যুক্ত খাবার খেয়ে, বিদঘুটে গণরুম ও হলে থাকা এবং পড়াশুনার বিরূপ পরিবেশের প্রতি আপনারা কেন কথা বলছেন না! কথা যদি নাই বলবেন, তবে আধপেটা পঁচা-বাসী খেয়ে কোন রকমে বেঁচে থাকাদের নিয়ে বড় বড় আশা কেন করবেন!

    শাবিপ্রবিতে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন হচ্ছিলো, হামলা-মামলা করে ছাত্রদের ঠেলে দেওয়া হয়েছে অনশনের দিকে। সারাদেশের সাধারন মানুষের সমর্থন এই আন্দোলনকারীরা পেয়েছে। শাবিপ্রবির বরেণ্য অধ্যাপক ড. জাফর ইকবালের আশ্বাসে ছাত্ররা হয়তো জীবন বিপন্নকারী অনশন কর্মসূচির পথ থেকে সরে এসেছেন, কিন্তু দাবি থেকে একচুলও নড়েননি। এই আন্দোলনের পথ ধরেই অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের দিশা খুঁজতে থাকবে। আমরা চাষাভুষা'র পরিবার থেকে উঠে এসেছি। চাষাভুষারা আমাদের গর্বের জায়গা। শিক্ষায় ছাত্রদের প্রতি ভর্তুকি কোন খরচ নয়, এটা দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ; বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের খাবারে এবং আবাসনে ভর্তুকি দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান। শাবিপ্রবি'র ছাত্রদের দাবি মেনে নিয়ে সুষ্ঠু সমাধান জরুরি। এদেশে হাজারো শিক্ষিত চাষাভুষা তৈরি হোক। তবেই কৃষিতে উল্লেখযোগ্য বিপ্লব ঘটবে। সকলের বোধদয় কাম্য।

    লেখক: রাজনৈতিক কর্মী ও প্রাবন্ধিক

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close