• শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

পীর হাবিবুর রহমান: জল-জোছনার অসমাপ্ত ‘নক্ষত্র পুরুষ’

প্রকাশ:  ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ২৩:০৫ | আপডেট : ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ২৩:০৭
উৎপল দাস

সময়টা ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহ। প্রথমবার সাংবাদিক পীর হাবিবুর রহমানের মুখোমুখি হলাম। পূর্বপশ্চিমবিডি.কমে একজন রাজনৈতিক প্রতিবেদক প্রয়োজন ছিল। এর আগে কোনোদিন রাজনৈতিক রিপোর্টিং না করলেও পূর্বপশ্চিমের বিপুল হাসান ভাই বললেন, পীর হাবিবুর রহমান ভাই যাকে আমরা পীর হাবিব ভাই বলেই জানি; তার সাথে দেখা করতে। আমি যথাসময়ে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় পূর্বপশ্চিমের কর্পোরেট অফিসে সিভি নিয়ে হাজির। এরপর সাক্ষাতকারে প্রথম প্রশ্নই আওয়ামী লীগের সম্মেলন সামনে, কোন কোন জাতীয় নেতার সাথে পরিচয় আছে? দুইজনের সাথে কথা বলে একটা নিউজ রেডি করে নিয়ে আসো। শর্ত হচ্ছে তার সামনে বসেই নেতাদের ফোন দিতে হবে। আমি প্রথমে আওয়ামী লীগের তৎকালীন আন্তজার্তিক বিষয়ক সম্পাদক ও বর্তমানে প্রেসিডিয়াম সদস্য লে. কর্ণেল (অব.) ফারুক খান ভাইকে কল দিলে তিনি এক ফোনেই কলটি ধরেন এবং প্রায় ৪ মিনিট কথা বলেন। তারপর পীর হাবিব ভাই বললেন, যাও নিউজ টা লিখে দাও। প্রায় দেড় ঘন্টা পর নিউজ প্রিন্ট করে নিয়ে তার টেবিলে গেলে কয়েকটি লাইন এডিট করে বিপুল হাসান ভাইকে নিউজটা পাঠাতে বলেন। চাকরি হওয়ার আগেই আমার নামে পূর্বপশ্চিমে নিউজ উঠে গেল। নিউজ হওয়ার পর বললেন, মন দিয়ে কাজ করবে, কত টাকা বেতন চাও? আমি মুখ দিয়ে বললাম, আগের প্রতিষ্ঠানে ১৮ হাজার ৭৪০ টাকা পেতাম, আপনি ২০ হাজার টাকা দিলে মন দিয়ে কাজ করবো। প্রশাসনিক কর্মকর্তা শরীফ ভাইকে আমার সিভিটা দিয়ে বললেন, নিয়োগপত্র তৈরি করতে। ১০ মিনিট পরই নিয়োগপত্র নিয়ে বার্তা অফিসে চলে এলাম।

এই ছিল পীর হাবিবুর রহমান ভাইয়ের সঙ্গে আমার পথচলার শুরু। এরপর কর্মস্থলের সম্পর্কের বাইরেও পিতা-পুত্রের মতো একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। পীর ভাই তখন মাঝে মধ্যেই আমাকে ন্যাম ভবনে ডাকতেন। এমনকি তার ছোট ভাই পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ ভাইয়ের জন্য বরাদ্দকৃত সেই ফ্ল্যাটে আমার জন্য একটি রুমও বরাদ্দ ছিল। হাওরের মাছ আর ভর্তা দিয়ে দারুণ খাওয়া দাওয়ার পর সেখানে বসে বসে তিনি ডিকটেশন দিতেন আর আমি লিখতাম। বাংলাদেশ প্রতিদিন ছেড়ে আসলেও প্রতি মঙ্গলবার তার একটি কলাম সেখানে ছাপা হতো। সমসাময়িক নানা বিষয় নিয়ে তিনি বলতেন, আর আমি ল্যাপটপে লিখতাম। একটা সময় এমন হয়েছিল পীর ভাই একটা লাইন বলার পর কি বলবেন, সেটা আমি আগেই লিখে বসে থাকতাম। তার লেখায় সুনামগঞ্জের হাওর এবং জল জোছনার প্রসঙ্গ আসলেই আমি হুবুবু তিনি বলার আগেই লিখে ফেলতাম। রাজনৈতিক অনেক কলাম লিখতে গিয়ে আমি প্রতিবার অবাক হয়েছি, কোনো একটি ঘটনার দিন তারিখ তিনি সুস্পষ্টভাবে মনে রাখতে পারতেন। তিনি ছিলেন আমার কাছে জীবন্ত এক এনসাইক্লোপিডিয়া।

একটা সময় আমাদের পূর্বপশ্চিমের অফিস মতিঝিলে নিয়ে আসা হয়। পীর ভাই কাউকে কিছু না বলেই একদিন অফিসে আসলেন। তখন আমি টেলিফোনে একজন সংসদ সদস্যের সঙ্গে নিউজের বিষয়ে কমেন্ট নিচ্ছিলাম। আমি যখন সেই এমপিকে বলছিলাম, আপনার ছেলে তো নারী পুলিশের সঙ্গে হোটেলে ধরা খাইছে, খবর টা কতটুকু সত্য? তখন পাশে দাঁড়িয়ে পীর হাবিব ভাই হাসতে হাসতে শেষ। একজন এমপি যিনি বর্তমানে মন্ত্রীও তাকে তুই এভাবে বললি কেন? আমার সোজা উত্তর, উনার ছেলে ধরা খাইছে, আমি তো তাই বলেছি। ওই নিউজ আপ করার পর পীর ভাইয়ের গাড়িতে করে এক জায়গায় যাচ্ছিলাম। তখন প্রতিবেশী রাষ্ট্রের হাই কমিশনের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ফোন করে পীর ভাইকে অনুরোধ করলেন, নিউজটি সরিয়ে দেয়ার জন্য। উত্তর দিয়ে ওই কর্মকর্তাকে বলেছিলেন, আমার উৎপল দাস জেনেই লিখেছে। এটা সরানো যাবে না।

এরপর বড় কোনো ঘটনা ঘটলেই দেশের বিভিন্ন জেলায় নিয়মিত পাঠাতেন পীর হাবিবুর রহমান ভাই। সরেজমিনে রিপোটিং করার আনন্দই অনেক। তিনি নিজের পকেট থেকে ওইসময় আলাদা করে খরচ দিতেন। ভালো হোটেল, খাবার সব কিছুর বিষয়ে নিয়মিত খবর রাখতেন। বগুড়ার আলোচিত মা-মেয়েকে মাথা ন্যাড়া করে ধর্ষণের ঘটনার পর আমি দেখেছি, কিভাবে তিনি একজন রিপোর্টারের সাথে যোগাযোগ রাখেন।

নিউজের ক্ষেত্রে স্কুপ এবং ঝুঁকিপূর্ণ নিউজ করাতেও ভয় পেতেন না। প্রায় সময়ই বলতেন, সাংবাদিকতাই তার ধ্যান ও জ্ঞান। আর কাজকে তিনি ইবাদতই মানতেন। পূর্বপশ্চিম ছেড়ে এসেছি ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে। ২০১৭ সালে অক্টোবর মাসে আমি ৭০ দিনের জন্য হারিয়ে যাই। সেই সময়টাতে তিনি আমার জন্য কতটা আকুলতা দেখিয়েছেন তা বাংলাদেশের সাংবাদিক সমাজের সবাই জানেন। দেশে বিদেশে তিনি আমার জন্য অনেক করেছেন। ২০১৭ সালের ১৯ ডিসেম্বর ফিরে আসার রাতে পীর হাবিব ভাই লিখেছিলেন, বুকের ওপর থেকে পাথরটা নেমে গেছে। পূর্বপশ্চিমের চাকরি ছাড়ার পরও নিয়মিত ন্যাম ভবনে আমার ডাক পরতো। পীর ভাই আমার বর্তমান কর্মস্থল ভোরের পাতার সম্পাদক ড. কাজী এরতেজা হাসান ভাইকে প্রায়ই ফোন করে বলতেন, উৎপলকে দুইদিনের জন্য আমার কাছে দিয়ে দেন। আমিও চলে যেতাম, তখন পীর ভাই ডিকটেশন দিতেন আর আমি লিখে যেতাম।

পীর হাবিবুর রহমান ভাইয়ের লেখা সর্বশেষ উপন্যাস ‘জেনারেলের কালো সুন্দরীরা’ বইটি লেখার সময় আমাদের দুর্দান্ত সময় কেটেছে। অসাধারণ রসবোধ নিয়ে বইয়ের প্রতিটি চরিত্রকে বর্ণনা করেছেন। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো লেখেই গেছি। পীর ভাই মাঝে মধ্যে আমার ‍ওপর খুব ক্ষিপ্ত হতেন। মাস শেষে বেতন পাওয়ার পর আমি তিন থেকে চারদিনের জন্য ঘুরতে চলে যেতাম। তখন মোবাইল বন্ধ করেই রাখতাম। পরে ফিরে আসলে বলতেন, তোর ফাতরামি আর গেল না।

এভাবে আর কেউ কোনোদিন আমাকে ধমক দিয়ে বলবি না, উৎপল তোর ফাতরামি আর গেল না। সুনামগঞ্জের জল জোছনায় বেড়ে উঠা আমার রাজনৈতিক রিপোটিংয়ের গুরু পীর হাবিবুর রহমান ভাইয়ের খুব ইচ্ছে ছিল আমাকে নিয়ে হাওরে যাবেন। আমরা একসাথে হাওর দেখতে যেতে পারিনি। আরো দুইটা বই লেখার ইচ্ছে ছিল তার। সবচে মূল্যবান একটি বই হতো- বাংলাদেশের রাজনীতির অন্দরে বাহিরে। এই বইটি আমাদের সুনামগঞ্জে গিয়েই লেখার কথা ছিল। ভারতে চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরে আমাকে এমনটাই জানিয়েছিলেন। আর দেখা হলো না আমার পরম শ্রদ্ধেয় পীর হাবিবুর রহমান ভাই। আপনি আমার কাছে জল-জোছনার অসমাপ্ত ‘নক্ষত্র পুরুষ ’ হিসাবেই আমৃত্যু বেঁচে থাকবেন শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায়। ওপারে ভালো থাকবেন পীর ভাই।

লেখক: সাংবাদিক পীর হাবিবুর রহমানের স্নেহধন্য শিষ্য এবং বিশেষ প্রতিনিধি, দৈনিক ভোরের পাতা

পীর হাবিবুর রহমান
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close