• শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

কাজী আরেফ আহমেদের সজ্ঞা ও প্রজ্ঞা

প্রকাশ:  ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০১:৪৮ | আপডেট : ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৬:৩৫
জিয়াউল হক মু্ক্তা

স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার গোপন রাজনৈতিক-সাংগঠনিক প্রক্রিয়া 'স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ' বা 'স্বাধীনতার নিউক্লিয়াস' বা 'নিউক্লিয়াস' প্রথম দিকে ছিল তিন জনের একটি ফোরাম; এটি গঠন করেন সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমেদ। এর গঠন প্রক্রিয়ায় সিরাজুল আলম খান প্রথমে দলে ভেড়ান আব্দুর রাজ্জাককে; পরে সিরাজুল আলম খান আব্দুর রাজ্জাকের সাথে পরামর্শক্রমে ঐকমত্যের ভিত্তিতে সাথে নেন কাজী আরেফ আহমেদকে। উল্লেখ্য, এখানে এঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন স্বতঃপ্রণোদিত স্বাধীনতা-সংগ্রামী; এঁদেরকে কাউকে কারোর বোঝাতে হয়নি কেন স্বাধীনতা দরকার। ইতিহাসের ইচ্ছানিরপেক্ষ প্রক্রিয়ায় আবহমান সময় এঁদের জন্ম দিয়েছেন বাংলার মানুষের মুক্তির আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে। এঁরা ছিলেন আমাদের ভূমির রেভ্যুলুশনারি ক্রিয়েটিভ জিনিয়াস— যাঁরা রেভ্যুলুশনারি মাসকে নির্দেশনা দিয়েছেন ইতিহাসে মানুষের জয়যাত্রা এগিয়ে নিতে। আমাদের স্বাধীনতার আন্দোলন তো সারা দুনিয়ার সকল মানুষের মুক্তি আন্দোলনেরই একটি আঞ্চলিক সংস্করণমাত্র— বাঙালি জাতীয়তাবাদের যা অন্যতম প্রধান উপাদানও বটে। যদিও এ দেশের আঠারো ও উনিশ শতকের লেজওয়ালা কম্যুনিস্টদের মস্তিষ্ক এটা উপলব্ধি করার মতো ততোটা বিকশিত হয়ে ওঠেনি তখনও পর্যন্ত।

১৯৬২ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরে গঠিত নিউক্লিয়াস পরে আরও দু'জনকে অন্তর্ভুক্ত করে: একজন আবুল কালাম আযাদ [১৯৬৪] ও অপরজন চট্টগ্রামের আব্দুল মান্নান [১৯৬৫]। পরে আর আবুল কালাম আযাদ নিউক্লিয়াসের কজ ও কাজের প্রতি আনুগত্য বহাল রেখে সাংগঠনিক প্রক্রিয়া থেকে অব্যাহতি নেন নিজের পারিবার-সদস্যদের সহযোগিতা করার লক্ষ্যে আয়রোজগারে যুক্ত হতে। উল্লেখ্য, নিউক্লিয়াসের সদস্যদের কোন সার্বক্ষণিক পেশায় যুক্ত হওয়া আর প্রেম-ভালোবাসা-বিয়ে ও পারিবারিক দায়বদ্ধতায় জড়ানো ছিল নিষিদ্ধ। নিউক্লিয়াস আব্দুল মান্নানকে অব্যাহতি দেয় তাঁর কাজের ধীরগতি ও অনিয়মিত যোগাযোগের জন্য।

সম্পর্কিত খবর

    উল্লেখ্য, আবুল কালাম আযাদ ছিলেন এমন এক তরুণ, যিনি দারিদ্র্যের তীব্র কষাঘাতে মাত্র সাত বছর বয়সে গৃহত্যাগ করে জন্মস্থান নোয়াখালি থেকে অভিবাসী হন অনেক দূরের যশোরে অন্যের বাড়িতে রাখালবৃত্তি করে নিজের খাওয়াদাওয়া নিশ্চিত করতে ও পড়াশোনা চালিয়ে যেতে। নবম শ্রেণি পর্যন্ত তিনি কোনোদিন পাঠ্য বই কিনতে পারেননি; এ সময় তিনি রাখালবৃত্তি ছেড়ে টিউশনি শুরু করেন এবং তা অব্যাহত রাখেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষে শিক্ষকতায় যুক্ত হবার আগ পর্যন্ত। ১৯৬২ সালে তিনি প্রবেশিকা পাশ করেন, এবং এ সময়ই তিনি বৃহত্তর যশোর-খুলনা জেলায় শিক্ষা আন্দোলন সংগঠিত করে ছাত্রলীগের ব্যাপকভিত্তি দেন। ১৯৬৪ সালে তিনি ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ে সমাজ বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন ও নিউক্লিয়াসভুক্ত হন। তিনি বারবার কারাবরণ করেছেন, এবং আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে বহু লোমহর্ষক প্রত্যক্ষযুদ্ধের সামরিক নেতৃত্ব দিয়েছেন। স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা আন্দোলন, প্রাথমিক শিক্ষার জাতীয়করণ ও শিক্ষকদের দাবিদাওয়া অর্জনের একচ্ছত্র নেতৃত্ব অর্জন করেন ও সেসব দাবি আদায়ে সফল হন। স্মর্তব্য, ১৯৮১ থেকে ১৯৮৪ সালকালপর্বে জাসদ তাঁর নেতৃত্বাধীন শিক্ষা ও শিক্ষক আন্দোলনকে নিরঙ্কুশ সমর্থন ও সহযোগিতা প্রদান করে।

    পরবর্তী জীবনে আবুল কালাম আযাদ যেহেতু কোন রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত ছিলেন না, তাই তাঁকে স্মরণ করার কেউ নেই। সেজন্যই, কাজী আরেফ আহমেদ সম্পর্কে লিখতে গিয়ে তাঁর প্রসঙ্গ এল বলে— সুযোগের সদ্ব্যবহার করে তাঁর সম্পর্কে কিছুটা জানিয়ে রাখছি। এ মহান জাতীয় বীরকে ভুলে গেলে আমাদের জাতীয় মুক্তির আন্দোলনের কন্টেন্ট ও এসেন্স আমরা বুঝতে পারবো না।

    আবুল কালাম আযাদের অনন্য কীর্তির একটি হলো, ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা ঘোষণার আগেই, ১৯৬৫ সালের নভেম্বরে সিরাজুল আলম খানের নির্দেশে তিনি পূর্ব-বাংলার সাথে পশ্চিম পাকিস্তানের আঞ্চলিক বৈষম্যের ওপর একটি গবেষণা প্রবন্ধ রচনা করেন; এ প্রবন্ধটি ছাত্রলীগের বর্ধিত সভায় আলোচিত হয়; মূল প্রবন্ধ ও ছাত্রলীগের বর্ধিত সভার আলোচনার ভিত্তিতে এ বিষয়ে একটি পুস্তিকাও রচিত হয়; ছাত্রলীগের তখনকার সভাপতি সৈয়দ মাজহারুল হক বাকী ও সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাকের ভূমিকাসহ এ পুস্তিকা সারা পূর্ববাংলায় প্রচারিত হয়। এর ফলে পরে ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু ৬ দফা ঘোষণা করলে তা সাথে সাথে পূর্ব বাংলা ও পাকিস্তানের আঞ্চলিক বৈষম্য বিষয়ে জ্ঞাত ছাত্রলীগের কাছে বাঙালির ম্যাগনাকার্টা বা অধিকারের সনদ হিসেবে গৃহীত হয়।

    ১৯৬৬ সালের বঙ্গবন্ধু ৬ দফা ঘোষণার পর আওয়ামী লীগসহ কোন রাজনৈতিক দল একে সমর্থন করেনি। কাজী আরেফ আহমেদ ছাত্রলীগ ঢাকা মহানগরের সে সময়ের সভাপতি হিসেবে নিউক্লিয়াসের সিদ্ধান্তে ৬ দফার পক্ষে সর্বপ্রথম বিবৃতি দেন; তিনি হলেন ৬ প্রথম সমর্থক। নিউক্লিয়াসের নিয়ন্ত্রণাধীন ছাত্রলীগ ছিল সর্বপ্রথম সংগঠন যা ৬ দফাকে সমর্থন করে রাজনৈতিক অবস্থান নেয়। নিউক্লিয়াসপন্থি এমএ আজিজের নেতৃত্বাধীন চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ ১৩ ফেব্রুয়ারি ৬ দফার পক্ষে বিবৃতি প্রদান করে। এটা ভুলে গেলে চলবে না যে— এ ৬ দফা নিয়ে বিরোধের ফলে আওয়ামী লীগ বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল; ৬ দফাপন্থি আওয়ামী লীগ আর পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট বা পিডিএম-এর ৮ দফাপন্থি আওয়ামী লীগের জন্ম হয়েছিল।

    এখানে মাঝখানে একটু বিনোদনের জন্য একটি বিশেষ বিষয়ের দিকে তাকানো যাক। কাজী আরেফ আহমেদ ছাত্রলীগের স্বাধীনতাপন্থিদের সাথে অন্যান্য দল-মতের কোন ধরনের গুন্ডামি সহ্য করতেন না; তিনি নিজে গুন্ডা ধরনের ব্যক্তি ছিলেন না, কেননা গুন্ডারা সবসময় এক্সপোজড হয়ে যায় এবং যা তাঁর [কাজী আরেফ আহমেদ-এর] চরিত্র ও কাজের ধরনের বিরোধী; তিনি ছিলেন নিজেকে এক্সপোজ করার ঘোর বিরোধী এবং তিনি চলাফেরা করতেন ভীষণ সন্তর্পনে। কলেজের ছাত্র থাকা অবস্থায় তিনি নিজে ছাত্রলীগের স্বাধীনতাপন্থি অংশের নিরাপত্তার বিষয়টি দেখভাল করতেন; আর পরবর্তীকালে তিনি লালন-পালন করেছেন সেসব নিবেদিতপ্রাণ সাহসী তরুণদের যারা ছাত্রলীগের স্বাধীনতাপন্থিদেরকে এনএসএফ ও ছাত্র ইউনিয়নের আক্রমণ থেকে রক্ষা করতেন, প্রয়োজনে কাউন্টার-অ্যাটাক করতেন।

    ৬ দফা ঘোষণার পর আবুল কালাম আযাদ আবারও সিরাজুল আলম খান ও নিউক্লিয়াসের নির্দেশে রচনা করেন মুক্তিপাগল তরুণদের জন্য আবেগময় এক বই: সংগ্রামী বাঙলা। 'সংগ্রামী বাঙলা'য় বাংলার ঐতিহাসিক ঐতিহ্য তুলে ধরার পাশাপাশি— শেষ অধ্যায়ের আগের অধ্যায়ে ৬ দফা ব্যাখ্যা করা হয় ও ১৯৬৬-র ৭ জুনের হরতালের ওপর আলোকপাত করা হয়; আর শেষ অধ্যায়ে দেড় পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুকে 'বাংলার নেতা' হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। এতে আবেগময় ভাষায় বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বলা হয়, "শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর শৈশব গ্রাম-বাংলার বুকেই কাটান। তিনি এদেশের মাটির মানুষ। সকালে পান্তা খেয়ে স্কুলে যাওয়া, ছুটির দিনে মাঠে ও নদীর ধারে ঘুরে বেড়ানো আর মাছ ধরা ছিল তাঁর অন্যতম প্রিয় শখ। বাংলার ধূলিকণা আর ঝড়-ঝঞ্ঝায় প্রস্তুত হয়েছে মুজিবের অনু-পরমানু। তিনি বাংলার মাটির মানুষ। গ্রাম-বাংলার সাধারণ মানুষ। বাংলার নেতা।" তবে এ বইয়ের এমনকি বাংলাদেশ সংস্করণেও কেন বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ১৯২০ সালের ১৭ এপ্রিলের পরিবর্তে ১৯২২ সালের ২২ নভেম্বর লেখা রয়েছে তা রহস্যজনক বৈকি! হতে পারে এটা সার্টিফিকেটে দেয়া জন্ম তারিখ।

    সিরাজুল আলম খানের নির্দেশে ১৯৬৭ সালের ফ্রেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত এ বইয়ের প্রকাশক ছিলেন তোফায়েল আহমদ। এপ্রিলে পাকিস্তান সরকার বইটি নিষিদ্ধ করে; কিন্তু ছাত্রলীগ এর প্রচার-প্রচারণা ও ব্যবহার অব্যাহত রাখে। সারা জীবন সিরাজুল আলম খানকে গুরু মেনে অসংখ্য বক্তৃতা দেয়া তোফায়েল আহমদ সম্প্রতি বিশেষ মহলকে খুশি করে কিছু প্রাপ্তিযোগের আশায় সিরাজুল আলম খানের বিরুদ্ধে অশালীন ও স্ববিরোধী বক্তব্য রেখেছেন— যা খুবই দুঃখজনক। সে যাক। বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রত্যেক গবেষক-পাঠককে মনে রাখতে হবে— তৎকালে বিরাজমান কোন লেখক-বুদ্ধিজীবীর রচনা নয়— ১৯৬৫ সালের নভেম্বরে আবুল কালাম আযাদ ও নিউক্লিয়াস/ছাত্রলীগের প্রযোজনায় আঞ্চলিক বৈষম্য বিষয়ক প্রবন্ধ ও পুস্তিকা, ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারিতে বঙ্গবন্ধু-ঘোষিত ছয় দফা ও ১৯৬৭ সালে আবুল কালাম আযাদের বই 'সংগ্রামী বাঙলা' ছিল বাঙালির নিজস্ব নির্ধারক রাজনৈতিক-সাহিত্য যা স্বাধীনতা সংগ্রামকে শাণিত করেছিল। সে যাক। ফেরা যাক মূল প্রসঙ্গে।

    ৬ দফার পক্ষে সক্রিয় অবস্থান নেয়া সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক ও আবুল কালাম আযাদ ১৯৬৪—১৯৬৫ সময়কালে জেলে অন্তরীণ থাকায় কাজী আরেফ আহমেদকে শুধু ঢাকা মহানগর নয়, বরং সারা দেশে নিউক্লিয়াসের সাংগঠনিক কাজের দেখভাল করতে হয়; অবশ্য এ সময় তিনি কারাগরে অন্তরীণ সিরাজুল আলম খানের সাথেও কিছুটা যোগাযোগ রাখতেন। নিউক্লিয়াসের উল্লিখিত তিন জন জেলে থাকার পরও কাজী আরেফ আহমেদের একক নেতৃত্বে কেবলমাত্র ঢাকাতেই নিউক্লিয়াসের অনুসারীর সংখ্যা চার/পাঁচ শ'তে উন্নীত হয়; বর্ণিত তিন জন জেলে যাবার আগে সারা পূর্ব বাংলায় নিউক্লিয়াসের অনুসারীর সংখ্যা ছিল তিন শত আর ঢাকায় তা ছিল দুই শত।

    পরে আব্দুল মান্নানের অব্যাহতি ও আবুল কালাম আযাদের কাঠামোগত বিযুক্তির ফলে ১৯৬৯ সালের সূচনায় নিউক্লিয়াস আবার সেই প্রতিষ্ঠাকালীন তিন সদস্যের কেন্দ্রীয় কাঠামোয় পরিণত হয়। শুরু থেকেই এ কেন্দ্রীয় কাঠামোর সদস্যদের কাজের কঠোর শ্রেণিবিভাজন না থাকলেও, কাজী আরেফ আহমেদের প্রধান দায়িত্ব ছিল ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের দেখভাল করা। স্বাধীনতা-পূর্বকালের কাজী আরেফ আহমেদের— স্বভাবগতভাবে যিনি ছিলেন অর্ন্তমুখি— ব্যক্তি-চরিত্রের প্রধানতম শক্তি ছিল তাঁর তীব্র তীক্ষ্ন ইনট্যুইশন বা সজ্ঞা। সিরাজুল আলম খান সম্প্রতি প্রকাশিত তাঁর জীবনালেখ্যে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ঘুরে ফিরে বারবার কাজী আরেফের এই সজ্ঞা বা ইনট্যুইশন ও এর ঐতিহাসিক উপযোগিতার আবশ্যিকতার স্বীকৃতি দিয়েছেন।

    সিরাজুল আলম খান বলেছেন যে ১৯৬২-র শেষ দিকে "... খুবই তীক্ষ্ণবুদ্ধিসম্পন্ন অথচ স্বল্পভাষী এক তরুণ কাজী আরেফ আহমেদের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। সে তখন জগন্নাথ কলেজের ছাত্র। মাত্র আইএ পাশ করে বিএ ক্লাসে ভর্তি হয়েছে। আরেফের মধ্যে ঘটনার ভেতরে না থেকেও আড়াল-অন্তরাল থেকে ঘটনা পর্যবেক্ষণ, পরিকল্পনা ও কাজ করার যোগ্যতাসম্পন্ন একজন তরুণকে খুঁজে পেলাম। সাধারণ আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে আমরা একে অপরের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠি।"

    কাজী আরেফ আহমেদের সজ্ঞা বা ইনট্যুইশন সম্পর্কে তিনি আরও বলছেন, "প্রাথমিকভাবে দেখলাম ছাত্র হিসেবে অতি মেধাবী না হলেও কাজ করার যে দক্ষতা এবং শৃঙ্খলা ও নিপুণতা আরেফের আছে তা এর আগে আমি আর কারো মধ্যে দেখিনি। আমরা দুইজন যখন আলাপ করতাম অনেক সময় প্রাথমিকভাবে দ্বিমত করলেও সিদ্ধান্তের পর মুহূর্তে সিদ্ধান্তের আগের দ্বিমতকে সম্পূর্ণ ভুলে গিয়ে সিদ্ধান্তভিত্তিক কাজ করার মানুষও আমি এর আগে পাইনি। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে অনেককে সে সন্দেহের চোখে দেখতো। এটা ছিল তার স্বভাবজাত।"

    তাঁর এ সজ্ঞা বা ইনট্যুইশনের বিষয়টি আমরা একাত্তর-পরবর্তী প্রজন্মের যারা তাঁর সাহচর্য পেয়েছি, তারাও কিছুটা জেনেছি ও উপলব্ধি করেছি। তাঁর এ সজ্ঞা বা ইনট্যুইশন তাঁর চারিত্র্যবৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠেছিল তাঁর অন্য একটি স্বভাবের কারণে— সেটা হলো তাঁর বস্তুনিষ্ঠ বিচার-বিশ্লেষণের ক্ষমতা। এ বিষয়ে আবারও সিরাজুল আলম খানের দ্বারস্থ হওয়া যেতে পারে; তিনি বলেছেন, "দেখেছি, আমরা অনেক সময় কোনো বিষয়ে উপস্থিত ও আবেগনির্ভর সিদ্ধান্ত নিতে চাইলেও, আরেফের একটি গুণ ছিল এই যে, কোনো ধরনের আবেগকেই সাধারণত সে গুরুত্ব দিতো না। বরং যে-কোনো বিষয়ের ভালো ও মন্দ দিকগুলো অত্যন্ত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে তারপর তার নিজের সিদ্ধান্তে আসতো। আরেফের এই বিশেষ গুণটি বহু রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে 'নিউক্লিয়াস'-এর কাজে লেগেছে।"

    তো আবারও যাওয়া যাক নিউক্লিয়াসের কেন্দ্রীয় কাঠামো বিষয়ে। নিউক্লিয়াসের একটি সৌন্দর্য ছিল, তা হলো এর প্রত্যেক সদস্যের ভেটো প্রদানের ক্ষমতা। এটা উপলব্ধ যে কাজী আরেফ আহমেদই সম্ভবত বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর ভেটো ক্ষমতার প্রয়োগ করতেন সবচেয়ে বেশি, ফলে কিছু বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে বিলম্ব হলেও চূড়ান্ত বিচারে তা নিউক্লিয়াসকে ব্যাপক যথার্থতা প্রদান করেছে, তা সিরাজুল আলম খান নিজেও স্বীকার করেন। এক পর্যায়ে নিউক্লিয়াসের কেন্দ্রীয় কমান্ডের সদস্য সংখ্যা বাড়ানোর প্রস্তাব এলেও কাজী আরেফ আহমেদের ভেটোর ফলে তার বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। এখানে অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে এ ভেটোটি ছিল কেন্দ্রীয় কমান্ড প্রসঙ্গে; সারা দেশে নিউক্লিয়াসের অধঃস্তন সদস্য, সেল ও উপকমিটিগুলোতে এ জাতীয় সিদ্ধান্ত নিতেন সশ্লিষ্ট উর্ধতন সংগঠক।

    তবে নিউক্লিয়াসের তিন সদস্য বিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমান্ড একজনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, কাজী আরেফ আহমেদ তাঁর ব্যাপারে ভেটো দেননি: তিনি হলেন মনিরুল ইসলাম বা সকলের প্রিয় মার্শাল মনি। মার্শাল মনি ১৯৬০ সালে প্রবেশিকা পাশের পর থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ছাত্রলীগে যুক্ত হন ও ১৯৬৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে ভর্তি হন। পরে তাঁকে নিউক্লিয়াস কেন্দ্রীয় কমান্ডে যুক্ত করা হয়। সিরাজুল আলম খান জানাচ্ছেন, "মার্শাল মনি ছাড়া আর কাউকে 'নিউক্লিয়াস'-এর মূল সিদ্ধান্ত গ্রহণের অংশীদার করা হয়নি।" তাঁকে নির্বাচন করাটা ছিল নিউক্লিয়াসের এক বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত।

    সে সময় ৬ দফা ভিত্তিক স্বাধীনতা আন্দোলন দ্রুত ব্যাপ্তি পাচ্ছিল; সিরাজুল আলম খান ও আব্দুর রাজ্জাককে অভ্যন্তরীণভাবে আপওয়ার্ড কম্যুনিকেশনসে ও ক্ষেত্রবিশেষে এক্সটার্নাল কম্যুনিকেশনসেও জোর দিতে হচ্ছিল। তখন কাজী আরেফ আহমেদ নিয়োজিত ছিলেন তাঁদের তিনজনের পক্ষে ছাত্রলীগের দেখভাল করার জন্য আর ছাত্রলীগের কমিটিভুক্ত ছিলেন বিধায় মার্শাল মনি ছিলেন ছাত্রলীগে নিউক্লিয়াসের প্রধান ব্যক্তিত্ব। মার্শাল মনি তাঁর 'জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও সমাজতন্ত্র' বইটির উৎসর্গপত্রে লিখেছেন, "এই লেখার বহু তথ্য অকথিত ইতিহাসের অংশ। যে-অংশের অনেক স্থানেই আমার প্রবেশাধিকার না থাকলেও রাজনৈতিক অঙ্গনের সুদীর্ঘ দিনের বন্ধু কাজী আরেফ আহমেদের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে জানার সুযোগ ঘটেছে। যা এ লেখার মূল বিষয়ের বিস্তৃতিতে বিশেষভাবে সহায়তা করেছে। এ লেখাটি তাই তার প্রতি উৎসর্গ করাটাই শ্রেয়।" আমরা নিজেরাও কাজী আরেফ আহমেদের মুখে বহুবার শুনেছি: 'আমার দোস্ত মার্শাল মনি'। তাঁদের এ বন্ধুত্ব, আমাদের জাতীয় ইতিহাসে— কীর্তিময় এক বন্ধুত্ব।

    কীভাবে? ইচ্ছে করলে অনেক উদাহরণ দেয়া যায়, তবে এখানে শুরুতে মাত্র তিনটি বিশেষ বিষয় উল্লেখ করবো।

    প্রথমত, মার্ক্সিয় দর্শনের তৃতীয় সূত্রের বরাতে বলা যায়— পরিমাণের গুণে উত্তরণ। ছাত্রলীগ ততোদিনে অপরাপর ছাত্র সংগঠনগুলোকে ছাড়িয়ে দেশের বৃহত্তম ছাত্র সংগঠনে উন্নীত হয়েছে। স্বাধীনতাবিরোধী ছাত্র ইউনিয়নের ব্যাঙ্গোক্তির ভাষায় ছাত্রলীগ ছিল তথাকথিত আঞ্চলিকতাবাদ ও প্রাদেশিকতাবাদের দোষে দুষ্ট একটি সংগঠন। হ্যাঁ, ছাত্রলীগের স্বাধিকার ও স্বাধীনতা অর্জনের স্পৃহাকে ছাত্র ইউনিয়ন তাই মনে করতো।

    তখনও ছাত্রলীগ স্বাধিকার ও স্বাধীনতা নিয়ে যে পরিমাণ উচ্চকণ্ঠ ছিল, সে পরিমাণ উচ্চকন্ঠ ছিল না স্বাধীন দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ে। নিউক্লিয়াসের একদম শুরুর দিকে, এমনকি সিরাজুল আলম খান নিজেও সমাজতান্ত্রিক সমাজ-ব্যবস্থার পক্ষে ছিলেন না; সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক, কাজী জাফর আহমেদ, হায়দার আকবর খান রনো ও মাহবুব উল্লাহ প্রমুখ ছাত্র ইউনিয়ন নেতাদের সাথে বিতর্ক করতে করতে ও তাঁদের দেয়া বইপত্র পড়তে পড়তে তিনি সমাজতন্ত্রের দীক্ষা নেন। শুরুর দিকে, তাঁর নিজের ভাষায়, 'মূলত কমিউনিজমের বিরোধিতা করার জন্যই আমি এসব বই [সমাজতান্ত্রিক সাহিত্য] পড়ার প্রয়োজন মনে করেছিলাম'। ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে সক্রিয় স্বাধীকার ও স্বায়ত্তশাসনপন্থি স্কুল কলেজের ছেলে-মেয়েরা ছাত্র ইউনিয়নের দিকে টিপ্পনি কাটতো: 'হো হো মাও মাও, চিন যাও ব্যাঙ খাও।'

    স্বাধীকার-স্বাধীনতাপন্থি ছাত্রলীগ সদস্যদের বা নিউক্লিয়াস অনুসারীদের— স্বাধীনতাকে অর্থবহ করতে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিকল্প নেই— এমন দীক্ষায় দীক্ষিত করেন মার্শাল মনি। বলা চলে স্বাধীনতার লক্ষ্যে যে হাজার হাজার ছাত্র-তরুণ-যুবদের সাংগঠনিকভাবে ছাত্রলীগের পতাকাতলে আকৃষ্ট ও সমবেত করেছিলেন সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমেদ এবং স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে যাঁরা স্বাধীনতার লক্ষ্য অর্জনে ছাত্রলীগে যোগদান করেছিলেন— মার্শাল মনি তাঁদের চেতনাজগতের গুণগত রূপান্তর ঘটান, তিনি তাঁদেরকে সমাজতন্ত্রের দীক্ষায় শিক্ষিত নিষ্ঠাবান এক যোদ্ধাবাহিনীতে রূপান্তরিত করেন। এ কাজে তাঁর সাথে টিম-আপ হয়েছিলেন ছাত্রলীগের স্বতঃপ্রণোদিত ও স্বশিক্ষিত এক গুচ্ছ সাহসী তরুণ। নিউক্লিয়াসের পক্ষে ছাত্রলীগের এ আদর্শগত রূপান্তরের নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষেত্রে মার্শাল মনি কাজী আরেফ আহমেদ ও নিউক্লিয়াসের অনুমোদন পান, প্রেরণা পান। নিউক্লিয়াস কেন্দ্রীয় কমান্ডের পক্ষে কাজী আরেফ আহমেদ প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন মার্শাল মনির সাথে।

    যদিও ১৯৬৩ সাল থেকেই নিউক্লিয়াসের সুকৌশলী নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হতো ছাত্রলীগ, স্বাধীনতা ও সমাজতন্ত্রের দীক্ষায় দীক্ষিত সদস্যগণ সাংগঠনিকভাবে ছাত্রলীগের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ নেন ১৯৭০ সালের ২০ মার্চের কাউন্সিল থেকে। এ কাউন্সিলে নির্বাচিত ৬৭ জনের কেন্দ্রীয় কমিটির ৬০ জনই ছিলেন স্বাধীনতাপন্থি ও সমাজতন্ত্রী; বাকি ৭ জন ছিলেন স্বায়ত্তশাসনপন্থি। স্বায়ত্তশাসনপন্থিদের নেতৃত্ব দিতেন নূরে আলম সিদ্দিকী আর স্বাধীনতাপন্থি ও সমাজতন্ত্রীদের নেতৃত্ব দিতেন মার্শাল মনি। স্বাধীনতা ও সমাজতন্ত্রের পক্ষে নীতিগত ও সাংগঠনিক সিদ্ধান্তের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১৯৭০ সালের আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে— ছাত্রলীগের বর্ধিত সভা, কেন্দ্রীয় কমিটির সভা ও ১৭ সেপ্টেম্বর শিক্ষা দিবসে মধুর ক্যান্টিনে অনুষ্ঠিত ছাত্রসভার মাধ্যমে। বর্ধিত সভা ও কেন্দ্রীয কমিটির সভার ট্যাকটিক্যাল দিকটি ছিল— সারা দেশে স্বাধীনতা ও সমাজতন্ত্রের বার্তা শক্তিশালীভাবে প্রচার করা। বর্ধিত সভার এক পর্যায়ে প্রথম দিন সন্ধ্যায় কাজী আরেফ আহমেদ টিএসসিতে মার্শাল মনিকে 'গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ'-এর পক্ষে আলোচনা পরিচালনা করতে বলেন; মার্শাল মনি গণপ্রজাতন্ত্রকে কোয়ালিফাই করে 'স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ' প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা পরিচালনা করতে চাইলে কাজী আরেফ তা অনুমোদন দেন। সভায় স্বপন কুমার চৌধুরী এ প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ছাত্রলীগের বর্ধিত সভা ও কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় সংঘটিত এ আলোচনা আওয়ামী রাজনৈতিক-সাংগঠনিক পরিমণ্ডলে সারা দেশের স্বাধীনতাপন্থি নেতা-কর্মী-সংগঠক-সদস্যদের বিশেষ বার্তা প্রদান করে। ২০২১ সালে এ গল্প খুব সাধারণ মনে হলেও ১৯৭০ সালে উত্থাপিত এ প্রস্তাব ও বিতর্ক ছাত্রলীগের ক্লাইমেক্স ছাপিয়ে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরেও ক্রাইসিস তৈরি করে। বঙ্গবন্ধু ও সিরাজুল আলম খানের আলোচনার মধ্য দিয়েও এ ক্লাইমেক্স ও ক্রাইসিসের অবসান হয়নি। অবশেষে ১৭ সেপ্টেম্বর মধুর ক্যান্টিনে ছাত্রলীগ আয়োজিত শিক্ষা দিবসের আলোচনায় চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ নেতা এমএ আজিজ স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের পক্ষে নিজের কঠোরতম সমর্থন ব্যক্ত করায় সেসবের আপাত-অবসান ঘটে। বঙ্গবন্ধু নিজেও হাফ ছাড়েন।

    উল্লেখ্য, মার্শাল মনি ও তাঁর টিমের মাধ্যমে সমাজতান্ত্রিক দীক্ষায় শিক্ষিত এ ছাত্র-তরুণ-যুবগণ মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স-বিএলএফ বা মুজিব বাহিনীর যোদ্ধা হিসেবে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন ও মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন এবং তাঁরাই ১৯৭২ সালে সারা দেশে জাসদ গঠনে নেতৃত্ব দেন। আরও উল্লেখ্য, নিউক্লিয়াসের রাজনৈতিক শাখা হিসেবে এ বিএলএফ গঠন করা হয়েছিল অনেক আগেই, ১৯৬৮-১৯৬৯ সালে, আর প্রায় একই সময়ে বিএলএফ-এর সামরিক শাখা হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছিল জয় বাংলা বাহিনী। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে বিএলএফ বিস্তারিত কার্যক্রম পরিচালনা করেছিল, সেসব পরে আলোচনা করা যাবে; তবে এখানে এটুকু বলে রাখা যাক যে বঙ্গবন্ধু বিএলএফ-এর জন্য অস্ত্র সংগ্রহ ও প্রশিক্ষণের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক পরিসরে উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। বিএলএফ-এর অস্ত্র সংগ্রহ ও প্রশিক্ষণ অভ্যন্তরীণভাবে সমন্বয়ের কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন কাজী আরেফ আহমেদ।

    দ্বিতীয়ত, ১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের একক সংখ্যারিষ্ঠতা অর্জন বিষয়। ছাত্রলীগের আঞ্চলিক-বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন, ছেষট্টির ছয় দফা আন্দোলন ও উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান পেরিয়ে ১৯৭০-এর নির্বাচনকে বঙ্গবন্ধু ও নিউক্লিয়াস এক দফা স্বাধীনতার দিকে জনগণের ম্যান্ডেট নেবার কৌশল হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। এ নির্বাচন অনুষ্ঠান প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু ও নিউক্লিয়াস এতটাই শক্তিশালী অবস্থান নিয়েছিলেন যে এমনকি সত্তরের ১২ নভেম্বরের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে উপকূলীয় অঞ্চলে কয়েক লাখ মানুষ মারা যাওয়া সত্ত্বেও উপদ্রুত এলাকা ছাড়া সর্বত্র নির্বাচনের ব্যাপারে তাঁরা অনড় থাকেন। মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাপ এ নির্বাচন বর্জন করে। এ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু সিরাজুল আলম খানের নির্বাচিত প্রায় দুই শত নবীন প্রার্থীকে মনোনয়ন দেন; অবশ্য এর অনেক আগেই বঙ্গবন্ধু সিরাজুল আলম খানকে নির্দেশ দিয়েছিলেন ছাত্রলীগের সংগ্রামী অংশের মাধ্যমে সারা দেশে আওয়ামী লীগের পুরোনো নেতৃত্ব প্রতিস্থাপন করে আওয়ামী লীগের দখল নেয়ার জন্য।

    সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের লক্ষ্যে নিউক্লিয়াস একটি মেগা প্রকল্প গ্রহণ করে। প্রায় দেড় হাজার বিএলএফ কর্মীকে তিন থেকে পাঁচ জনের ছোট ছোট দলে বিভক্ত করে সারা দেশের সকল প্রার্থীর পক্ষে গণসংযোগ ও প্রচারের কাজে নিয়োগ দেয়া হয়। এ কাজের সমন্বয়ের দায়িত্ব দেয়া হয় মার্শাল মনিকে, তাঁকে সহযোগিতা করেন আফম মাহবুবুল হক। মার্শাল মনিকে এ কাজের দায়িত্ব দেয়ায় নিঃসন্দেহে কাজী আরেফ আহমেদের ভূমিকা ছিল বলে ধরে নেয়া যায়, কেননা ইতোপূর্বে নিউক্লিয়াসের পক্ষে তিনিই ছিলেন মার্শাল মনির তথা ছাত্রলীগের রাজনৈতিক অভিভাবক।

    তৃতীয়ত, মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের পুনর্গঠন ও শাসন-প্রশাসন বিষয়ে [ক] বিএলএফ-এর চার প্রধানের ১০ জানুয়ারি ১৯৭২-এর সুপারিশ, [খ] জানুয়ারির শেষে সিরাজুল আলম খানের দেয়া ১৫ দফা সুপারিশ, [গ] ছাত্রলীগের মার্চ মাসের বর্ধিত সভা ও সাধারণ সভার সুপারিশ, [ঘ] আসম আব্দুর রব ও শাহজাহান সিরাজের দেয়া মে মাসের সুপারিশ ও [ঙ] ৭ জুন আবারও ছাত্রলীগ কর্তৃক দেয় সুপারিশ বঙ্গবন্ধু গ্রহণ না করায় এবং জুলাই মাসে ছাত্রলীগের সম্মেলনে নিরপেক্ষ না থেকে সংখ্যালঘুদের উপদলীয় সম্মেলনে উপস্থিত হয়ে তাদের সমর্থন দেয়ায়, কাঠামোগতভাবে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন বিষয়ে নিউক্লিয়াসের দু'জন— সিরাজুল আলম খান ও কাজী আরেফ আহমেদ— প্রাথমিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এটা মনে রাখতে হবে যে তাঁরা দু'জন জাসদ গঠনে একমত হয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেও [তৃতীয়জন, আব্দুর রাজ্জাক দল গঠন বিষয়ে একমত হননি], সিদ্ধান্তের জন্য দাবি/চাপ এসেছিল সারা দেশের হাজার হাজার স্বাধীনতা আন্দোলনের কর্মী ও মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকেই— যাঁরা সকলে ছিলেন মার্শাল মনির নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারায় দীক্ষিত।

    উল্লিখিত তিনটি বিশেষ বিষয়ের পাশাপাশি ১৯৭৫ পরবর্তী সময়ে কাজী আরেফ আহমেদের সজ্ঞা ও প্রজ্ঞার আরো দুটো বিশেষ বিষয়ের উল্লেখ করতে হয়।

    প্রথমত, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যা ও ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর মহান সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থানের পরাজয়ের পর কাজী আরেফ আহমেদ বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতির ও জাসদীয় রাজনীতির পক্ষে এক উল্লেখযোগ্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সেটা হলো মোশতাক-জিয়া চক্রের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা পাকিস্তানপন্থার বিরুদ্ধে জাসদ ও আওয়ামী লীগসমেত মুক্তিযুদ্ধের ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে তোলা— যদিও জাসদ ও আওয়ামী লীগ ১৯৭২ থেকে পরস্পরবিরোধী রাজনীতির চর্চা করেছে। অতীত ক্ষত ও বিরোধ ভুলে জাতীয় প্রয়োজনে ঐক্যের রাজনীতি পরিচালনা বিষয়ে তাঁর এ প্রজ্ঞাবান সিদ্ধান্ত— যদিও বারবার তা বিবিধ ষড়যন্ত্রে মুখ থুবড়ে পড়েছে— বাংলাদেশের রাজনীতিতে চার দশকেরও বেশি সময় ধরে নির্ধারক ভূমিকা রেখেছে। তাঁর রাজনৈতিক চিন্তার আলোকে ও সাংগঠনিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ১৯৭৯ সালে জাসদ ও আওয়ামী লীগসমেত গঠিত হয়েছিল ১০ দলীয় ঐক্যজোট ও পরে এরশাদ ক্ষমতায় আসলে গঠিত হয়েছিল ১৫ দল। তাঁর দেখানো পথেই— তাঁর প্রয়াণের পর— সর্বশেষ বিএনপি-জামাত-জঙ্গির বিরুদ্ধে জাসদ আওয়ামী লীগের সাথে গঠন করেছে ১৪ দল। ১৪ দল এখনও পর্যন্ত বাংলাদেশের রাজনীতিতে সফলতম একটি আদর্শগত জোট।

    আর দ্বিতীয়ত, ১৯৯০ সালে অবৈধ সামরিক জান্তা এরশাদের পতনের পর, সূচিত আংশিক গণতন্ত্র থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি নিউক্লিয়াসের পুরোনো সহকর্মী আব্দুর রাজ্জাককে নিয়ে শহীদ জননী জাহানারা ইমামকে নেতৃত্বে রেখে যুদ্ধাপরাধ বিচারের আন্দোলন এগিয়ে নিতে গঠন করেন 'একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন জাতীয় সমন্বয় কমিটি'; জাসদের সভাপতিমণ্ডলির সদস্য হিসেবে তিনি ও আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলির সদস্য হিসেবে আব্দুর রাজ্জাক এ 'জাতীয় সমন্বয় কমিটি'র 'স্টিয়ারিং কমিটি'র সদস্য হিসেবে মূল নীতি-নির্ধারণী ভূমিকা পালন করেন এবং রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ও রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে লিয়াঁজো রাখেন; এবং সংগঠিত করেন ঐতিহাসিক গণআদালত। ক্রমে এ আন্দোলন বাংলাদেশের তরুণ সমাজের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে ওঠে এবং জাতীয় রাজনীতির নির্ধারক উপাদানে পরিণত হয়। সর্বশেষ ২০০৯ সালের নির্বাচনের পর বাংলাদেশে সূচিত হয় যুদ্ধাপরাধ বিচারপ্রক্রিয়া। একদম শুরু থেকেই জাসদ একনিষ্ঠভাবে সারা দেশে এ আন্দোলনে যুক্ত থাকে।

    স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ বা নিউক্লিয়াস গঠনের যুগান্তকারী সিদ্ধান্তের বাইরে এখানে কাজী আরেফ আহমেদের সজ্ঞা ও প্রজ্ঞার পাঁচটি উদাহরণ আলোচনা করা হলো। সংক্ষেপে এগুলো হলো— [১] নিউক্লিয়াসের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় মার্শল মনিকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাবে ভেটো প্রদান না করে তাঁকে অন্তর্ভুক্ত করা, [২] মার্শাল মনি ও তাঁর টিম কর্তৃক ছাত্রলীগের রাজনৈতিক-দার্শনিক রূপান্তরে সম্মতি ও সহযোগিতা দেয়া ও স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখা, [৩] জাসদ গঠন বিষয়ে সিরাজুল আলম খানের সাথে যৌথ-সিদ্ধান্ত নেয়া, [৪] ১৯৭৫ সালের পর আবারও মুক্তিযুদ্ধের ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির ঐক্যের রাজনীতির সূচনা করা, এবং [৫] যুদ্ধাপরাধের বিচার আন্দোলন সংগঠিত করা।

    এগুলো ছাড়াও বাঙালির জাতীয় মুক্তি আন্দোলন পরিচালনায় ও বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় পরিচালনার লক্ষ্যে তাঁর ছোট-বড় আরও অনেক ভূমিকা রয়েছে। যেমন বলা যায় পূর্ব বাংলায় বাংলা ভাষা প্রচলনের লক্ষ্যে তাঁর উদ্যোগে ও নেতৃত্বে পরিচালিত বাংলা ভাষা প্রচলন আন্দোলন। তাঁর এ আন্দোলনী-প্রয়াসেই পূর্ব বাংলায় উর্দু ও ইংরেজির পরিবর্তে বাংলায় সাইনবোর্ড ও গাড়ির নাম্বার প্লেট লেখা হতে থাকে। তিনি ছিলেন সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালনার জন্য বঙ্গবন্ধু কর্তৃক অস্ত্র আমদানি ও প্রশিক্ষণ পরিচালনার জন্য নিউক্লিয়াস মনোনীত কেন্দ্রীয় ব্যক্তি; যদিও একাত্তরের মার্চের অসহযোগ আন্দোলনের কারণে তা বিলম্বিত/স্থগিত হয়ে গিয়েছিল।

    ঘাতকের বুলেট কাজী আরেফ আহমেদকে আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে। ওই সময় তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রধান উপদেষ্টা/কার্যালয়ের সাথে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত থেকে বাংলাদেশের এক বড় অংশকে সন্ত্রাসীদের কবল থেকে মুক্ত করার জন্য নিবেদিতপ্রাণ হয়ে কাজ করছিলেন— কেননা এ সন্ত্রাসীরা পাকিস্তানপন্থা-দক্ষিণপন্থার ভাড়াটে বাহিনী হিসেবে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপের মাধ্যমে বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় দক্ষিণপন্থার বিদ্যমানতা বহাল রাখতে চাইছিল।

    কাজী আরেফ আহমেদ চলে গেছেন মহাকালের পথে; কিন্তু আমরা জানি মহাকাল তাঁকে হারিয়ে ফেলতে পারবে না, লুকিয়ে রাখতে পারবে না। যতো দিন বাংলা ও বাঙালি থাকবে— ততো দিন উদ্ভাসিত থাকবেন বাঙালির জাতীয় বীর কাজী আরেফ আহমেদ। বীরের মৃত্যু নেই। শহীদ কাজী আরেফ আহমেদ অমর হোন। জয় বাংলা।

    * লেখক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটির প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক এবং জাসদের মুখপত্র ‘লড়াই’-এর সম্পাদক ও প্রকাশক।

    পূর্বপশ্চিম-এনই

    কাজী আরেফ আহমেদ
    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close