• শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

রাজপথের সহযোদ্ধা পীর হাবিবুর রহমান

প্রকাশ:  ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০৯:১৩
শেখ ইউসুফ হারুন

আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আশির দশকের প্রথম দিকে যখন ভর্তি হই, তখন চলছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভাঙা-গড়ার খেলা। জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর বিচারপতি সাত্তার ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। পরে ১৯৮১ সালের ১৫ নভেম্বর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি বিজয়ী হন। তার মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে তৎকালীন সেনাপ্রধান লে. জে. হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সামরিক ফরমান বলে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ ক্ষমতা দখল করেন। ছাত্রসমাজ এরশাদবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলেন। কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ব্যানারে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (জাসদ), বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নসহ সব প্রগতিশীল দল নিয়ে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সে সময় আরও একটি প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের মোকাবিলা করতে হয়। সেটি হলো ইসলামী ছাত্রশিবির। এরশাদের ক্ষমতা দখলের কয়েক দিন আগে ১৯৮২ সালের ১১ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাবলা চত্বরে ইসলামী ছাত্রশিবির নবীনবরণ অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেয়। প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলো এর তীব্র প্রতিবাদ করে। ঘটনার দিন সংঘর্ষে পাঁচ ছাত্র নিহত হন। ঠিক এ রকম একটি টালমাটাল পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের টেন্টে পরিচয় হয় পীর হাবিবুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বয়সে নবীন ও ক্লাসে আমার এক বছরের ছোট। আমি তার বাড়ি জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন সুনামগঞ্জ। আমি খুবই আশ্চর্য ও বিস্মিত হই এ জন্য, মেঘালয় পাহাড়ের নিচে অবস্থিত বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী একটি জেলা হতে এত দূরে পড়তে এসেছে! তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেস ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত। প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের মধ্যে অন্যতম।

সহযোদ্ধা হিসেবে প্রতিটি মিছিল সমাবেশে পীর হাবিবের সাক্ষাৎ পেয়েছি বহুবার। একবার জেলও খেটেছেন এরশাদবিরোধী আন্দোলনে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি প্রগতিশীল আন্দোলনে উপস্থিত থাকতেন। বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনেও তিনি যুক্ত থেকেছেন। এরশাদ ও শিবিরবিরোধী আন্দোলনের ফলে আমাদের শিক্ষাগ্রহণ কাল দ্বিগুণ হয়ে যায়- চার বছরের কোর্স আট বছরে শেষ হয়। জীবন থেকে নিয়ন্ত্রণবহির্ভূত কারণে চারটি বছরের অপচয় হয়। তার খেসারত দিতে হয়েছে চিরজীবন। হাবিবের বিচরণ ছিল সর্বক্ষেত্রে। তার ছোট ভাই পীর ফজলুর রহমান মিছবাহ্‌ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, এখন একাদশ জাতীয় সংসদের সুনামগঞ্জ-৪ এর সংসদ সদস্য।

১৯৮৯ সালের শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখার পাট চুকিয়ে সরকারি চাকরিতে যোগদান করি। আমার পোস্টিং হয় সুনামগঞ্জে। হাওর, বাঁওড়, নদনদী, বিল ও পাহাড়বেষ্টিত সুনামগঞ্জ জেলা। হাওরের পানিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হিজলগাছ বকে বকে সাদা হয়ে আছে, সে সৌর্ন্দয কবির কল্পনাকেও হার মানায়। প্রকৃতি যেন অপরূপ সাজে সাজিয়ে দিয়েছে সুনামগঞ্জকে। বর্ষাকালে মেঘালয় পাহাড়ের গা ঘেঁষে বিপুল জলরাশিতে হাওরের ঢেউ না দেখলে সুনামগঞ্জকে দেখা হয় না। প্রতিটি গ্রাম যেন এক একটি দ্বীপ। সিলেট অঞ্চলে আমি এক যুগেরও বেশি চাকরি করেছি। বলা যায়, এটি আমার চাকরি জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়।

কালেক্টরেটে যোগদানের পর সহকর্মী হিসেবে পাই পীর হাবিবুরের বড় ভাই পীর মতিউর রহমানকে। একজন উন্নত গুণাবলিসম্পন্ন অসাধারণ মানুষ। পরে তিনি কালেক্টরেটের চাকরি ছেড়ে আইন ব্যবসায় নিয়োজিত হন। সুনামগঞ্জের খেলাধুলা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও তিনি পরিচিত ব্যক্তি। অনেকবার সুনামগঞ্জ শহরে অবস্থিত পীর হাবিরের বাড়িতে গিয়েছি। সুন্দর পরিপাটি করে সাজানো ছায়া সুনিবিড় একটি বাড়ি। সিলেট অঞ্চলের টিনের বাড়ি যেমন হয়, ঠিক সেরকম একটি বাড়ি।

পীর হাবিবুর রহমানের জন্ম ১৯৬৪ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি সুনামগঞ্জ শহরে। সেখানেই তার বেড়ে ওঠা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্সসহ স্নাতকোত্তর হয়ে পীর হাবিব বাংলাবাজার পত্রিকা দিয়ে তার সাংবাদিক জীবন শুরু করেন, দৈনিক যুগান্তরেও কাজ করেছেন। ১-১১-এর সময় তার সাহসী লেখনী পাঠকদের উদ্বুদ্ধ ও সাহসী করেছে। সবশেষে তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন। তার লেখা সব সময় পাঠকদের আকর্ষণ করত। টকশোতেও তিনি ছিলেন অনবদ্য।

হাবিব ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত শুনে ব্যথিত হয়েছিলাম। গত বছর ভারতের মুম্বাই হতে 'বোনমেরো ট্রান্সপ্লান্ট' করে দেশে ফেরার পর তার সঙ্গে কয়েকবার কথা হয়েছে। তিনি ছিলেন প্রচণ্ড আশাবাদী মানুষ। চিকিৎসা শেষে আবার নতুন করে লেখালেখি শুরু করবেন বলে আশা প্রকাশ করেছিলেন। তিনি ক্যান্সারমুক্ত হয়েছিলেন। এই জানুয়ারি মাসে করোনায় আক্রান্ত হলে হাসপাতালে ভর্তি হন। করোনামুক্ত হলেও কিডনির জটিলতায় তাকে আবার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে স্ট্রোক করলে আইসিইউতে ট্রান্সফার করা হয়। সেখানে তিনি ৫ ফেব্রুয়ারি বিকেলে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। আমি তখন সরকারি সফরে খুলনায়। তার মৃত্যু সংবাদে আমি স্তম্ভিত, দুঃখিত ও ব্যথিত হয়েছি।

অসুস্থ অবস্থায় পীর হাবিব যখন ফেসবুকে তার বাড়ির ছবিটি প্রকাশ করে অনেক দিন সুনামগঞ্জ যেতে পারেননি বলে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়তেন, তখন আমারও মানসপটে পীর হাবিবদের বাড়ির অপূর্ব দৃশ্যটি ফুটে উঠত। তার নিজ বাড়িতে যেতে না পারার আকুতি আমার হৃদয়কেও স্পর্শ করেছে। সুনামগঞ্জ হতে উঠে এসে সবার মন জয় করে আবার সবাইকে কাঁদিয়ে ফিরে গেলেন শৈশবের তার সেই চির পরিচিত জল-জোছনার শহরে। মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশে ছোটবেলার স্মৃতিবিজড়িত পাখপাখালির দেশে তাদের সঙ্গে মিতালি করে ঘুমিয়ে থাকবেন প্রিয় হাবিব।

লেখক: নির্বাহী চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ

পীর হাবিবুর রহমান
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close