• শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

ছাই চাপা আগুন

প্রকাশ:  ০৫ এপ্রিল ২০২২, ০০:০৫ | আপডেট : ০৫ এপ্রিল ২০২২, ১৬:২৭
হাসান শাওন

ইতিহাস এক মেঘে ঢাকা নক্ষত্র। ছাই চাপা আগুনও একে বলা যায়। কালের সাধ্য নেই একে আজীবন আড়ালের। সময় মতো তা প্রকাশ্যে আসবেই। তাতে জ্বলে পুড়ে নি:চিহ্ন হতে পারে মিথ্যার বেসাতি। মানুষের অধিকার আদায়ের ন্যায়ের যুদ্ধে এই ইতিহাস এক অমূল্য সম্পদ। একে আশ্রয় করে ভবিষ্যত নির্মিত হয়। চলে ইতিহাসের বিনির্মাণ পর্ব।

সমাজ পরিবর্তনে বিশ্বাসী রাজনৈতিক নেতা জিয়াউল হক মুক্তা রচিত ‘১৭ মার্চ ১৯৭৪ হত্যাযজ্ঞের পূর্বাপর’ বই শুরুতে বর্ণিত কথারই প্রতিলিপি। এতে আলোচিত হয়েছে বাংলা জনপদে আড়ালে থাকা ইতিহাসের এক বেদনা পর্ব। তথ্যবহুল এই বই সাক্ষ্য বহু কিছুর। এতে লেখক দায়বদ্ধ ছিলেন একমাত্র সত্যের কাছে। তার গবেষণা তীব্রতায় এ বই হয়েছে আড়ালে থাকা এক ঐতিহাসিক পর্বের উন্মোচক। অনার্য পাবলিকেশন্স প্রকাশিত বইটির পৃষ্ঠা সংখ্যা ১০৪। এর পাতায় পাতায় লেখক ছিলেন মিথ্যা ও অপপ্রচারের আগাছা উচ্ছেদে আপোষহীন।

সম্পর্কিত খবর

    স্বাধীনতার ৫০ বছর অতিক্রান্ত হলেও বাংলাদেশ তার জন্মলগ্ন ও এর পরের বহু ঐতিহাসিক ঘটনা বিস্মৃত। ২০২১ সালের মে মাসে প্রকাশিত লেখক জিয়াউল হক মুক্তা’র এই বইয়ের প্রকাশ যেন ভুলে যাওয়া বিরুদ্ধে মনে রাখার লড়াই। লেখক এ বইয়ে আলোকপাত করেছেন মুছে ফেলা ইতিহাসের একটি নির্দিষ্ট তারিখে। বইয়ের নামে যা স্পষ্ট।

    ১৯৭৪ সালে ১৭ মার্চ বাংলাদেশের তৎকালীন সর্ববৃহৎ বিরোধী দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) এর ডাকে একটি শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে রাষ্ট্রের প্যারামিলিটারি ফোর্স রক্ষীবাহিনী নিরস্ত্র মানুষের ওপর স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রে গুলি চালায়। এতে নিহতের সঠিক সংখ্যা থেকে, কর্মসূচির কারণ, স্বাধীন দেশে জাসদ প্রতিষ্ঠার অনিবার্যতা, ৭৪’ এর দুর্ভিক্ষ ও পরবর্তিতে এ ঘটনা নিয়ে মিথ্যাচারের সময়োচিত সাহসী জবাবে এ বই শ্বাসরুদ্ধকর হয়েছে। পড়তে পড়তে পাঠকের মনে হবে ‘কত অজানারে?’

    বইয়ের শুরুতে লেখক ‘গণহত্যা’ নামক শব্দযুগলের বিশ্লেষণে গেছেন। ১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষের পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগ নামের বদ্ধ একটি উদ্যানে বসন্ত উৎসব পালনরত জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি বর্ষণে শহীদ হন ৩৭৯ জন। একে আমরা ‘গণহত্যা’ বলি। ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি আজকের বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার গাড়ি বহরে পুলিশের গুলি বর্ষণের ঘটনার বিচারকালে আদালত সে ঘটনাকে ‘গণহত্যা’ বলেছিলেন। কিন্তু জাসদের হিসেবে ১৯৭৪ সালের ১৭ মার্চে রক্ষীবাহিনীর গুলিতে শহীদ হন ৫০ জন। এটি গণহত্যা হিসেবে চিহ্নিত হয় না। আলোচিতও হয় না ইতিহাসের এ পর্ব। আর হত্যাযজ্ঞ তো বিচারহীন হয়ে আছে যুগে পর যুগ। এখানে লেখকের যুক্তি হচ্ছে, ‘নিহত ও আহতের সংখ্যাবিচারে নয়, মিলিটারি ট্যাকটিকসের বিবেচনায় হেয়ার রোডের ঘটনাটি ছিল জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের অনুরূপ।’

    বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে প্রকাশিত এই বই একটি সময়ের দলিল। যাতে প্রকাশিত হয়েছে জাতির জনকের অসহায়ত্ব। বাঙালির নন্দিত নেতার দলের নিন্দিত হয়ে ওঠার পর্ব যেন এতে চিত্রায়িত।

    ১৯৭৪ সালের ১৮ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশনের উদ্বোধনে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘কিছু কিছু লোক যখন মধু-মক্ষির গন্ধ পায়, তখন এসে আওয়ামী লীগে ভিড় জমায়। আওয়ামী লীগের নামে লুটতরাজ করে।’ এ ভাষণে তিনি নিজ দলের নেতা-কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান, ‘তোমরা আত্মসমালোচনা কর, আত্মসংযম কর। তোমরা আত্মশুদ্ধি কর।’

    কিন্তু এ ডাকে সাড়া দেয়নি স্বয়ং বঙ্গবন্ধুর চারপাশ। সকল ধরনের অন্যায় অবিচার চলতে থাকে অব্যাহত গতিতে। দেশকে দেখতে হয় প্রাণসংহারি এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ।

    এর আগে ১৯৭৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর জাসদ কেন্দ্রিয় কমিটির সভায় জনজীবনের অপরিমেয় দু:খ দুর্ভোগ কমানোর দাবিতে একটি ২৯ দফা দাবিনামা প্রণয়ন ও প্রকাশ করা হয়। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আজকে আমি বলবো, বাংলার জনগণকে- এক নম্বর কাজ হবে দুর্নীতিবাজদের বাংলার মাটি থেকে উৎখাত করতে হবে। আমি আপনাদের সাহায্য চাই। কেমন করে করতে হবে? আইন চালাবো, ক্ষমা করবো না। যাকে পাবো, ছাড়বো না।’ কিন্তু বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। বঙ্গবন্ধুর সৈনিকরা ‘আত্মসমালোচনা’, ‘আত্মসংযম’ ও ‘আত্মশুদ্ধি’র পথে হাঁটেননি। বঙ্গবন্ধু যাদের বলেছিলেন, ‘চাটার দল’, ‘চোরের দল’, ‘নরপশুর দল’ তারা তাদের কর্মে বিরতি দেয়নি। এ পরিস্থিতিতে ১৫ মার্চ ১৯৭৪ জাসদ আয়োজিত গণজমায়েত থেকে ঘোষণা করা হয় ১৭ মার্চ প্রত্যক্ষ আন্দোলনের পর্যায় হিসেবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর বাসভবন ঘেরাও করে আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।

    ১৭ মার্চ লোকে লোকারণ্য হয়ে ওঠে পল্টন ময়দান। বিকালে সভা শেষে ৩০ হাজারের বেশি জনতার মিছিল স্টেডিয়ামের গেট দিয়ে বের হয়ে প্রেসক্লাব পেরিয়ে মৎস ভবন অতিক্রম করে কাকরাইল মসজিদের পাশ দিয়ে হেয়ার রোডে প্রবেশ করে। তারা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর বাসভবনের সামনে অবস্থান নেয়। এ সময় পুলিশ পথে বসে থাকা শ্লোগানধারীদের তুলে দেয়ার চেষ্টা করে। মেজর এমএ জলিল, আসম আব্দুর রব, হাসানুল হক ইনু ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ ছিলেন মিছিলের অগ্রভাগে।

    দৈনিক ইত্তেফাকের ভাষ্য মতে, বিকাল ৫ টা ৫৫ মিনিটে বিক্ষোভকারীরা মন্ত্রীর বাসার দিকে ৫টি ঢিল ছোঁড়েন। এর ৫ মিনিট পর সন্ধ্যা ৬টায় মন্ত্রীর বাসভবনের দিক থেকে পুলিশ ৮টি টিয়ার গ্যাস সেল নিক্ষেপ করে।

    এরপর ঘটে হত্যাযজ্ঞের সূচনা পর্ব। ঘটনাস্থলে রক্ষীবাহিনীর এক কর্মকর্তার আগমন ঘটে। তিনি চিৎকার করে বলেন, “রক্ষীবাহিনী, তোমরা এখনো চুপ করে দাঁড়িয়ে দেখছ কী? গুলি চালাও।” বলে তিনি নিজেই মেশিনগান হাতে নিয়ে পুলিশ-রক্ষীবাহিনী-বিডিআর ও জাসদ নেতৃত্বকে হতবাক করে সরাসরি জাসদ নেতৃত্ব ও জনতার ওপর বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ করতে থাকেন। সবাইকে শুয়ে পড়ার নির্দেশ দেয়া হয়। একটানা গুলিবর্ষণে সাড়ে ৬টার মধ্যে হেয়ার রোড ফাঁকা হয়ে যায়। পড়ে থাকে শহীদদের মৃতদেহ। ঘটনাস্থলে অন্য অনেকের মতো শহীদ হন বরিশালের জনপ্রিয় ছাত্রনেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা এসএম রফিকুল ইসলাম জাফর। ৬টা ৫০ মিনিটে পুলিশ জাসদ নেতা জলিল, রব, ইনু, মমতাজ ও ছাত্রনেতা রোজী, লিনু, বানু, মিথুনসহ ৩২ জনকে গ্রেফতার করে ট্রাকে কেন্দ্রিয় কারাগারে নিয়ে যায়। নেতাকর্মীরা শহীদ জাফরের লাশ নিয়ে ট্রাকে উঠেছিলেন। তারা সে লাশ একটি টেবিলের ওপর রেখে সেখানে শ্লোগান ও গণসঙ্গীত গাইতে থাকেন। রাত সাড়ে দশটার দিকে পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা সেখান থেকে লাশ নিয়ে যান। কোনো শহীদের লাশেরই এরপর আর হদিস মেলেনি।

    সরকার সমর্থক ৭টি ও সরকার বিরোধী ১ টি মোট ৮টি জাতীয় দৈনিক পত্রিকা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব স্টেটের ডিক্লাসিফাইড টেলিগ্রাম ও অন্যান্য সূত্র এ সত্য নিশ্চিত করে।

    খোদ রাষ্ট্রের কর্মকর্তারা স্বীকার করেন ঘটনাস্থলে গুলি করার মতো কোনো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। নিরস্ত্র জনতার ওপর মেশিনগানে মতো অটোমেটিক অস্ত্রের ব্যবহার ইন এইড অব সিভিল পাওয়ার নীতিমালার অনুযায়ী কোটমার্শালযোগ্য ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। হেয়ার রোডের মতো অবরুদ্ধ জায়গায় সংগঠিত এ হত্যাকাণ্ডকে তুলনা করা হয় জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যার সাথে।

    লেখক জিয়াউল হক মুক্তা লিখিত ‘১৭ মার্চ ১৯৭৪ হত্যাযজ্ঞের পূর্বাপর’ বইটি আপদমস্তক বাংলাদেশের ইতিহাসের অনুল্লিত এক পর্বকে দৃশ্যমান করে। বইয়ে নির্দিষ্ট তারিখের পরের ঘটনাও সচিত্র ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। দৈনিক গণকণ্ঠ বন্ধ ও জাসদ কার্যালয় অগ্নিসংযোগের বিবরণ এতে পাঠকের সামনে চাক্ষুশ হয়েছে।

    পরবর্তিতে ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ প্রসঙ্গ অবতারণ করেন লেখক। স্বয়ং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রখ্যাত সাংবাদিক জন পিলজারকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেন দুর্ভিক্ষে সাতাশ হাজার মানুষ মৃত্যের।

    খাদ্য শস্যের অভাবে যে ৭৪ এর দুর্ভিক্ষ হয়নি এর স্বপক্ষে বিশ্ব বরেণ্য নোবেল বিজয়ী বাঙালি অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন, অর্থনীতিবিদ ড. এসআর ওসমানী, লেখক সাংবাদিক অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস এর দেয়া তথ্যে তা পাওয়া যায়। গবেষণায় উঠে আসে সেসময় মাত্র ১.৩৮ শতাংশ খাদ্য ছিল সরকারের নিয়ন্ত্রণে, বাকি ৯৮.৬২ শতাংশ খাদ্যের নিয়ন্ত্রণ ছিল ব্যক্তিগত পর্যায়ে। বহু গবেষকের মতে, এ দুর্ভিক্ষে প্রায় ১৫ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়।

    স্বাধীন বাংলা কোনো দিক থেকেই ‘সোনার বাংলা’ হয়নি এর আলেখ্য এই বই। এতে বাদ যায়নি ১৯৭৩ সালের বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় নির্বাচন প্রসঙ্গ। সে নির্বাচন ছিল ভোট ডাকাতির, ব্যালট ছিনতাইয়ের ব্যাপক উদাহরণ।

    ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ অনুষ্ঠিত সে নির্বাচনে ভোলায় বঙ্গবন্ধুকে বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় নির্বাচিত করতে জাসদের প্রার্থী ডা. আজহার উদ্দিন আহমদকে অপহরণ করে মনোনয়ন পত্র দাখিল করতে দেয়া হয়নি। এ নির্বাচনে কুমিল্লায় ৭৫ এর ঘাতক খন্দকার মোশতাক আহমাদকে বিপুল ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করেন জাসদের প্রার্থী ইঞ্জিনিয়ার আব্দুর রশিদ। স্থানীয়ভাবে ও বেতারে তাকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। কিন্তু রাতে হেলিকপ্টারে সমস্ত ব্যালট বাক্স ঢাকায় এনে ভোট পুনর্গণনার নামে ৪৮ ঘণ্টার পর মোশতাককে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। সে নির্বাচন ছিল এমনই যে, আওয়ামী লীগের মিত্র দল ন্যাপ-সিপিবি ও অন্য রাজনৈতিক দলগুলো পর্যন্ত এতে ভোট ডাকাতির অভিযোগ করে।

    হয়তো গলদ ছিল গোড়াতেই। কারণ, বাহাত্তর সালে সদ্য স্বাধীন দেশে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বিপ্লবী সরকার বা জাতীয় সরকার গঠন না করে সরকারি দল ও বিরোধী দল ভিত্তিক সংসদীয় রাজনীতির সূচনা করে দেশে মুক্তিযুদ্ধেও মাধ্যমে অর্জিত ঐক্যমত্যের রাজনীতিকে ব্যাহত করা হয়।

    সব মিলিয়ে ইতিহাসের এক অজানা পর্বের আঁকড় যেন জিয়াউল হক মুক্তা লিখিত এই বই ‘১৭ মার্চ ১৯৭৪ হত্যাযজ্ঞের পূর্বাপর’। ক্ষমতাসীনদের উগ্র জাতিয়তাবাদ ও ভিন্ন মত দমন বাংলাদেশ রাষ্ট্রে এখনো বহাল। বিচার বর্হিভূত হত্যাকাণ্ড এখনেরও আলোচিত বিষয়। তাই আলোচ্য বইকে বলা শুরুর বৃত্তান্তের বিবরণ। এতে আছে শাসক শ্রেণির জন্য সতর্কবার্তা। পাঠক পাতায় পাতায় তা টের পাবেন। কিন্তু শাসকগোষ্ঠী কি তা কানে তুলবে? এর উত্তর নিশ্চিতভাবে ভবিষ্যতই বলবে।

    লেখক: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ও স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতা

    পূর্বপশ্চিম- এনই

    ছাই চাঁপা আগুন
    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close