• শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

টিপকাণ্ড: টিপ অব দ্য আইসবার্গ

প্রকাশ:  ০৬ এপ্রিল ২০২২, ১৪:৩৪
জিয়াউল হক মুক্তা

এক.

টিপকাণ্ড সূচিত হয়েছে; এ যেন আরেক লঙ্কাকাণ্ড। দুটো পক্ষ দাঁড়িয়েছে মুখোমুখি। আমি একটি পক্ষে— টিপের পক্ষে।

সত্যি বলতে কী শাড়ি ও টিপের প্রতি আমার রয়েছে পরম মোহগ্রস্ততা; আর সাথে হাতে যদি থাকে সাদা শাঁখা— নারীর সে অপরিমেয় সৌন্দর্য আমার কী যে ভাল্লাগার! কৈশোরে নিজ মফস্বল শহর শেরপুরে চপলা প্রতিবেশিনী লক্ষ্মীকে যখন দেখলাম কারো বউ হয়ে কপালে এঁকেছে বিশাল এক সিঁদুরে-টিপ— স্নান শেষে কাঁখে কলসি লয়ে যাচ্ছে হেঁটে মন্দ্রমন্থর— সেদিন থেকে আমি টিপের হয়ে গেলাম।

মাঝ বয়সে মেয়ের বাবা হয়েছি— মেয়েকে নিয়ে বাজারে গিয়েছি, টিপ কিনেছি, ওর কপালে টিপ লাগিয়ে বাবা-মেয়ে দুজনে ঘুরেছি রাতের ঢাকা। আমার বিশালাক্ষি বউয়ের অপরিচর্যিত দুই ভ্রুর মাঝখানে জ্বলজ্বলে লাল টিপ আমার কাছে দিগন্তে প্রত্যুষের অবাক সূর্যোদয়— তাকিয়ে থেকে আশ মেটেনা। উড়োজাহাজে আন্তমহাদেশীয় দীর্ঘযাত্রায় রাতের খাবার শেষে সকলে যখন মগ্ন থাকে গভীর ঘুমে, নিভিয়ে দেয়া হয় কেবিনের সব বাতি, নামিয়ে দেয়া হয় সব জানালার কপাট, কেবিন ক্রু’রা পরম মমতায় হেঁটে যায় সন্তর্পনে— খোঁজ নেয় কারো কম্বল লাগবে কিনা, কারো জল বা জুস বা বিয়ার বা ওয়াইন বা লিকার বা স্ন্যাকস লাগবে কিনা— বিস্তীর্ণ মেঘরাশি ছাপিয়ে ভূপৃষ্ঠ থেকে পঁয়ত্রিশ হাজার ফুট উপরে তখন আইনস্টাইনিয় আপেক্ষিকতায় বায়ুযান যেন স্থির হয়ে যায়— আমি আলতো হেঁটে পেছনে কেবিন ক্রুদের সেকশনে চলে যাই— জানালা সামান্য ফাঁক করে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকি প্রায়ান্ধকার মেঘদিগন্তে— কখন অতিপ্রত্যুষের অবাক সূর্যোদয়রূপে আবির্ভূত হয় আমার দেবি-বউয়ের মুখাবয়ব! “একলা ঘরে মন বধুয়া আমার রইছে পন্থ চাইয়া।”

নন্দিনী টিপ আমাকে কতোবার যে অনুপ্রাণিত করেছে কতো না টিপবন্দনায়! আমি টিপের পক্ষ নেব না কেন?

দুই.

টিপকাণ্ড হলো টিপ অব দ্য আইসবার্গ। আইসবার্গটি কী? তা হলো সর্বনাশা সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতার সাথে সংঘাত। এ সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা ১৯৭১-এর সুমহান জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের সমুদয় অর্জনকে ফেরত নিয়ে যাচ্ছে ১৯৪৭-এর বস্তাপচা দ্বিজাতি-তত্ত্বের দুর্গন্ধময় জগতে; যে দ্বিজাতি-তত্ত্বকে আমরা পরাভূত করেছিলাম ওই একাত্তরে। এ দ্বিজাতি-তত্ত্ব হলো জাতপাত-ভেদ-বিভেদ-অসমতা-বৈষম্য-সাম্প্রদায়িকতা-তেঁতুলতত্ত্ব ও সশস্ত্র জঙ্গিবাদের ডাইনি-জননী।

কিছুই গোপন নয়; সব প্রকাশ্য। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পরের দুই দিনের প্রতিক্রিয়া ও পাল্টা-প্রতিক্রিয়া প্রকাশকারীদের প্রত্যেকের পরিচয় বিচার করে দেখলে খুব স্পষ্টভাবে দেখা যায় টিপের পক্ষ নিয়েছে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ, ব্যক্তিস্বাধীনতা ও সাংবিধানিক অধিকারের পক্ষের ব্যক্তিবর্গ; এদের বিরুদ্ধে সরব হয়ে ওঠেছে জামাত-বিএনপি-হেফাজতের পাণ্ডারা; বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে অবস্থানরত পাকিস্তানের আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রেতাত্মারাও বাগিয়ে সাতচল্লিশের হাওয়া চাগিয়ে ওঠে দু’হাজার বাইশে।

সুতরাং পুরো বিষয়টি ক্ষুদ্রার্থে রাজনৈতিক ও বৃহদার্থে ‘সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা’র পক্ষ-বিপক্ষের লড়াই। এটা হেলাফেলার বা সামান্য বিষয় নয়। এ বিষয়টিতে পরে আরও কিছুটা মনযোগ দেয়া হবে।

তিন.

জাসদের আজকের সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার এমপি একাত্তরে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন আজিমপুর কলোনীর পুঁচকে মেয়েদের দিয়ে গঠিত এক মেয়েবিচ্ছু বাহিনী। এ বাহিনীর মেয়েবিচ্ছু লিনু হকের ফেইসবুক পোস্ট থেকে মাঝরাতের আগেআগে জানতে পারলাম টিপ নিয়ে পুলিশ বাহিনীর এক সদস্যের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের কথা। আমার মনে হলো এ পুলিশটি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সদস্য। সাথে সাথে গুগুল সার্চ ইঞ্জিনের দ্বারস্থ হলাম; বেশিক্ষণ আগের নিউজ নয়, ঘটনা যদিও সকালের— বেশ কিছু সাইটে খবরটি এসেছে। সব পড়ে ডাউনলোড করে নিলাম। ছোট্ট একটি বার্তা লিখলাম।

চেষ্টা করলাম সারাদেশের বাউলদের সংগঠন ‘পল্লী বাউল সমাজ উন্নয়ন সংস্থা’র ফেরদৌসি নাজমা’র সাথে যোগাযোগ করতে। তার আন্তরিক সহযোগিতায় এর আগে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জামাত-বিএনপি-আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের অশুভ নেতৃত্বে বাউলদের চুল কেটে দেয়ার বিরুদ্ধে সাধারণ বাউলদের প্রতিবাদ গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছিল; সাধারণ জনগণকেও প্রতিবাদে শামিল করা গিয়েছিল; জাতীয় সংসদে জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু এমপি প্রধানমন্ত্রি শেখ হাসিনাকে এ বিষয়ে প্রশ্নও করেছিলেন। কিন্তু ফেরদৌসি নাজমাকে পেলাম না। অগত্যা রাত একটা নয় মিনিটে জাসদ সমর্থিত বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও বর্তমানে জাসদের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক আব্দুল্লাহিল কাইয়ূমকে ফোন করে অনুরোধ করলাম দলের দিক থেকে অবস্থান নিতে। আর ছোট্ট বার্তাটি বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ও ইউরোপ-আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থানরত বাংলাদেশের শতাধিক নারী ও পুরুষকে প্রেরণ করা হলো— তাদেরকে টিপ পরিহিত ছবি পোস্ট করতে, পরিচিতদের উদ্বুদ্ধ করতে তাদের অনুরোধ করা হলো; ঘনিষ্ঠদের কয়েকজনকে অনুরোধ করা হলো প্রাতিষ্ঠানিক ও আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানাতে। রাত তিনটায় আমার ভাগ্নি স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী সামিহা বুশরা নোভাও পড়াশোনার চাপের মধ্যেও এতদঞ্চলে টিপ পরিধানের প্রাগৈতিহাসিক-ঐতিহাসিক রেফারেন্সসমেত ছোট্ট একটি ফেইসবুক পোস্ট দিল। গর্বে বুক স্ফীত হলো; অনুপ্রাণিত বোধ করলাম।

সারা রাত না ঘুমিয়ে অনেকের সাথে মতবিনিময় করা হলো। আম্মা মাঝে মাঝে এসে বলে যাচ্ছেন ঘুমোতে যেতে। রোজা রাখার জন্য জেগে ওঠা নারী-পুরুষ পুলিশের এ হীন অপরাধের বিরুদ্ধে সেহেরির সময় থেকে তাদের প্রতীকি প্রতিবাদের সূচনা করলেন। আমার দল জাসদের জন্য একটি বিবৃতির খসড়া তৈরি করে সকাল ছয়টায় ঘুমোতে গেলাম। সকাল আটটায় ওঠে আরও কিছু ব্যক্তির সাথে যোগাযোগ সেরে বিবৃতির দ্বিতীয় খসড়া জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু এমপি, সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার এমপি, যুগ্মসাধারণ সম্পাদক আব্দুল্লাহিল কাইয়ূম ও দফতর সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেনকে প্রেরণ করা হলো সকাল নয়টা পঞ্চাশে। এখানে মনে রাখা দরকার দুটো বিশেষ বিষয়— প্রথমত, হাসানুল হক ইনু সংবিধানের সর্বশেষ সংশোধনী কমিটির সদস্য হিসেবে সংবিধানের সাম্প্রদায়িক আবর্জনা বর্জনের জন্য লিখিত প্রস্তাব প্রদানের পাশাপাশি কমিটিতে চূড়ান্ত সুপারিশমালার কতিপয় সাম্প্রদায়িক উপাদানের বিরুদ্ধে লিখিত আপত্তি ও সংসদ অধিবেশনে প্রকাশ্য আপত্তিসমেত জাসদের অবস্থান ব্যক্ত করেছেন, আর দ্বিতীয়ত , শিরীন আখতার এমপি ২৫ মার্চকে ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করার প্রস্তাব উত্থাপন করে সংসদের সকল সদস্যের সম্মতিক্রমে তা অর্জন করেছেন ও ২৫ মার্চ গণহত্যার স্বীকৃতি আদায়ের এক বিশ্বপরিসরবিস্তৃত প্রচারাভিযানের উদগাতা হয়েছেন। উপরন্তু, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তি ও জাসদ প্রতিষ্ঠার সুবর্ণ জয়ন্তি উদযাপনের বছরে জাসদ সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা মোকাবেলাকে একটি বিশেষ রাজনৈতিক কর্তব্য ও কর্মসূচি হিসেবে গ্রহণ করেছে। অন্যান্য বামপন্থি দল ও বিবিধ রাজনৈতিক মতাদর্শের ব্যক্তিদের সাথেও মতবিনিময় করা হয়েছে— কিন্তু দ্রুততম সময়ে প্রকাশ্য রাজনৈতিক অবস্থান গ্রহণ করেছে কেবল জাসদ।

জাসদের বিবৃতির দ্বিতীয় খসড়াটি ছিল—

“পুলিশ বাহিনীতে অবস্থানরত তেঁতুলতত্ত্বের প্রেতাত্মার বিচার ও সাজা দাবি”

“জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটির সভাপতি হাসানুল হক ইনু এমপি ও সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার এমপি আজ ৩ এপ্রিল ২০২২ এক বিবৃতিতে গতকাল ২ এপ্রিল ২০২২ সকাল আনুমানিক ৮টা ২০ মিনিটে ফার্মগেইট এলাকায় তেজগাঁও সরকারি কলেজের শিক্ষক ড. লতা সমাদ্দার টিপ পরিধান করায় তাকে পুলিশ বাহিনীর এক সদস্য কর্তৃক অশ্লীল গালিগালাজ ও তার গায়ের ওপর বাইক চালিয়ে দেয়ার ঘটনার তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন; দায়ী পুলিশ সদস্যের গ্রেফতার, বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শান্তি দাবি করেছেন; এবং অবিলম্বে পুলিশ বাহিনী থেকে তাকে বহিস্কারের দাবিও জানিয়েছেন।

“নেতৃবৃন্দ বিবৃতিতে বলেন কোন ব্যক্তি টিপ পড়বেন কি পড়বেন না, দাড়ি রাখবেন নাকি কেটে ফেলবেন, নিজ গৃহে কোরান পাঠ করবেন না দেবি কালির পূজা করবেন— তা তার বিশ্বাস ও অভিরুচির বিষয়, ব্যক্তিস্বাধীনতা ও সাংবিধানিক অধিকার। এসবের বিরুদ্ধে পুলিশ কর্তৃক সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে গালিগালাজ, আক্রমন বা গ্রেফতার করা পুলিশের বেআইনী ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ বাড়াবাড়ি— পুলিশ বাহিনীর এসব সদস্য হেফাজ-জামাত-বিএনপি’র প্রেতাত্মা। এদেরকে যথোপযুক্ত শাস্তি প্রদান করা না হলে পুলিশ, প্রশাসন ও সরকার অসভ্যতার দাসানুদাস হিসেবে বিবেচিত হবে— তেঁতুলতত্ত্বের প্রেতাত্মারা বাংলাদেশকে নরকে পরিণত করবে।

“হাসানুল হক ইনু এমপি ও শিরীন আখতার এমপি ২ এপ্রিলের ঘটনার জন্য পুলিশ বাহিনীর দায়ী ওই সদস্যের দ্রুত অপসারন-বিচার-শাস্তির জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রি ও পুলিশ মহাপরিদর্শকের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধান চান ও অনতিবিলম্বে তাদের ব্যাখ্যা দাবি করেন। জাসদ নেতৃবৃন্দ দায়ী পুলিশ সদস্যকে খুঁজে পেতে ও তার শাস্তি নিশ্চিত করতে জনগণের সক্রিয় সহযোগিতা কামনা করেন।”

সকাল ১১টার দিকে ফোন করলেন জাসদ সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার এমপি। ধমকে দিলেন, “বিবৃতির খসড়া পাঠিয়ে বসে থাকলে চলবে? ব্রিফিং কোথায়?” আসলে তার ফোনের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। রাতে পড়া ও ডাউনলোড করা সকল সংবাদের সারমর্ম তার কাছে উপস্থাপন করা হলো সুসংহতভাবে। এভাবেই সকল দেশের সকল রাজনৈতিক দল কাজ করে। দলের অপরাপর দায়িত্বশীল নেতৃবৃন্দের সাথে কথা বলে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের পরিমার্জিত চূড়ান্ত বিবৃতি দফতর সম্পাদক রিলিজ করলেন।

শিরীন আখতার এমপি সংসদের নির্ধারিত অধিবেশনে যোগ দিতে জাতীয় সংসদে গেলেন। নিজ দলের পক্ষে কথা বললেন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য সুবর্না মোস্তফার সাথে। আমাদের কৈশোরে কাঁদানোর-হাসানোর অভিনেত্রী সুবর্না মোস্তফা তার যোগ্য ভূমিকা রাখলেন। সংসদীয় রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় ডকুমেন্টেড হলো তার প্রতিবাদ। এ ডকুমেন্টেশন আগুনে ঘৃতাহুতি হলো। টিপকাণ্ডের পক্ষ-বিপক্ষ আরো সক্রিয় হয়ে গেল। অনেক ধন্যবাদ প্রিয় সুবর্না মোস্তফা এমপিকে তার ভূমিকার জন্য। এ ভূমিকার জন্য তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাম্প্রদায়িক-মৌলবাদি-জাঙ্গবাদি জামাত-বিএনপি-হেফাজতের বহুমাত্রিক নোংরা কটাক্ষেরও শিকার হয়েছেন।

চার.

টিপ-বিরোধী সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা, ব্যক্তিস্বাধীনতা ও ব্যক্তির সাংবিধানিক নাগরিক অধিকার আর সংশ্লিষ্ট আরও অনেক বিষয়ে অনুপ্রাণিত ও স্বতপ্রণোদিত অনেকের সক্রিয় ভূমিকা থেকে জানতে ও শিখতে পারলাম অনেক কিছু।

আমার ভাগ্নি নোভা যেমন কয়েকটি সোসিও-অ্যানথ্রোপলজিক্যাল বিষয় নজরে এনেছে। আব্দুল্লাহিল কাইয়ূমের পোস্ট থেকে তেমনি মনে পড়লো শৈশব ও যৌবনের স্মৃতি; মনে পড়লো মা-খালা-ফুপুদের কাছে শোনা ঘুমপাড়ানিয়া লোকগান— পুত্র ঐতিহ্যকে দু’পায়ে শুইয়ে আমার বউয়ের ঘুমপাড়ানিয়া লোকগান—

আয় আয় চাঁদ মামা

টিপ দিয়ে যা,

চাঁদের কপালে চাঁদ

টিপ দিয়ে যা।

এ সুখস্মৃতি থেকে যারা আমাদের বঞ্চিত করতে চায় অকৃতজ্ঞ অভিশপ্ত তারা তলিয়ে যকি বিস্মৃতির গহীন অন্ধকারে— তারা ভুলে যাক তাদের মায়ের মুখ।

অস্তায়মান অথচ গাছের চূড়ায় আটকে পড়া সূর্যের ছবি ধরে মনজুরুল আজিম পলাশ লিখলেন এক অসামান্য বাক্য, “পৃথিবীর নিজেরই একটি ‘টিপ’ আছে! যা মানুষের কপালে এসেছে অনেক পরে...।”

কিন্তু মাহবুব টুঙ্কুর বাক্যটিই হলো টিপকাণ্ডের সার। বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার ছবি দিয়ে গাঢ় সবুজ জমিনে টকটকে রক্তলাল সূর্যকে ইঙ্গিত করে তিনি লিখলেন, “মূল সমস্যাটা হলো এই লাল টিপ। এটাকে ধারণ করতে পারা বা না পারা।”

আইসবার্গটিকে তিনি আমাদের কেতাবী ভাষা থেকে মুক্তি দিলেন। আসলে সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা কোনভাবেই বাংলাদেশকে ধারণ করতে পারেনা। আরও অগণিতজন বহুমাত্রায় শিক্ষিত করলেন আমাদের। ধর্মান্ধ কূপমণ্ডুকরাও বিবিধ রেফারেন্সে লেজ নেড়ে ঘেউ ঘেউ করতে লাগলো।

পাঁচ.

সে ছোট বোনটি আমার বড় বড় টিপ ধারণ করে সবসময়। টেলিভিশনে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ, ব্যক্তিস্বাধীনতা, পছন্দের স্বাধীনতা, সাংবিধানিক অধিকার ও মানবাধিকারের বিবিধ মাত্রা নিয়ে অনেক কথা বলে। কে কী ভাবলো বা বললো তার তোয়াক্কা না করে অবলীলায় সে প্রকাশ করে নিজ মনোভাব ও মতামত। ২ এপ্রিল রাতেই সে মতামত দিল যে টিপ ধারণ করে ছবি পোস্ট করার মতো এনজিও মার্কা পুতুপুতু টাইপের কাজ করে কোন লাভ নেই; কিছু বিষয় পলিটিক্যালি ফেইস করা লাগে; রাজপথের সংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে। ছাত্রজীবনে বামপন্থি একটি সংগঠনে যুক্ত থাকা এ প্রিয় বোনটি এখন চরমভাবে আওয়ামী লীগের সমর্থক হলেও সে আওয়ামী লীগকেও বিশ্বাস করতে পারছে না। সুবর্ণা মোস্তফা এমপি কর্তৃক বিষয়টি সংসদে উত্থাপনের খবরটি কিছুক্ষণের মধ্যে তাকে জানালে সে বলেছিল যে ওটা ওখানেই থেমে যাবে, পুলিশও রেহাই পাবে কারণ সে ব্যক্তির বাইকের নাম্বার পুলিশের না বলে জানা গেছে।

ও একদম ভুল বলেনি। ও অভিজ্ঞতা থেকেই বলেছে। কিন্তু অভিজ্ঞতার মাত্র একটা দিক সে মনে করতে পেরেছে। সে নিজে যুদ্ধাপরাধ বিরোধী গণজাগরণমঞ্চের কট্টর সমর্থক ছিল— আর গণজাগরণ মঞ্চের প্রধান মবিলাইজেশন টুল ছিল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম।

ওর আর ওর মতো অনেকের আশঙ্কাকে ভুল প্রমাণ করে দায়ী পুলিশকে কিন্তু ধরা হয়েছে; সামান্য ব্যবস্থাও নেয়া হয়েছে। তবে কচ্ছপের মতো কামড়ে ধরে না থাকলে পুলিশ রেহাই পেয়ে যাবে— এও সত্যি। বহু ক্ষেত্রেই তা হয়েছে।

লেগে থাকতে হয়। ও ভুলে গিয়েছে দিনাজপুরের ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যা আর প্রতিবাদী জনগণের ওপর খালেদা জিয়ার পুলিশবাহিনীর গুলি বর্ষনের জন্য বিচারে তিন পুলিশ সদস্যদের ফাঁসি হয়েছে এনজিওরা লেগে ছিল বলে— ওই ঘটনা নিয়ে রাজনৈতিক আন্দোলন হয়নি, কোন রাজনৈতিক দল লেগে ছিল না; তবে কোন কোন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এডাব ও সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের কোর্স অব অ্যাকশন নির্ধারণে ভূমিকা রেখেছেন। এনজিওগুলোর সে ভূমিকা কি অগ্রহণযোগ্য?

জাসদ সমর্থিত বাংলাদেশ ছাত্রলীগের মিরপুরের নেতা কামরুল ইসলাম মমিনকে খুন করেছিল পুলিশ বাহিনীর দোর্দণ্ডপ্রতাপশালী চাঁদাবাজ কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম। ছাত্রলীগের ভূমিকা আর অসংখ্য হুমকি ও প্রতিবন্ধকতা উপক্ষো করে কামরুলের ভাইরা সমগ্র পুলিশবাহিনীর বিরুদ্ধে লেগে ছিল বলে সে পুলিশ কর্মকর্তার ফাঁসির রায় ঘোষিত হয়েছিল। অবশ্য ফাঁসি কার্যকর হবার আগেই ফাঁসির ভয়ে একদা দোর্দণ্ডপ্রতাপশালী সে ওসি রফিকুল ইসলাম ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে কারাগারে মারা গেছেন।

ছোট বোনটি আমার বলেছে টিপের বিষয়টি রাজনৈতিকভাবে দেখতে হবে। হ্যাঁ, রাজনৈতিকভাবে দেখতে হবে। রাজনৈতিকভাবে দেখার বিষয় কেবল রাজপথে অবস্থানের বিষয় নয়। মনে রাখা দরকার রাজনীতি বা অর্থনীতি বা ধর্ম বা নন্দনসংস্কৃতি হলো হলো সংস্কৃতির এক একটি ক্ষুদ্রতর অংশ। সংস্কৃতি একটি সমগ্রক— একটি জীবনধারা। সাংস্কৃতিক আন্দোলন হলো রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের আন্দোলনের চেয়েও নিবিড় ও গভীর এক দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া— যে কারণে ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনকে কিংবা মাও সেতুঙকে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ডাক দিতে হয়েছিল— যদিও মাও সেতুঙের সে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের অধীনে কিছু শিশুসুলভ খামখেয়ালিপনা ও কাণ্ডজ্ঞানহীনতাও পরিচালিত হয়েছিল। ইটালির নিও মার্কসিস্ট আন্তোনিও গ্রামসি অধিপতি শ্রেণির ‘হেজিমনি’র বিপরীতে ‘কাউন্টার হেজিমনি’ প্রতিষ্ঠার কথা বলেছিলেন। মার্কসবাদের অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণবাদী পশ্চাদপদ চিন্তাচেতনার বিরুদ্ধে কার্ল মার্কসের বন্ধু ও মার্কসবাদের অপর জনক ফেডরিখ এঙ্গেলস উৎপদন পদ্ধতির ওপর উপরকাঠামোর নিয়ন্ত্রণবাদি ভূমিকার দিকে কথিত মার্কসবাদিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। বিপ্লবের নামে মার্কসবাদিদের অনেকে ইতিহাসে ব্যক্তির ভূমিকাকে অস্বীকার করতে চান— অথচ গেওর্গ প্লেখানভের মতো পণ্ডিত-রাজনীতিক বা লেনিনের মতো সফল বিপ্লবী ‘রেভ্যুলুশনারি ক্রিয়েটিভ জিনিয়াস’দের কথা বলেছেন— যেসব ব্যক্তি ইতিহাসের কালপর্বকে সংক্ষিপ্ত করতে ভূমিকা রাখতে পারেন ও বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করতে পারেন।

রাজনীতি ও বিপ্লবের নামে রাজনীতি ও বিপ্লবের বিরুদ্ধে বহু বক্তব্যই উপস্থাপিত হয়। রাজনৈতিক ও বৈপ্লবিক শিক্ষার ঘাটতিই তার কারণ।

সাংস্কৃতিক আন্দোলন একটি ক্যাম্পেইনের মতো। ক্যাম্পেইন সমরশাস্ত্রের ভাষা— এর অর্থ সামগ্রিক যুদ্ধ। ক্যাম্পেইনকে বাংলায় প্রচারাভিযান বললে কম বলা হয়। ইরাকে আমেরিকার যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়ার বিষয়টি লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে সে যুদ্ধের নগণ্য অংশ ছিল সামরিক; অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক, নান্দনিক, সাংস্কৃতিক, মনস্তাত্ত্বিক ইত্যাদি বহুবিধ মাত্রা ছিল সে যুদ্ধের। আর হ্যাঁ, এভাবেই যুদ্ধ করতে হয়।

টিপ-বিরোধী পুলিশী অপরাধের বিরুদ্ধে— কিংবা বৃহদার্থে সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা মোকাবেলার সংগ্রামের একটা মাত্রা হবে রাজনৈতিক ও রাজপথের। এর আরও বহু মাত্রা থাকবে। কোনটিই অপ্রয়োজনীয় বা পরিত্যাজ্য নয়— যদ্দুর সম্ভব সকল পন্থার ব্যবহার করতে হবে। সমাজ জটিল ও ক্যাওটিক— পরিবর্তনও তাই।

ছোট বোনটি বলেছিল টিপ নিয়ে আমি অবুঝকাণ্ড করছিলাম। যদিও ওর এ বাক্যের আগেই ওকে বলেছিলাম যে প্রতিবাদ কোন একসূত্রীয় পন্থা নয়, সকল প্রতিবাদ বহুমাত্রিক। রাজনীতি ও বিপ্লবের জন্য সামাজিক স্তরবিন্যাসের সকল পর্যায়েই লোক লাগে— সর্বনিম্ন স্তর থেকে স্তরবিভাজন-পিরামিডের সর্বোচ্চ শিখর পর্যন্ত। ওকে বলেছিলাম মিছিলে বা রাজপথে সকলের অংশগ্রহণ আশা করা অবৈজ্ঞানিক। বলেছিলাম, যার যতোটুকু ক্ষমতা ও ইচ্ছা— সে ততোটুকু করবে; কাউকে জোর করার কিছু নেই বা কাউকে তার ভূমিকা রাখার অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখার অধিকার কোরো নেই। কেউ হয়তো বন্দুক নিয়ে লড়াই করবে; কেউ হয়তো মিছিল করবে। কেউ কবিতা লিখবে। কেউ গান গাইবে। কেউ ছবি আঁকবে। এর কোনটি অপ্রয়োজনীয়?

এডোয়ার্ড বার্নেট টেইলর সংস্কৃতির যে সংজ্ঞা দিয়েছেন— তা প্রায় সবই কাভার করে। একে সমাজবিজ্ঞানী ও নৃবিজ্ঞানীগণ আরও সম্প্রসারিত করেছেন। সিম্বলিক অ্যান্ড ইন্টারপ্রেটিভ অ্যানথ্রোপলজি একটি অত্যন্ত প্রভাবশালী জ্ঞানকাণ্ড। আমেরিকার নৃবিজ্ঞানী ক্লিফোর্ড গিয়ার্টজ জার্মান সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ভেবারকে সূত্র ধরে এর বিকাশ ঘটিয়েছেন। অপেক্ষাকৃত নবীন এ জ্ঞানকাণ্ড সংস্কৃতির প্রতীক অধ্যয়ন করে থাকে এ যুক্তিতে যে একটি নির্দিস্ট সমাজ অনুধাবনের জন্য জনগোষ্ঠির ব্যবহৃত প্রতীকের অধ্যয়ন জরুরি।

একুশে ফেব্রুয়ারি মহান শহীদ দিবসে আমরা কালো ব্যাজ পরিধান করি কেন? ১৯৬৯ সাল থেকে আওয়ামী লীগের মাঘা বাঘা নেতাদের বিরোধিতার মুখেও রাজপথে আমরা জয়বাংলা ধ্বনি দিয়েছি কেন? বিভিন্ন দিবসে লাল ও সবুজ আলোয় আমরা ভবন ও রাজপথ সাজাই কেন? ট্রাফিক সিগনাল বোঝা কেন সকল নাগরিকের জন্য জরুরি? প্রতীক অর্থহীন নয়; প্রতীকের ভূমিকা অসামান্য।

সবচেয়ে অক্ষম ও দুর্বলতম ব্যক্তিটিও কি নিজের টিপ পরিহিত ছবি প্রকাশ করে তার মতামত ও মনোভাব ব্যক্ত করেনি? এ অধিকার কি তার নেই? তারা তো কাউকে রাজপথে সংগ্রাম করতে বাধা দেয়নি! আমার বোনটি রাজপথে মিছিল করুক না! হাজার হাজার মানুষের লাল টিপ পরিধান করে ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করে কি সরকার-প্রশাসন-পুলিশ বাহিনীর ওপর চাপ তৈরি করতে পারেনি? সংসদে কি বিষয়টি উত্থাপিত হয়নি? দায়ী পুলিশ কি গ্রেফতার হয়নি? টিপের পক্ষ-বিপক্ষের টিপকাণ্ডে ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের উগ্র প্রচারণার বিরুদ্ধে সৌন্দর্যময় টিপ কি প্রতিরোধী ডিসকোর্স ও আইডিওলজিতে কনট্রিবিউট করছে না?

টিপের শক্তি আছে। সেজন্যই তো আমার বউয়ের কপালে লাল টিপ এত ভালোবাসি; সে টিপপরিধান করতে না চাইলে তার ব্যক্তিস্বাধীনতা মেনে নেই— নিভৃতে-গভীরে-গহীনে কষ্ট পেলেও।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সম্পাদক, লড়াই।

পূর্বপশ্চিম- এনই

টিপকাণ্ড,টিপ
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close