• শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

ইট পাথরের হৃদয়!

প্রকাশ:  ২৬ এপ্রিল ২০২২, ০১:৪৪
জি এম কিবরিয়া

ঢাকায় ভাল ইস্কুল, কলেজ কিংবা ভাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অভাব নেই!

ছাত্ররা ভাল রেজাল্ট করছে আগামীতেও করবে! হয়তো তারা ভাল চাকুরি করছে অথবা করবে! সেটা নিয়ে অভিভাবকদের মন আল্লাদে আটখানা হোক কিংবা না হোক, তা নিয়ে আমরা ভাবনা নহে!

শুধু জিজ্ঞেসিবো, তাঁরা কি ভাল আছে? ভাল থাকবে? সুখে আছে কিংবা সুখে থাকবে?

এই প্রশ্নের উত্তর মুখে বলার দরকার নেই! আপনি অস্থির নগরবাসীর মুখশ্রী দেখলেই সহজে অনুধাবন করতে পারবেন, এই নগরীতে মানুষ কতটা বিরক্তি নিয়ে রাস্তায় চলাচল করে! যদিও তারা কেউ কারোর দিকে তাকানোর সময় নেই! তবুও পরখ করে দেখবেন, ঢাকাবাসীর কপালে কয়টি বিরক্তির ভাজ!

কেন?

তারা সময় মতো অফিসে যেতে পারছে না, শিশুকে সহজে স্কুলে পাঠাতে পারছে না, এ্যাম্বোলেন্সটি রোগী নিয়ে একটানা সাইরেন বাজিয়েই চলছে, কেউ পাত্তা দিচ্ছে না; চারদিকে শব্দ দুষণের তীর তাদের মগজে ঢুকে একেবারে এলোমেলো করে দিচ্ছে; নাক দিয়ে যে বাতাস ঢুকছে তাতে ধুলিবায়ুও বলতে পারেন! অথবা ধরুন, আপনি চুপচাপ ভদ্রলোক হয়ে গাড়িতে বসে যানজট উপভোগ করছেন! হঠাৎ দেখবেন একটি মোটর সাইকেল আপনার প্রিয় গাড়িটির গায়ে লাঙলের ফলা চালিয়ে চলে গেল বীর দর্পে! অথবা গাড়ির লুকিং গ্লাসটি মচ করে ভেঙ্গে দৌড়ে পালালো এক মাদকাসক্ত !

মশাই, মেজাজ কিভাবে ঠিক রাখবেন? তাইতো রাস্তায় এত বিরক্তি, এত প্রতিযোগিতা, এত অসহিষ্ণুতা, এত অস্থিরতা!

হয়তো আপনি চাকরি করছেন,ব্যবসা করছেন, ফ্ল্যাট-গাড়ির স্বপ্নও দেখছেন, ছেলে-মেয়েকে নামিদামী স্কুলে পড়াচ্ছেন; কিন্তু সুখে আছেন কি?

শেষ কবে হেসেছেন মনে করুন তো? একটি ফুটন্ত ফুল বা বৃক্ষের পানে অপলক তাকিয়েছেন কবে মনে পড়ে? মনে পড়ে চাঁদের সাথে মিতালি করেছেন কবে?

কি মশাই! থ হয়ে গেলেন যে!

বন্ধু মহলে এরূপ জিজ্ঞেস করেছি, আমাদের প্রজন্মের অধিকাংশই মাথা দুপাশে নাড়িয়েছে। তাদের বলেছি, দেখ, তোমরা দিগন্ত জোড়া মাঠ দাবড়িয়ে, নদী-পুকুরে সাতরিয়ে, মুক্ত বাতাসে শ্বাস নিয়ে, ঘুড়ি উড়িয়ে, মাছ ধরে, খেলাধুলা করে বড় হয়েছো! তবুও আজ ভাল নেই; শুধু বিরক্ত আর বিরক্ত হচ্ছো! ভীষণ বিরক্ত! কারণ কি? এই ঢাকায় থাকাই হলো এখন সমস্যা!

কেন? কারণ ঢাকা আমাদের সমৃদ্ধি দিয়েছে কিন্তু সহানুভূতি বা সুখানুভূতি কেড়ে নিয়েছে!

অথচ দেখুন, যে শিশুটি একটি সুন্দর শৈশব পেল না; একটি উঠোন পেল না, খেলার মাঠ পেল না, ফুল-পাখির সাথে মিতালি করার সুযোগ পেল না; সে তার বড় বেলায় এসব কিছু ফিরিয়ে দেবে না সমাজকে? নগরবাসীকে? যে ছাত্রটি শৈশবের দুরন্তপনা পেলো না, পেল এক বন্দি জীবন! অর্থাৎ খাঁচা (বাসা) থেকে খাঁচা (গাড়ি), তারপর আবার খাঁচা (স্কুল/কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয়)! এভাবে চরম বিরক্তি নিয়ে বড় হচ্ছে। তার সাথে আছে 'এ' প্লাসের চাপ! হয়তো ভাল রেজাল্ট করছে বা করবে, হয়তোবা সে ভাল চাকরি বা ব্যবসাও করবে! এরূপ শৈশবহীন বা রুক্ষ, কর্কশ এক শৈশবে বেড়ে উঠা একটি প্রজন্ম থেকে এদেশ বা এ সমাজ কিভাবে সু-সভ্য বা এক সু নাগরিক দল আশা করে?

ইট পাথর দিয়ে অট্টালিকা বানিয়ে আকাশ ছোয়া, আর সুসভ্য বা সুনাগরিক বা সোনার মানুষ হয়ে মুক্ত বিহঙ্গের মতো আকাশে উড়ে বেড়ানো, এক কথা নয়! মনুষত্ব এভাবে জাগ্রত হয় না! শিশুর ভিতরের শিশুটির যত্ন না নিলে সে মানুষকে মানুষ বলে মূল্যায়ন করতে শিখবে না! আর নাগরিক সেবা? মনে রাখতে হবে, যে শিশুটি আজকে চরম বিরক্তি ও অস্থিরতা নিয়ে কিংবা আমাদের প্রজন্মের প্রতি বিদ্বেষ নিয়ে বেড়ে উঠছে, তার কাছ থেকেই একদিন আপনাকে আমাকে নাগরিক সেবা নিতে হবে। সেদিন কড়ায় গন্ডায় সে আপনার নাগরিক সেবা বুঝিয়ে দেবে।

আসুন, এই শহরটিকে শিশুর উপযোগী করে গড়ে তুলি। শিশুর উপযোগী প্রকারান্তরে মানুষের বসবাস উপযোগী এক সুন্দর নগরী। এ জন্য সরকারের পাশাপাশি আমাদেরও যথেষ্ট দায়িত্ব আছে, যা অত্যন্ত পবিত্র দায়িত্ব! রাস্তায় অযথা হুরাহুরি না করি, অযথা হর্ণ না বাজাই, রাস্তা-ঘাটে ময়লা আবর্জনা না ফেলি। জনগণের চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি করে রাস্তা বা ফুটপাতে দোকান না বসাই!

এখানে সিটি কর্পোরেশন বা আইন প্রয়োগকারি সংস্থাগুলোরও ব্যাপক ভূমিকা রাখতে হবে। যদিও ইতোমধ্যেই উত্তর সিটি কর্পোরেশন কিছু খাল উদ্ধার করে জনগনের প্রশংসা পেয়েছে। তেমনি দখলকৃত মাঠ, পার্ক, খাল বা জলাশয়, ফুটপাত ইত্যাদি দখলমুক্ত করে জনগণের জীবন ও মননের বিকাশ ঘটাতে সরকার যথেষ্ট আন্তরিক হবে এটা সকল নাগরিকেরই কামনা।

অনেক রক্তের দামে কেনা আমাদের দেশ। এর সমৃদ্ধির জন্য যেমন ইট পাথরের উন্নয়ন দরকার; তেমনি এই দেশকে সোনার বাংলায় পরিনত করতে দরকার সোনার মানুষ। মানুষের মনন ও সৃজনের সাধন ছাড়া সোনার মানুষ কি সম্ভব হবে? মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি, লালনের বানী কি মিথ্যে?

যে দেশে মানুষের মূল্য বেশি হবে, মানুষের কল্যাণেই হবে নগরায়ন কিংবা প্রকৃতির মায়া অক্ষুন্ন রেখেই হবে সমৃদ্ধি; সেই সোনার দেশ চাওয়া কি খুব বেশি চাওয়া?

আমরা যা করছি তা, ক্রমশ ইট পাথরের হৃদয় তৈরীতে মনোনিবেশ করাছি! মনে রাখবেন, সামনে আসছে একটি ইট পাথরের প্রজন্ম! সাবধান!

লেখক: ক্লিন এন্ড গ্রিন ফাউন্ডেশন এবং গরিব ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা।

পূর্বপশ্চিম- এনই

কলাবাগান মাঠ
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close