• শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

মোসাহেবিপনা ও এর সুফল!

প্রকাশ:  ২৭ মে ২০২২, ২৩:১৫ | আপডেট : ২৮ মে ২০২২, ১২:১০
মনজুর রশীদ

এক, দুই তিন...!

সবাই উপরে উঠতে চাইছে! কেউ উপত্যকার প্রারম্ভে, মাঝপথে কিংবা আরও কিছুটা উপরে উঠেও ক্ষান্ত হতে চাইছেনা। সবার চাই উপরে উঠতে! এই উপরে ওঠায় কোন প্রতিযোগিতা নেই। ভৃত্যের মতো, কাঙালের মতো, দলদাসের মতো যেমনটা করা উচিৎ, সবাই তাই করছে। ঘুষ, দূর্নীতি এসব নতুন নয়, এসবের সাথে ক্রমাগতভাবে জড়িয়ে পড়ছে বাংলা ভাষায় মুঘল ও উপনিবেশ আমলের বেশকিছু নেতিবাচক বলিষ্ঠ শব্দভাণ্ডার। সিনেমা বা নাটকের কাহিনীতে যতো ঘটনার ঘনঘটাই থাকুক বা না থাকুক, তার যেমন একটা নামকরণ হয় যেমন 'চাটুকার মন্টু' - একইভাবে এর সমার্থক শব্দ হিসাবে তোষামোদি, মোসাহেবি, তেল মর্দনকারি ইত্যাদি নামকরণও করা যেতে পারে। নিজের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য সত্য-মিথ্যা এবং কপটতার মিশেলে উর্ধ্বতনকে তুষ্ট করার জন্য যিনি এটা করছেন, তিনি তা বুঝেশুনেই করছেন এবং যাকে করছেন তিনিও এটা বুঝতে পেরেও বিষয়টা বেশ উপভোগ করে থাকেন এবং আত্মতুষ্টিতে ভোগেন। প্রতিদানে তিনি তাকে খুশী হয়ে বা প্রভূভক্ত কুকুর বানিয়ে উপরে ওঠার ব্যবস্থা করে দিয়ে থাকেন। ঘুড়ির লাটাইটা নিজ হাতে রেখে তিনি তাকে দিয়ে নানারকম অপকর্ম করানোর ব্যবস্থাও পাকাপোক্ত করেন!

উচ্চ লক্ষ্য, উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও জীবনে বড় হওয়ার ইচ্ছা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। বিরোধিতার খাতিরে বিরোধিতা না করলে হয়তো প্রত্যেকেই স্বীকার করবেন নিজের উচ্চ লক্ষ্য ও বড় হওয়ার দূর্বার আকাঙ্ক্ষার কথা। উচ্চাকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে ব্যক্তিমাত্রই সচেষ্ট হয়। কেউ সফল হয়, কেউ হয় না। গন্তব্যে পৌছার পথ-পন্থা-পদ্ধতি ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হয়। অনেকে পরিশ্রম, ধৈর্য, অধ্যবসায় ও আত্মবিশ্বাসের কথা বলেন। পরিশ্রম ও অধ্যবসায় অনেক কষ্টলব্ধ বিষয়। ধৈর্য ধরারও 'ধৈর্য' অনেকেরই থাকে না। তাই সাফল্য পেতে অনেকে সহজ পদ্ধতির সন্ধান করেন। এ জন্য বেছে নেন চাটুকারিতার মতো একটা বহুল কার্যকরী পদ্ধতি। বিশেষ করে পরিবেশ, প্রতিবেশ ও চারপাশ জুড়ে যারা অস্বাভাবিক ও মারাত্মক অনৈতিক পরিস্থিতি তৈরি করে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন, তাদেরও দরকার পড়ে নিয়ন্ত্রিত ও চরম অধস্তন একটা গোষ্ঠী - যারা অর্ধেক অনুভূতিহীন, অর্ধেক অসচেতন ও সম্পূর্ণভাবে 'জো হুকুম' বলায় অতিমাত্রায় পারদর্শী! বুদ্ধিমান তোষামোদকারিগণ এ ব্যাপারে ওয়াকিবহাল যে, বড় পর্যায়ে শুধু প্রশংসা শুধুমাত্র একটা ঋণ, কিন্তু চাটুকারিতা হলো একটা বড় ও দীর্ঘমেয়াদী উপহার!

কারো অহেতুক, অতিরিক্ত, কখনো বা অনুপস্থিত গুণাবলির প্রশংসা করে তার মাধ্যমে লাভবান হওয়ার ব্যক্তিত্বহীন ও নির্লজ্জ প্রয়াস আমাদের সমাজের স্বাভাবিক চিত্র। এটা সকল শাসনামলে দেখা গেলেও কোন কোন শাসনামলে এসবের তীব্রতা প্রকটভাবে চোখে পড়ে এবং প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের পর্যায়ে পৌঁছে যায়। এ সময় তোষামোদকৃত ব্যক্তির কোনো ব্যর্থতা বা দোষ তোষামোদকারীর দৃষ্টিগোচর হয় না, কিংবা এলেও তা উল্লেখ করা হয় না। প্রত্যেক ব্যক্তির জীবনে, বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্নভাবে, স্বনামে-বেনামে এদের সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে। তবে প্রতিষ্ঠিত কোনো ব্যক্তি, কোনো প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা, সরকার ও প্রশাসনের উর্ধ্বতন ব্যক্তি সাধারণত অধস্তন ব্যক্তির তোষামোদের শিকার হন। এসময় অনেকেই ভুলে যান - তোষামোদ সাধারণত ক্ষমতা ও অর্থের পিছু নেয়। এদের কারো ক্ষমতা কিংবা অর্থ ফুরালে তোষামোদকারীও আর তার ছায়া মাড়ায় না। প্রতিষ্ঠান, সমাজ বা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা যখন এর শিকার হন, তখন তারা আমোদে গদগদ হন। আর নিজের দূর্বলতা, ব্যর্থতা বা অযোগ্যতা সম্পর্কে সঠিক ও সম্যক ধারণা না থাকার কারণে প্রতিষ্ঠান বা রাষ্ট্রের জন্য মারাত্মক ক্ষতি বয়ে আনেন। সুন্দরের প্রশংসা, ভালো কাজের বাহবা অবশ্যই প্রাপ্য। কিন্তু যখন মানুষের প্রশংসা কিংবা গুণকীর্তন মাত্রা ছাড়িয়ে যায়, তখনই এটা চাটুকারিতার পর্যায়ে পড়ে।

বন্ধুদের অনেকেরই অভিযোগ - বর্তমান সময়ে অফিস-আদালতে চাটুকারিতার বিস্তার প্রকট আকার ধারণ করেছে। কারণ সবাই জানে উর্ধ্বতনকে তুষ্ট করতে পারলেই তো পাওয়া যায় কাঙ্ক্ষিত সুবিধা। সেটা হতে পারে পদোন্নতি, পছন্দসই নিয়োগ-বদলি কিংবা যে কোনো আনুকূল্য। আপনি কর্মে যতই পেশাদার হন না কেন, বড় কর্তাকে তুষ্ট করতে না পারলে প্রতিযোগিতার ইঁদুর দৌড়ে আপনি কেবলই পেছনে পড়তে থাকবেন। তাই নিজের ব্যক্তিত্বকে বিসর্জন দিয়ে আপনাকেও শামিল হতে হবে চাটুকারদের দলে। আর আপনার প্রখর ব্যক্তিত্ববোধ যদি আপনাকে অবচেতন মনে এ কাজ করতে বাধা দেয়, তবে শত দায়িত্বশীলতার পরও পদে পদে আপনি হবেন হয়রানির শিকার। সহকর্মীরা আপনাকে নিয়ে পেছনে হাসাহাসি করবে, আপনাকে বাঁকা চোখে দেখবে, এমনকি কর্মকর্তার কাছে আপনার আনুগত্য হতে পারে প্রশ্নবিদ্ধ! পরিণামে আপনার জীবন হয়ে উঠতে পারে দূর্বিষহ। আপনি অনেক প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন, প্রতিনিয়ত নানা ধরনের অপবাদ ও হেনস্তার স্বীকার হবেন!

তাই বলে কি সবাইকে চাটুকর বা তোষামোদি বলা ঠিক হবে? মোটেও না। বড় বড় কর্মকর্তা ও সহকর্মীদের আনুকূল্য না পাওয়ার পরও এখনো খুঁজে পাওয়া যাবে অনেক ন্যায়নিষ্ঠ, সৎ ও নীতিবান মানুষ যারা চাটুকারিতার গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেয়নি, ক্ষমতার পালাবদলের সাথে পটিয়সী চাটুকারদের মতো আপন স্বার্থসিদ্ধির জন্য গিরগিটির মতো অনায়াসে রূপ পরিবর্তন করেনা। মেরুদন্ড শক্ত রেখেই অযাচিত চাটুকারকে কোনোভাবে প্রশ্রয় দেন না। যারা এখনো দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন - উর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে তার অধীনস্তের মূল্যায়ন হতে হবে যোগ্যতার ভিত্তিতে, তেল মারার ওপর নয়। এতে যা হবার হবে। অন্যায়ের কাছে মাথা নোয়ানোর চেয়ে গ্লানিকর কিছু হতে পারেনা। চাকুরি থাকুক বা না থাকুক, পদোন্নতি হোক বা না হোক - এর বেশি আর কি হবে? স্যালুট জানাই এসব বীরদের! কিন্তু আফসোস, জাতি বঞ্চিত হয় এসব গুণী ব্যক্তিদের যথাযথ সেবা থেকে!

লেখক: গবেষক, সমাজ বিশ্লেষক ও সংস্কৃতি কর্মী

মনজুর
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close