• শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

শিক্ষায় কেমন প্রভাব ফেলবে চ্যাটজিপিটি

প্রকাশ:  ৩০ জুন ২০২৩, ১৫:৩০
হাবিবুল হক খন্দকার

সম্প্রতি বাংলাদেশের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিদর্শনের সময় আমার এক সহকর্মী জানতে চেয়েছিলেন, চ্যাটজিপিটি কীভাবে শিক্ষায় প্রভাব ফেলতে পারে। একজন শিক্ষক হিসেবে আমি চ্যাটজিপিটির বিশাল সম্ভাবনা দেখি।

সামাজিক বিজ্ঞানের ভাষায় জ্ঞান হলো- তথ্য, দৃষ্টিভঙ্গি ও সমালোচনামূলক মূল্যায়নের সমন্বয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সামাজিক চিন্তাধারা বিষয়ে একটি ক্লাস নিতে গিয়ে জন লক বা কার্ল মার্কসের জীবনী নিয়ে শিক্ষার্থীদের তথ্য উপস্থাপন করতে বললেন শিক্ষক। তারা চাইলেই চ্যাটজিপিটি দিয়ে এই দুই দার্শনিকের সংক্ষিপ্ত জীবনীর ওপর খসড়া প্রতিবেদন বানিয়ে ফেলতে পারবেন।

এরপর শিক্ষক লক কিংবা মার্ক্সের ধারণার বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি এবং ব্যাখ্যা যোগ করতে পারেন। এছাড়া, সমাজে তাদের অবদানের মূল্যায়ন করতে বলতে পারেন।

চ্যাটজিপিটি শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের বিকল্প নয়। বরং এটি শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আরও স্মার্ট এবং তথ্য-সচেতন করে তুলবে।

চ্যাটজিপিটিকে মূল্যায়নের ক্ষেত্রে অবশ্যই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) ভূমিকাটি জানতে হবে। কারণ ধারণা তৈরি ও সেটি ভাগাভাগি করে নেওয়ার ক্ষেত্রে এআই বড় ভূমিকা রাখে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এমন এক পদ্ধতি যেটি পারস্পরিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।

অত্যাধুনিক এই প্রযুক্তিটি চিন্তার ভিন্নতা দিলেও এটিকে খুব বেশি আলাদা করা যায় না। বরং এটি মূলত সহযোগী হিসেবেই কাজ করে থাকে। গবেষণা, কোডিং, কপিরাইটিং ও অ্যাপ্লিকেশন বানাতেও কাজে আসতে পারে এ প্রযুক্তি।

চ্যাটজিপিটির “জিপিটি” হলো, চ্যাট জেনারেটিভ প্রাক-প্রশিক্ষিত ট্রান্সফরমার। জিপিটি-১, জিপিটি-২, জিপিটি-৩-সহ ভাষা মডেলগুলো জিপিটি সিরিজ ও তাদের নিউরাল নেটওয়ার্ক মডেল। এগুলো কোনো নির্দেশনা ছাড়াই ইনপুট করা তথ্যের ভিত্তিতে কাজ করে থাকে।

এর মধ্যে ট্রান্সফরমার অংশটি জিপিটি মডেলের ব্যবহৃত নিউরাল নেটওয়ার্কের আর্কিটেকচারকে বোঝায়। এটি ভাসওয়ানি এট আল-এর ২০১৭ সালের একটি গবেষণাপত্রে দেখানো ট্রান্সফরমার মডেলের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছে।

টেক্সট ডেটাতে দীর্ঘ আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার দক্ষতার কারণে প্রাকৃতিক ভাষা প্রক্রিয়ার ট্রান্সফরমার আর্কিটেকচারের এই মডেলটি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

চ্যাটজিপিটি মূলত শিক্ষা নিয়ে দেওয়া অ্যালগরিদমের ভিত্তিতে তৈরি। এটি মানুষের ভাষার বিশাল ডেটাসেটের ওপর প্রশিক্ষিত। এতে ভাষা ও বক্তব্যের ধরন শনাক্তে বিপুল পরিমাণ তথ্য ইনপুট করা রয়েছে। ফলে এটি ব্যবহারকারীর প্রশ্নের নির্ভুল ও অর্থপূর্ণ জবাব দিতে পারে।

মডেলটি ব্যবহারকারীদের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে নিজেকে পরিমার্জিত ও হালনাগাদ করে আরও সঠিক ও কার্যকর হয়ে উঠছে।

চ্যাটজিপিটির উল্লেখযোগ্য সুবিধার মধ্যে একটি হচ্ছে, বাস্তব-বিশ্বের কথোপকথন থেকে শেখা এবং বিভিন্ন প্রসঙ্গ ও ভাষার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষমতা।

এর মানে হলো, এটি বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের মধ্যে যোগাযোগের সুবিধা দিতে পারে। আন্তঃসাংস্কৃতিক যোগাযোগ ও সহযোগিতার জন্য একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হতে পারে।

এছাড়া ব্যবহারকারীর প্রশ্নের তাৎক্ষণিক ও পার্সোনালাইজড প্রতিক্রিয়া দিতে পারে চ্যাটজিপিটি। ফলে এটি তথ্য বা সহায়তা চাওয়া ব্যক্তির জন্য চমৎকার একটি মাধ্যম।

ফ্যাক্ট-চেকের জন্য ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে আমি চ্যাটজিপিটিকে আমার সংক্ষিপ্ত জীবনী করে দিতে বলেছিলাম, যা অনেকটাই নির্ভুল ছিল। যদিও এটি আমাকে একজন বাংলাদেশি মার্কিন হিসেবে চিহ্নিত করেছে। কারণ আমি ইউনিভার্সিটি অব কানেকটিকাটে শিক্ষক হিসেবে কর্মরত রয়েছি।

এটি পুরোপুরি সঠিক না হলেও প্রশংসনীয় ছিল। মার্চের শুরুতে আমার এক ছাত্র এটি ফের যাচাই করে। যেখানে এটি আমার বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরির কথা উল্লেখ করতে পেরেছে। ফলে বলা যায়, এমনকি ব্যবহারকারীর কাছ থেকে প্রতিক্রিয়া নিয়েও এই প্ল্যাটফর্মটির টেক্সট ডাটাবেস ক্রমাগত উন্নত করার সুযোগ রয়েছে।

অনেক সুবিধা থাকা সত্ত্বেও, চ্যাটজিপিটির সম্ভাব্য পরিণতি সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে অনেকেই। বিশেষ করে গোপনীয়তা, নিরাপত্তা এবং সামাজিক প্রভাবের ক্ষেত্রে। একটি এআই প্রযুক্তি কাজ করার জন্য এটি বিপুল পরিমাণে ব্যক্তিগত ডেটার ওপর নির্ভর করে। ফলে এই প্রক্রিয়ায় একজন ব্যক্তির গোপনীয়তা কতটা লঙ্ঘন হবে, সেটি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

এছাড়া চ্যাটজিপিটির সঙ্গে শেয়ার করা সংবেদনশীল তথ্যের নিরাপত্তার বিষয়ে উদ্বেগ রয়েছে। এছাড়া এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিভ্রান্তি ছড়ানো বা অন্যান্য ঘৃণ্য কার্যকলাপ ছড়িয়ে পড়ারও ঝুঁকি রয়েছে।

আমাদের পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগের উপায় পরিবর্তন করে চ্যাটজিপিটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নিয়মগুলোকেও প্রভাবিত করতে পারে।

একটি এআই মডেল হিসেবে মানুষের মতো কথোপকথন অনুকরণের জন্য নির্মিত চ্যাটজিপিটি প্ল্যাটফর্ম। এটি মানব ও মেশিনের মধ্যে যোগাযোগের ভিন্নতাকেও অস্পষ্ট করে দিতে পারে। যা যোগাযোগের সামাজিক নিয়মের জন্য অপ্রত্যাশিত পরিণতি ডেকে আনতে পারে।

উদাহরণ হিসেবে অনেক বিশেষজ্ঞ, লিঙ্গ স্টেরিওটাইপগুলোকে শক্তিশালী করতে ও পক্ষপাতদুষ্ট ভাষার ধরনকে স্থায়ী করতে চ্যাটজিপিটির ঝুঁকিপূর্ণ সম্ভাব্যতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

এছাড়া শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকরা উদ্বিগ্ন, শিক্ষার্থীরা তাদের লেখালেখিতে সহায়তা করার জন্য সম্পূর্ণরূপে চ্যাটজিপিটির ওপর নির্ভর করবে। যেহেতু চ্যাটজিপিটি প্রাকৃতিক ভাষায় প্রতিক্রিয়া দিতে পারে ও এসব জবাব অনলাইনে সংরক্ষণ থাকে না। ফলে শিক্ষার্থীদের নকল করার কোনো ঘটনা শিক্ষকদের জন্য ধরা বেশ দুরূহ হয়ে পড়বে।

তবে এটা সত্যি, চ্যাটজিপিটি একটি অত্যন্ত পরিশীলিত এআই প্রযুক্তি। যার বহু সুবিধা রয়েছে। এগুলো আমাদের শেখার পদ্ধতিকে রূপান্তরিত করতে পারে। আবার এটিতে এমন অনেক উদ্বেগের বিষয়ও রয়েছে, ফলে এটি সতর্কতার সঙ্গে দেখতে হবে। যাতে অনিচ্ছাকৃতভাবে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা না ঘটে।

তবে এটা বাস্তব যে, চ্যাটজিপিটি শিক্ষণ ও শেখার হাতিয়ার হিসাবে দারুণ ও অনিবার্য হিসেবেই আসছে।

লেখক- সামাজিক বিজ্ঞানের অধ্যাপক ও বিশ্বায়ন অধ্যয়নের বিশেষজ্ঞ, জায়েদ ইউনিভার্সিটি, আবুধাবি, সংযুক্ত আরব আমিরাত।

চ্যাটজিপিটি
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close