• সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

অর্ধশিক্ষিত নেতৃত্ব দল এবং দেশের জন্য বিপজ্জনক

প্রকাশ:  ২৩ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০৭
সৈয়দ বোরহান কবীর

সম্পর্কিত খবর

    অশিক্ষিত বা নিরক্ষর মানুষের চেয়ে অর্ধশিক্ষিত মানুষ দেশের জন্য ক্ষতিকর। অশিক্ষিত ব্যক্তি জানেন তার সীমাবদ্ধতার কথা। একারণে তিনি অন্যের কথা শোনেন। শিক্ষিত মানুষের পরামর্শকে গুরুত্ব দেন। নিজের সিদ্ধান্ত অন্যের ওপর চাপিয়ে দিতে চান না। কিন্তু অর্ধশিক্ষিত মানুষ নিজের সীমাবদ্ধতা অনুভব করেন না। নিজেকে তিনি সবজান্তা মনে করেন। জ্ঞানী মানুষকে অশ্রদ্ধা করেন। নিজের সীমিত জ্ঞানেই তিনি নিজেকে মহাপন্ডিত ভাবেন। নিজের জ্ঞানের ওপর তার অগাধ আস্থা থাকে। অন্যের গুরুত্বপূর্ণ ভালো উপদেশকেও এই অর্ধশিক্ষিতরা পাত্তা দেন না। অর্ধশিক্ষিতরা নিজেকে, পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রকে বড় ধরনের সংকটের মুখে ঠেলে দেন।

    সম্প্রতি লন্ডনে পলাতক বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক জিয়ার ভিডিও বার্তা দেখে এসব কথা মনে হলো। বেগম জিয়ার শিক্ষাগত যোগ্যতা কি তা সবাই জানেন। তিনি নিজেও তার সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। তাই তিনি চুপচাপ থাকতেন। কথা বলতেন কম, শুনতেন বেশী। অন্যান্যদের পরামর্শে তিনি দল চালাতেন। দুই মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীও ছিলেন। মন্ত্রীসভা বৈঠক কিংবা দলের গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে তিনি গালে হাত দিয়ে সবার কথা শুনতেন। এরপর যেটি তার মনে ধরতো সেই সিদ্ধান্তটি নিতেন। জিয়ার মৃত্যুর পর এভাবে তিনি বিএনপিকে শক্তিশালী করেছেন। দুইবার তার নেতৃত্বে এই দলটি সরকারও গঠন করেছেন। বেগম জিয়ার দুর্ভাগ্য যে তার দুই ছেলের একজনও লেখাপড়া শিখে মানুষ হতে পারেনি। প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকোর শিক্ষাদীক্ষা নিয়ে কথা বলতে চাই না। এটা শোভনও নয়। কিন্তু বেগম জিয়ার বড় ছেলে তারেক জিয়া আসলে একজন ‘অর্ধশিক্ষিত’ ব্যক্তি হিসেবেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তারেক জিয়াকে নিয়ে তার পিতা জিয়াউর রহমানও বিরক্ত ছিলেন। তিনি কোথায় কি লেখাপড়া করেছেন তা অস্পষ্ট, রহস্যময়। কিন্তু আমি ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার চেয়ে স্বশিক্ষিত একজন মানুষ অনেক বেশী উজ্জল এবং আলোকিত হন। বিশ্বে এরকম বহু বরেণ্য ব্যক্তিত্ব আছেন যারা স্বশিক্ষায় মহিমান্বিত। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ থেকে ইন্দিরাগান্ধী। বিল গেটস কিংবা স্টিভ জবস-প্রত্যেকে জীবন থেকে শিখেছেন। প্রকৃতি, পারিপার্শ্বিক শিক্ষায় আলোকিত হয়েছেন। কিন্তু তারেক জিয়া সে পথে যাননি। বরং দুর্নীতি, দূর্বৃত্তায়ন, প্রতারণা ইত্যাদি শিক্ষায় নিজেকে একজন অর্ধশিক্ষিত রাজনীতিবিদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। মানুষ ক্ষমতা, নীতি নৈতিকতার শিক্ষা পরিবার থেকে পায়। তারেক জিয়া পরিবার থেকে কি শিখেছেন, আমি জানি না, কিন্তু একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে তিনি দুর্নীতি এবং সন্ত্রাসের প্রতীক হিসেবে প্রায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। রাজনীতির চিরায়ত সত্য গুলোকে অস্বীকার করে তারেক জিয়া রাজনীতিকে এক নতুন ধারা সৃষ্টি করেছেন।

    সাদামাটা ভাবে রাজনীতি বলতে আমরা বুঝি জনকল্যাণ, মানুষের সেবা করা। মানুষের জন্য জীবন উৎসর্গ করা। দেশ এবং জনগণকে পথ দেখানো। কিন্তু তারেক জিয়া ২০০১ সাল থেকে রাজনীতির নতুন অর্থ ‘আবিস্কার’ করেছেন। রাজনীতি তার কাছে ‘শর্টকাটে’ বড়লোক হবার রাস্তা। তারেক জিয়া রাজনীতিকে ব্যবহার করে ‘হাওয়া ভবন’ বানিয়েছিলেন। ব্যবসা থেকে চাকরি, টেন্ডার থেকে মন্ত্রী- সব কিছুতেই তিনি কমিশন প্রথা চালু করেন। বাংলাদেশকে টাকা ছাড়া কিছু না হওয়ার এক রাষ্ট্র বানিয়ে ফেলেন তারেক। রাজনীতির একটি ভালো দৃষ্টান্ত তিনি স্থাপন করেন নি। বরং সব কিছুকে নষ্ট করতে তিনি ব্যবহার করেছেন রাজনীতিকে। প্রধান বিচারপতির বয়স বাড়িয়ে তাকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান করা, যেন বিএনপির ক্ষমতায় থাকা নিশ্চিত হয়, তারেকের আবিস্কার। নির্বাচন কমিশনে একান্ত অনুগতদের বসিয়ে দেড় কোটি ভুয়া ভোটার সৃষ্টি, তারেকের উদ্ভাবন। সাতজনকে ডিঙিয়ে অনুগত ব্যক্তিকে সেনাপ্রধান করা, সেনা নিয়ন্ত্রণ, তারেকের মস্তিষ্ক প্রসূত। এরকম অসংখ্য উদাহরণ দেয়া যায়। রাজনীতিকে তিনি এক ভয়ংকর পঙ্কিল পথে নিয়ে যান। এসব পুরনো কথা। তারেকের বেপরোয়া স্রষ্টাচারের জন্যই দেশে এক-এগারো আসে। তারেক গ্রেপ্তার হন। এক পর্যায়ে, বিএনপির সাথে সমঝোতায় তারেককে জামিন দেয়া হয়। রাজনীতি না করার মুচলেকা দিয়ে তিনি লন্ডনে যান। বহু মানুষের জীবনে দেখেছি কঠিন পরিস্থিতি তাদের জীবন বদলে দিয়েছে। এরকম নির্বাসন জীবনে অনেকে নিজেকে পরিশুদ্ধ করার সুযোগ পেয়েছেন। অনেকে নিজেকে আবিস্কার করেছেন। আমি ভেবিছিলাম লন্ডনে গিয়ে তারেক আত্মশুদ্ধির সুযোগ পাবে, আয়নায় নিজেকে দেখবে। তার পরিণতির কারণ অনুসন্ধান করবে। লেখাপড়া করবে, নিজেকে নতুন করে গড়ে তুলবে। কিন্তু কিছু কিছু মানুষের মনোজগত এতোই পঙ্কিল যে, তারা বদলায় না, বরং আরও হিংস্র, জঘন্য, এবং ভয়ংকর মানুষে পরিণত হয়। তারেক জিয়া তেমনি একজন। ১৭ বছর লন্ডনে থেকে তারেক বদলায় নাই বরং আরও বেশি দূর্বৃত্ত হয়ে উঠছেন। রাজনীতির মৌলিক ধারা এবং তারেকের দর্শন সাংঘর্ষিক এবং সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী। রাজনীতিতে শর্টকাট কোন পথ নেই। রাজনীতি হলো প্রতিনিয়ত প্রবাহমান নদীর মতো। কিন্তু তারেকের রাজনীতি হলো শর্টকাটে বড় লোক হওয়া অথবা শর্টকাটে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা, শর্টকাটে ক্ষমতা দখল করা। শর্টকাটে বড় লোক হবার জন্য তারেক হাওয়া ভবন বানিয়েছিল। শর্টকাটে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য তারেক ২১ আগষ্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনা ঘটিয়েছিল। শর্টকাটে ক্ষমতা দখলের জন্য এখন তারেক চলন্ত ট্রেনে নিরীহ মানুষের ওপর আক্রমণ করছে, বাসে আগুন দিচ্ছে।

    তারেক যদি অশিক্ষিত হতেন, তাহলে দেশে এতো সমস্যা হতো না। বিএনপি এভাবে জ্বালাও পোড়াও করতো না, নির্বাচনে যেত। তারেক যদি সুশিক্ষিত হতেন তাহলে এক-এগারোর পর ‘তওবা’ করে রাজনীতি ছেড়ে দিতেন। কিন্তু তারেক অর্ধশিক্ষিত। এজন্য নিজেকে রাজনীতির মাঠে পাকা খেলোয়াড় মনে করে। বাপের বয়সী সিনিয়র নেতাদের নাম ধরে ডাকে। তাদের অপমান করে। একজন বয়সে সিনিয়র মানুষের প্রতি নূন্যতম শ্রদ্ধাবোধ দেখানোর শিষ্টাচার তার মধ্যে নেই। তারেক অর্ধশিক্ষিত জন্যই দল চলে তার একক কর্তৃত্বে। দলে কোন কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক হয় না, স্থায়ী কমিটি ক্ষমতাহীন। বিএনপি এখন যারা করে তারা সবাই তারেকের চাকর-বাকর ছাড়া আর কিছু না। বিএনপিতে এখন জমিদার তন্ত্র চলছে। আর অর্ধশিক্ষিত জমিদার দলকে যে কি বিপদে ফেলতে পারে তার সর্বশেষ উদাহরণ, বিএনপির নির্বাচন বর্জন এবং জনবিচ্ছিন্ন আন্দোলন।

    বিএনপির জমিদারের সর্বশেষ অর্বাচীন সিদ্ধান্ত হলো অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা। অর্ধশিক্ষিতরা যে কত বড় কান্ডজ্ঞানহীন হয় তার সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ হলো গত বুধবার বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের ভিডিও বার্তা। যে দেশে বিরোধীদল ঠিকঠাক মতো একটা হরতাল করতে পারে না, সে দেশে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক স্রেফ তামাশা। ঐ ভিডিও বক্তব্যে তারেক যা বলেছে, তা এক কথায় রাষ্ট্রদ্রোহীতা। একজন সুস্থ্য মানুষ কি এধরনের দায়-দায়িত্বহীন ঘোষণা দিতে পারে? ১০ মিনিটের বেশি ঐ ভিডিও বার্তা দেখে আমার মনে হয়েছে, তিনি যেন জনগণকে শাসাচ্ছেন, ধমকাচ্ছেন। কথাবার্তার ধরনে পক্ষের আবর্জনার দুর্গন্ধ।

    অসহযোগ আন্দোলন মানে কি তারেক জানে? বিনীত ভাবে এই প্রশ্নটি আমি বিএনপির নেতাকর্মীদের কাছে করতে চাই। সাম্প্রতিক সময়ে এই ভিডিও বার্তা এবং এরকমের আরও কিছু কথাবার্তা থেকে সুস্পষ্ট হয়েছে, তারেক জিয়া তার পরিবার, দল এবং দেশের জন্য ক্ষতিকর। তারেক জিয়ার হাতে তার মা নিরাপদ নন। বেগম জিয়ার এই পরিণতির জন্য দায়ী একজনই, তার পুত্র তারেক জিয়ার হাতে বিএনপি নিরাপদ নয়। আজ যে বিএনপর বেহাল দশা, তার জন্য একমাত্র দায়ী তারেক জিয়া। তারেকের হাতে বাংলাদেশ নিরাপদ নয়। কোন দিন যদি এই মানব রূপী হিংস্র দানব সুযোগ পায়, তাহলে দেশটাকে ছারখার করে দেবে। তাই অর্ধশিক্ষিত তারেক জিয়াকে না বলুন।

    সৈয়দ বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত

    ই-মেইল: [email protected]

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close