• রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

প্রানের শহর বগুড়ায় একজন আব্দুস সামাদ থেকে ডঃ হোসনে আরা হয়ে উঠার গল্প

প্রকাশ:  ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১৯:১৮
নিজস্ব প্রতিবেদক

যা একদা মানুষের মুখে মুখে ফিরে বেরাতো। যিনি আমাদের পরিবারের ঘনিষ্ট জনও বটে। কারন তাঁর স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান টি এম এস এস এর ট্রেজারর ছিলেন আমার মরহুমা বোন মিভা আপা। করোনা কালীন সময়ে মিভা না ফেরার দেশে চলে যাবার পর হোসনে আরা আপা এন জি ও নেটওয়ার্ক এর মাধ্যমে অন লাইন ও অফ নাইনের মাধ্যমে বেশ কয়েকটি স্বরণ সভা করেন। এখনও মিভা আপার আমেরিকা প্রবাসী দুই মেয়ের খোঁজ খবর রাখেন। আমাদের অত্যান্ত স্নেহ করেন। সেসব কথা থাক।

গত সপ্তাহ থেকে যে কোনো আড্ডায় বসলে কিংবা ফেজবুকে উকি দিতেই চোখে পড়ে বর্তমান সময়ের সবচেয়ে আলোচিত শরীফ ও শরীফার প্রসঙ্গ। প্রগতিশীল সহ নানা শ্রেনী পেশার অনেক মানুষই দেখলাম বর্তমান সময়ের একটা চর্চিত ইস্যু শরীফ থেকে শরীফার বিষয়টা একদম শতভাগ ভুল বুঝে বসে আছে। তবে আমার মনে হয় ঐ গল্পে কি লিখা আছে এরা কেউ তা জানে না। চিলে কান নিয়ে গেলো মত অবস্থার অবতারনা হয়েছে মাত্র। যতোই যুক্তি তর্ক দিই না কেন এই সমস্ত তথাকথিত প্রগতির ধব্জাধারী মানুষগুলো পশ্চিমা ভাবধারায় প্রগতি আশ্রিত কায়দা কানুনে এ দেশ চলবে না বলেও দৃঢভাবে আশাবাদ ব্যাক্ত করছে। এসব নিয়ে তাদের যুক্তি একেবারে ঠুনকো। বিশ্বের বাস্তবতা থেকে তারা আছেন যোজন যোজন দূরে। আমি অবশ্য অসব বিষয় নিয়ে বেশী দূর আর অগ্রসর হলাম না কারন অরন্য রোদন করে কোন লাভ নেই এখন আর এসব নিয়ে তর্ক করতে মোটেই উৎসাহ তেমন পাই না। তবে বিষয়টি আমাকে গত এক সপ্তাহ যাবত অনেক ভাবিয়েছে। আমরা কি মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে এরকম পশ্চাতপদ ধ্যান ধারনার একটি দেশ চেয়েছিলাম? না তা অবশ্যই চাইনি।

শরীফ থেকে শরীফার গল্প নিয়ে সমাজে এখন তুমুল আলোড়ন। একদল বিবেকহীন যুক্তিহীন মানুষ লেখাটি পড়ে না পড়েই দেশ গেল ধর্ম গেল সমাজে অবক্ষয় হবে ইত্যাদি বলে শোরগোল পাকিয়ে তুলছেন।

আরেকদল শিক্ষিত মডারেট ইনিয়ে বিনিয়ে বলতে চাইছেন তৃতীয়লিঙ্গ মেনে নেয়া যায় কিন্তু ট্রান্সজেন্ডার? কিছুতেই না যদিও শরীফ থেকে শরীফার গল্পটি একটি খুবই স্পর্শকাতর মানবিক গল্প। একটি মানুষের প্রচন্ড নীরবে কষ্টের কথা একাকীত্বের কথা অল্প কথায় সরলভাবে তুলে এনেছে॥ এই মানুষ গুলি আগে ভোটাধিকার ছিলো না। পাসপোর্ট পেত না॥

বর্তমান সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদেরকে মূল ধারায় ফিরিয়ে এনে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্যেগ গ্রহন করেছেন। ব্যাংকে তাদের জন্য আলাদা ডেস্ক খোলা হয়েছে সেবা প্রদানের জন্য। এবার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রংপুর থেকে এদের প্রতিনিধি রানী ভোটে দাড়িয়ে তার আচার আচরন কথা বার্তায় মানুষকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে।

আমাদের এই আলোচিত রানী গল্পের শরীফাদের প্রতিনিধি।

এখানে তো আমাদের আর্থসামাজিক অবস্থা, শিক্ষা, পারিপার্শিকতা সমাজে মানবিক বোধসম্পন্ন মানুষের জন্ম দিতে পারছে না বলেই শিক্ষাবোর্ড ধন্যবাদ আর অভিনন্দন পাওয়ার বদলে একধরণের অযুক্তিক সমালোচনার সম্মুখিন হয়েছে। এই গল্পে কোথাও যদিও সমকামীতার কথা নেই, নেই ট্রান্সজেন্ডারের কথাও। আর ট্রান্সজেন্ডারের কথা থাকলেই কেন সমাজ অশুদ্ধ হয়ে যেত বা যাবে? সমকামিতাও সমাজে আস্তে আস্তে বাড়ছে। যা আগেও ছিলো কেউ প্রকাশ করতো না সমাজের রক্তচক্ষুর ভয়ে। পারিবারিক ভাবে এগুলো তখন চাপিয়েরাখা হতো লোক লজ্জার ভয়ে। এ্যামাজান প্রাইমে মেইড ইন হ্যাভেন দেখলেও এটা আরও সম্যক উপলব্ধিতে আসবে।মানুষ নিজে নিজে তোআর এই আংগিক মানসিক চারিত্রিক পরিবর্তন আনতে পারবে না তাহলে ? আমাদের প্রানের শহরের সেই গল্পটা বললে সবাই অনুধাবন করতে পারবে। আমাদের অনেক বন্ধু বান্ধব আত্বীয় স্বজন অগ্রজ অনুজেরা ভালবাসার শিহরন জাগানো সেই শহরে বড় হয়েছেন ॥ যারা অনেক ক্ষেত্রে আমার সাথে একমত হবেন আবার কেউ একমত নাও হতে পারেন। এটাই মক্ত চিন্তা -চেতনার সোসাল মিডিয়া।সবাই সবার ব্যক্তিগত মতামত দেবার ক্ষমতা সংরক্ষন করবেন। তবে দেশ জাতি রাষ্ট ধর্ম বর্ন এসব নিয়ে কোন কটাক্ষ করা যাবে না। স্বাধীনতা মানে অরাজকতা নয় স্বাধীনতা মানে অন্যের অধিকারও সংরক্ষন করা।

১৯৭৬ বা ৭৭ সাল কথা। আমি তখন বগুড়া জিলা স্কুলে পড়ি।রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র আব্দুস সামাদ একদিন নিজের মাঝে একটা অদ্ভুত পরিবর্তন অনুভব করলেন। পরিবর্তনটি শারিরীক এবং মানসিক উভয় ক্ষেত্রেই। এই পরিবর্তনের কথা লতিফ হলে অবস্থান করা তার সহপাঠীদের সাথে শেয়ার করতেও তিনি দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। ফলে পরামর্শ নিলেন একজন চিকিৎসকের। প্রাজ্ঞ সেই চিকিৎসক তার শরীরে ছোট্ট একটা সার্জারি করলেন। ব্যাস আব্দুস সামাদ হয়ে গেলেন হোসনে আরা বেগম। এরপর লতিফ হলের আব্দুস সামাদকে হোসনে আরা হয়ে চলে যেতে হল মন্নুজান হলে। ঘটনা এখানেই শেষ নয়, সদ্য রূপান্তরিত হোসনে আরা বেগম একদিন ঘোষণা দিয়েই লাল বেনারসি পরে বিয়ে করলেন ও রুমমেট ও সহপাঠী এক বন্ধুকে। উদারমনা বন্ধুটিও তাঁকে স্ত্রী হিসেবে সাদরে গ্রহণ করলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠীরা সেই অভূতপূর্ব বিয়েতে নেচে গেয়ে আনন্দ করলেন। সেই রূপান্তর আর বিবাহের গল্প সে সময় পত্র পত্রিকার খুব প্রচার পেয়েছিলো। এখন তিনি স্বামী, একমাত্র পুত্র আলী হায়দার ও পুত্র বধু নিয়ে বেশ সুখেই সংসার করছেন।

না, সেই রূপান্তর বা ট্রেন্সজেন্ডারের ঘটনা নিয়ে তখন কেউ কোথাও কোনো ঘৃণা উগড়ে দিয়েছে বলে শোনা যায়নি। মাদ্রাসা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ছাত্র একে ঘৃণ্য কাজ বলে সমালোচনা করেনি। অবশ্য মাদ্রাসায় তখন কিছু সংখ্যক মোল্লারা থাকলেও কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে তা ছিল একেবারেই কিঞ্চিত । তখন বিশ্ববিদ্যালয় প্রকৃত অর্থে মুক্ত বিদ্যা শিক্ষার পাদপিঠই ছিলো। যখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যাসয়ে পড়াশুনা করেছি তখনও কি সুন্দর ছিলো সামাজিক পরিবেশ অথচ এখনকার পরিবেশটাও তেমন ভালো লাগে না। ভেতরে ভেতরে কেমন যেন একটা উল্টো রথ যাত্রা। সুস্থ সংস্কৃতির চর্চা নাই বললেই চলে॥ আমরা দল বেধে নাটক দেখতাম। গ্রুপ থিয়েটার গ্রাম থিয়েটার, পথ নাটক উপন্যাস গল্প প্রবন্ধ কবিতা আমাদের ছিলো আলোচনার বিষয়।আর এখন চলছে মোবাইল বিপ্লব। এই অধপতিত পচা, গলা নষ্ট সমাজের রন্ধে রন্ধে দুর্নীতি স্বজন প্রীতি তোষন মর্দন ইত্যাদী চলছে সীমাহীন জোরে সোরে অর্থাৎ বর্তমানের এই ঘৃণাজীবী হাইব্রীড জেনারেশনের তখনও জন্ম হয়নি। সরকার তথা আধুনিক প্রগতিশীল মানুষরা হাজার চেষ্টা করেও মানুষের মনোজগতের দৈন্যতা অতিক্রম করতে পারবে না।নিজেই নিজেকে অতিক্রম করতে হবে নিরন্তর।আইন করে তো আর প্রতিক্রিয়াশীলতা রোধ করা যাবে না।

ছবির এই মানুষটিই এক সময়ের আব্দুস সামাদ এবং বর্তমানের ডঃহোসনে আরা বেগম। না, তিনি হেলাফেলারও কেউ নন। একজন শিক্ষাবিদ এবং সফল উদ্যক্তা তিনি। বগুড়া সরকারী মজিবর রহমান মহিলা কলেজ, কুড়িগ্রাম সরকারী কলেজ ও জয়পুরহাট সরকারী মহিলা কলেজে তিনি অধ্যাপনা করেছেন। ১৯৮০ সালে তিনি নিজ শহর বগুড়াতে ভিক্ষুকের মুষ্টি সংগ্রহের চাউল নিয়ে দেশের একটি শীর্ষ এন জিও প্রতিষ্টান ‘ঠেঙ্গামারা মহিলা সবুজ সংঘ (টি এম এস এস) গোড়া পত্তন করেন। টি এম এস এস আমাদের শহরে প্রথম ফাইভ ষ্টার হোটেল মম ইন প্রতিষ্ঠা করেন। আমাদেরকে ইনফিনিটি পুল দেখার সুযোগ করে দিয়েছে। বগুড়ায গড়ে তুলেছেন বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ, নার্সিং ইনিস্টিউট, স্কুল, মাদ্রাসা। সি এন জি ও পেট্রোল পাম্প, মার্কেট, হেলিকপ্টার সার্ভিস সহ অসংখ্য ব্যাবসা।

ডঃ হোসনে আরা তাঁর এই অসামান্য কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ‘অশোকা ফেলোশিপ’ এবং বেগম রোকেয়া পদক অর্জন করেন।

এবার আপনারাই বলুন ভার্সিটি পড়া সেই যুবক আব্দুস সামাদ সেদিন যদি তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত বিচক্ষণ সিদ্ধান্তটি না নিতেন, যদি সেই নমস্য চিকিৎসক তাঁর সার্জারিটি না করতেন, যদি আব্দুস সামাদ তার পরিবর্তনের কথা সহপাঠীদের সাথে শেয়ার করতেন।ফলাফল কী হতো? সহপাঠীদের ঠাট্টা মশকরা বুলিং এর শিকার হয়ে ক্ষোভ লজ্জা ঘৃণায় হয়তো তাঁকে একদিন হিজড়াদের আস্তানায় গিয়ে সেই গল্পের” গুরুমা”র কাছে উঠতে হতো। গাড়ী থামিয়ে থামিয়ে পয়সা তুলতে হতো বাচার তাগিদে। তিনি যদি সামাদ বা শরীফে আটকে থাকতেন তাহলে কি হতো তাহলে জাতি কি পেত পঞ্চাশ লাখ মানুষের ভাগ্য বদলানোর এই উদ্দোক্তাকে -যিনি কিনা এখনও একজন পরিশ্রমী বিনয়ী মানুষ।আমরা নিজেরাও তার অনেক সমালোচনা করি॥

আমাদের চোখের সামনে দিগন্ত ছোঁয়া সফলতায় ভাস্বর একজন ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিত্বের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত থাকার পরও যদি আমাদের চোখে ছানি পড়ে, তাহলে বলতে হবে আমরা আসলেই একটি ব্যর্থ জাতি। এই ব্যর্থতার দায় আমাদের সমাজ,সমাজ ব্যাবস্থার ও সমাজপতিদের।

কারণ পঞ্চাশ বছরেও এই সমাজ বিবেক সহমর্মীতা আর বোধবুদ্ধিসম্পন্ন একটি মানবিক প্রজন্ম তৈরি করতে পারেননি। মাত্র পয়তাল্লিশ পঞ্চাশ বছর পূর্বে যে রূপান্তরকে সমাজ সাদরে গ্রহণ করেছে আজ সেই রূপান্তরকে ভাবা হচ্ছে অপরাধ হিসেবে। কি সীমাহিন পতন আমাদের!

ব্রীজ কালভার্ট মেট্রোরেল আধুনিক এয়ারপোর্ট বড় বড় রাস্তাঘাটের উন্নয়নের পরও মানবিক উন্নয়নটিই আসল উন্নয়ন এবং তা তৈরি করতে আমরা একশত ভাগ ব্যর্থ হলাম কি কারনে তা আমাদের আরো ভেবে দেখতে হবে।

তাই বলছি, আসুন আমরা সকল কে নিয়ে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে একটি আধুনিক, মানবিক, প্রগতিশীল আগামী প্রজন্মের জন্য বাস যোগ্য সমাজ গড়ে তুলি।

আর সেটাই হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গড়া সম্বৃদ্ধ বাংলাদেশ।

বগুড়া,আব্দুস সামাদ,ড. হোসনে আরা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close