• রোববার, ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ

প্রকাশ:  ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:২৫
সৈয়দ বোরহান কবীর

গ্রামীণ কল্যাণ নিয়ে ড. ইউনূস এবং গ্রামীণ ব্যাংকের মধ্যে এখন কথার বাহাস চলছে। ড. ইউনূস দাবি করেছেন ‘গ্রামীণকল্যাণ’ তার প্রতিষ্ঠান। এটি ‘জবর দখল’ করা হয়েছে বলেও তিনি অভিযোগ করেছেন। অন্যদিকে ‘গ্রামীণ ব্যাংক’ আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন করে তথ্য প্রমাণ দিয়ে জানিয়েছে গ্রামীণ কল্যাণ তাদের।

ড. ইউনূস যখন আর্তনাদ করেন, তখন তার সাথে তার বন্ধুরাও কোরাস করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হোমড়া চোমড়া ব্যক্তি, জাতিসংঘের মহাসচিব ড. ইউনূস প্রসঙ্গে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। সবকিছু দেখে শুনে মনে হতেই পারে, সরকার এবং রাষ্ট্র তার প্রতি অবিচার করছে। ড. ইউনূস সংবাদ সম্মেলনে যেভাবে কথা বলছিলেন, তাতে মনে হচ্ছিল তিনি নির্যাতিত। আসলে কার বক্তব্য সত্য? ‘গ্রামীণ কল্যাণ’ আসলে কার?

১৯৮৩ সালের ৪ সেপ্টেম্বর সরকার গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশ নামে একটি অধ্যাদেশ (অধ্যাদেশ নম্বর-৪৬) জারি করে। সে সময়ে গ্রামীণ ব্যাংক শুরু হয় মাত্র তিন কোটি টাকা মূলধন দিয়ে। এরমধ্যে বেশিরভাগ টাকা অর্থাৎ ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা ছিল সরকারের এবং ১ কোটি ২০ লাখ টাক ছিল ঋণ গ্রহীতাদের।

অর্থাৎ গ্রামীণ ব্যাংকে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ব্যক্তিগত কোনো টাকা ছিল না। অথচ গ্রামীণ ব্যাংককে ব্যবহার করেই ড. ইউনূস পেয়েছেন সবকিছু। কাগজে কলমে গ্রামীণ ব্যাংকের মালিক সরকার এবং ঋণ গ্রহীতা জনগণ। কিন্তু ‘অসাধারণ’ মেধায় রাষ্ট্র ও জনগণের অর্থ ড. ইউনূস পুরে ফেলেন তার পকেটে। গ্রামীণ ব্যাংকের টাকায় ড. মুহাম্মদ ইউনূস গড়ে তুলেছেন নিয়ন্ত্রণাধীন ২৮টি প্রতিষ্ঠান এবং গ্রামীণ ব্যাংক তথা সরকারের টাকা আত্মসাৎ করে তিনি এখন হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন।

গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠার পর থেকেই দাতা গোষ্ঠী অনুদান এবং ঋণ দেয় গ্রামীণ ব্যাংককে। অনুদানের সব অর্থ যদি রাষ্ট্র এবং জনগণের কাছে যায় তাহলে ড. ইউনূসের লাভ কি? তাই দাতাদের অনুদানের অর্থ দিয়ে গঠন করলেন সোশ্যাল ভেনচার ক্যাপিটাল ফান্ড (এসভিসিএফ)। ১৯৯২ সালের ৭ অক্টোবর ওই ফান্ড দিয়ে আলাদা একটি প্রতিষ্ঠান গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

১৯৯৪ সালে ‘গ্রামীণফান্ড’ নামের একটি লিমিটেড কোম্পানি গঠন করা হয়। তাতে ওই ফান্ডের ৪৯ দশমিক ১০ কোটি টাকা স্থানান্তর করা হয়। গ্রামীণ ব্যাংক দেখিয়ে বিদেশ থেকে টাকা এনে তা সরিয়ে ফেলার চেষ্টা ছিল শুরু থেকেই। গ্রামীণ ব্যাংক সরকারি প্রতিষ্ঠান হলেও ড. ইউনূস প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে সব সিদ্ধান্ত একাই নিতেন। পরিচালনা পর্ষদ এমনভাবে গঠন করা হয়েছিল, যাতে কেউ ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে কথা না বলেন। ড. ইউনূস এই সুযোগটিই কাজে লাগান।

১৯৯৩ সালের ১৯ ডিসেম্বর গ্রামীণ ব্যাংকের ৩৪তম বোর্ড সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় সিদ্ধান্ত হয় দাতা গোষ্ঠীর অনুদানের অর্থ এবং ঋণ দিয়ে সোশ্যাল এডভান্সমেন্ট ফান্ড (এসএএফ) গঠন করা হবে। কিন্তু দাতারা গ্রামীণব্যাংক থেকে এভাবে অর্থ সরিয়ে ফেলার আপত্তি জানায়। দাতারা সাফ সাজিয়ে দেন, এভাবে অর্থ স্থানান্তর জালিয়াতি। এবার ভিন্ন কৌশল গ্রহণ করেন ড. ইউনূস।

২৫ এপ্রিল ১৯৯৬ সালে গ্রামীণ ব্যাংকের বোর্ড সভায় ‘গ্রামীণকল্যাণ’ গঠনের প্রস্তাব আনেন। প্রস্তাবে বলা হয়, গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্য ও কর্মীদের কল্যাণে‘ কোম্পানি আইন ১৯৯৪’ এর আওতায় গ্রামীণকল্যাণ নামের একটি প্রতিষ্ঠান গঠন করা হবে। গ্রামীণ ব্যাংকের বোর্ড সভা এই প্রস্তাব অনুমোদন করে। এটি গ্রামীণ ব্যাংকেরই অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। গ্রামীণ কল্যাণ যে গ্রামীণ ব্যাংকেরই শাখা প্রতিষ্ঠান, তা আরও স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় এর মূলধন গঠন প্রক্রিয়ায়।

গ্রামীণকল্যাণ-এ গ্রামীণ ব্যাংকের সোশ্যাল এডভ্যান্সমেন্ট ফান্ড (এসএএফ) থেকে ৬৯ কোটি টাকা দেয়া হয়। গ্রামীণ কল্যাণের মেমোরেন্ডাম অব আর্টিকেলে ও গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে এর সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ মেলে। মেমোরেন্ডাম আব আর্টিকেল অনুযায়ী গ্রামীণ কল্যাণের ৯ সদস্যের পরিচালনা পরিষদের ২ জন সদস্য গ্রামীণ ব্যাংকের মনোনীত প্রতিনিধি। এছাড়াও গ্রামীণকল্যাণের চেয়ারম্যান হবেন গ্রামীণ ব্যাংকের মনোনীত প্রতিনিধি।

সে অনুযায়ী গ্রামীণ ব্যাংকের মনোনীত প্রতিনিধি হিসেবে ড. ইউনূস গ্রামীণ কল্যাণের চেয়ারম্যান হন। এরপরে গ্রামীণকল্যাণ হয়ে ওঠে ড. ইউনূসের ‘সোনার ডিম পাড়া রাজহাঁস’। গ্রামীণ কল্যাণের মাধ্যমে তিনি গড়ে তোলেন একাধিক প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- ১.গ্রামীণ টেলিকম লিমিটেড ২. গ্রামীণ ডিস্ট্রিবিউশন লিমিটেড ৩. গ্রামীণশিক্ষা ৪. গ্রামীণ নিটওয়্যার লিমিটেড ৫. গ্রামীণব্যবস্থা বিকাশ ৬. গ্রামীণ আইটিপার্ক ৭. গ্রামীণ ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট ৮. গ্রামীণ সলিউশন লিমিটেড ৯. গ্রামীণ ডানোন ফুডস লিমিটেড ১০. গ্রামীণ হেলথ কেয়ার সার্ভিসেস লিমিটেড ১১. গ্রামীণ স্টার এডুকেশন লিমিটেড ১২. গ্রামীণ ফেব্রিক্স অ্যান্ড ফ্যাশন লিমিটেড ১৩. গ্রামীণ কৃষি ফাউন্ডেশন।

অন্যদিকে, গ্রামীণ কল্যাণের আদলে প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ফান্ডের মাধ্যমে গঠন করা হয় আরও কিছু প্রতিষ্ঠান। এগুলো হল- ১.গ্রামীণ ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড ২. গ্রামীণ সল্যুশন লিমিটেড ৩. গ্রামীণ উদ্যোগ ৪. গ্রামীণ আইটেক লিমিটেড ৫. গ্রামীণ সাইবারনেট লিমিটেড ৬. গ্রামীণ নিটওয়্যার লিমিটেড ৭. গ্রামীণ আাইটি পার্ক ৮. টিউলিপ ডেইরি অ্যান্ড প্রোডাক্ট লিমিটেড ৯. গ্লোব কিডস ডিজিটাল লিমিটেড ১০. গ্রামীণ বাইটেক লিমিটেড ১১. গ্রামীণ সাইবার নেট লিমিটেড ১২. গ্রামীণ স্টার এডুকেশন লিমিটেড ১২. রফিক আটোভ্যান মানুফ্যাকটার লিমিটেড ১৩. গ্রামীণ ইনফরমেশন হাইওয়ে লিমিটেড ১৪. গ্রামীণ ব্যবস্থা সেবা লিমিটেড ১৫. গ্রামীণ সামগ্রী।

মজার বিষয় হলো গ্রামীণ ব্যাংকের অর্থে এবং বোর্ড সভার সিদ্ধান্তের মাধ্যমে গ্রামীণ কল্যাণ এবং গ্রামীণ ফান্ড গঠিত হয়। এই দুটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যে প্রতিষ্ঠানগুলো গঠিত হয়েছে- তা সবই আইনত গ্রামীণ ব্যাংকের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। কিন্তু ২০২০ সাল পর্যন্ত গ্রামীণ ফান্ড এবং গ্রামীণ কল্যাণের পরিচালনা পর্ষদে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিনিধি থাকলেও ২০২১ সাল থেকে এই প্রতিষ্ঠান দুটিতে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিনিধি ছিল।

গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এ দুটি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান হবেন গ্রামীণ ব্যাংকের মনোনীত ব্যক্তি। কিন্তু ড. মুহাম্মদ ইউনূস এখনও গ্রামীণকল্যাণ এবং গ্রামীণ ফান্ডের চেয়ারম্যান পদে বহাল ছিলেন কোন ক্ষমতা বলে।

তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করলে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতাটির কথা মনে পড়ে। জমিদার তার বাগানের পরিধি বাড়ানোর জন্য গরিবের দুই বিঘা জমি দখল করে। এরপর এই নিঃস্ব ব্যক্তি সাধু বেশে ঘুরে যখন তার ভিটেতে ফিরে আসেন এবং একটি পরে যাওয়া ফল নেন, তখন তাকে চোর বানানো হয়। ড. ইউনূস যেন সেই জমিদার। গ্রামীণ ব্যাংকের গরিব মানুষের সম্পত্তি আত্মসাৎ করে তাদেরই এখন জবর দখলকারী বলছেন। হায়রে ‘তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে।’

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত

সৈয়দ বোরহান কবীর
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close