• রোববার, ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

বৈশ্বিক জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশের ভূমিকা

প্রকাশ:  ২০ মার্চ ২০২৪, ১৭:০৭
রাহুল ভট্টাচার্য্য

বাংলাদেশ একটি দুর্যোগপ্রবণ দেশ। গত দুই দশকে দেশে ১৮৫টি প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত হেনেছে। জলবায়ু ঝুঁকিতে সবচেয়ে বেশি আছে এদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ ও প্রকৃতি। বৈশ্বিক কার্বন নির্গমনে বাংলাদেশের ভূমিকা মাত্র ০.৪৭% হলেও ক্লাইমেট ভালনারেবল ইনডেক্স অনুযায়ী বিশ্বের ১৯২টি ঝুঁকিপূর্ণ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম।

অনেক সীমাবদ্ধতা নিয়েও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ এখন বিশ্বের কাছে ‘‘রোল মডেল’’ হয়ে উঠেছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশে এখন যে সিপিপি মডেল অনুসরণ ও সম্প্রসারণ করা হচ্ছে, এর পথিকৃৎ ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালেই বঙ্গবন্ধু সাইক্লোন প্রস্তুতি কর্মসূচি (সিপিপি) প্রস্তুত করেছিলেন। তিনি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার জন্য একটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তোলার ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন।

বাংলাদেশ এখন দুর্যোগ-পরবর্তী ত্রাণ কার্যক্রমের পরিবর্তে টেকসই দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নীতি গ্রহণ করেছে। উদ্ভাবনী অভিযোজন ও প্রশমন ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে জলবায়ু স্থিতিশীল একটি দেশে পরিণত হয়েছে। ২০০৯ সালে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ৪০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের একটি ক্লাইমেট ট্রাস্ট তহবিল গঠন করা হয়। এ পর্যন্ত ৪৮ কোটি মার্কিন ডলার ব্যয়ে প্রায় ৮০০টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগজনিত ক্ষয়ক্ষতি প্রশমনকে প্রাধান্য দিয়ে দীর্ঘমেয়াদি ডেল্টা প্ল্যান-২১০০ এবং অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে।

২০২২ সালে বাংলাদেশ জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে যেটিকে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। ২০৫০ সালের মধ্যে এই প্রকল্প বাস্তবায়নে ২৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের প্রয়োজন।

এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বাংলাদেশের প্রচেষ্টাকে সমর্থন করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক অংশীদারদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। এছাড়াও বাংলাদেশের জলবায়ুর দুর্বলতাকে জলবায়ু সমৃদ্ধিতে রূপান্তর করতে ‘‘মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনা’’ গ্রহণ করা হয়েছে। এ পরিকল্পনায় ২০৩০ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানি সক্ষমতা ৩০ শতাংশে উন্নীত করা, টেকসই কৃষি রক্ষণাবেক্ষণ এবং বিদ্যুৎ গ্রিডের আধুনিকায়নসহ জলবায়ু সহনশীলতার জন্য একটি রূপান্তরমূলক কৌশলের রূপরেখা দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি দেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় সরকার বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান, দ্বিপক্ষীয় উন্নয়ন সহযোগী ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো মিলে ‘‘বাংলাদেশ জলবায়ু ও উন্নয়ন প্ল্যাটফর্ম’’ (বিসিডিপি) নামের ৮০০ কোটি মার্কিন ডলারের একটি তহবিল গঠনের ঘোষণা দিয়েছে যে তহবিল থেকে অর্থ ব্যয় হবে সহযোগিতামূলক পদ্ধতিতে।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় সুষ্ঠু প্রশমন ব্যবস্থা গ্রহণের ওপর বাংলাদেশ জোর দিচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় এ পর্যন্ত সাত লাখেরও বেশি দুর্যোগ সহনশীল বাড়ি নির্মাণ করে সেগুলো বিনামূল্যে ভূমিহীন ও গৃহহীনদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। জলবায়ু বাস্তুচ্যুত মানুষদের পুনর্বাসনে কক্সবাজারে নির্মাণ করা হয়েছে ১৩৯টি পাঁচতলা ভবন। ১,৪০০ কিলোমিটার নদী ড্রেজিং ও পুনঃখনন করা হয়েছে এবং প্রায় ২২ হাজার কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে যা দুই কোটিরও বেশি মানুষকে বন্যার ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি থেকে সুরক্ষা দিচ্ছে। এখন পর্যন্ত ১,২২৯ কিলোমিটার নদী তীর সুরক্ষা বাঁধ সম্পন্ন করা হয়েছে। দুর্যোগ থেকে সুরক্ষার জন্য নির্মাণ করা হয়েছে ৪,৫৩০টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় মানুষ ও গবাদিপশুকে আশ্রয় দিতে মাটি উঁচু করে ৫৫০টি মুজিব কিল্লা নির্মাণাধীন রয়েছে। দুর্যোগের আগাম সতর্কবার্তা ও দৈনন্দিন আবহাওয়া বার্তা জানতে মোবাইল ফোনে ১০৯০ নম্বরে টোল ফ্রি সার্ভিস চালু করা হয়েছে।

স্থানীয় পর্যায়ের প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবকদের পাশাপাশি ডিজিটাল তথ্য এবং পরিষেবা কেন্দ্রগুলোকে প্রাথমিক সতর্কতা প্রদানের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। এই পদক্ষেপের ফলে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে মৃত্যুর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। ‘‘রূপকল্প-২০৪১’’ বাস্তবায়নে ‘আঞ্চলিক আবহাওয়া ও জলবায়ু সেবা প্রকল্পের আওতায় আবহাওয়া তথ্য সেবা ও আগাম সতর্কবাণী পদ্ধতি জোরদারকরণ (কম্পোনেন্ট-এ)’’ চলমান রয়েছে। যার ফলে আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেওয়ার প্রক্রিয়া আরও যুগোপযোগী হয়ে উঠবে। পাঁচটি আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগার, নয়টি ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র এবং ১৪টি নদী বন্দরে নৌ-দুর্ঘটনা প্রশমনের লক্ষ্যে আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ ও পূর্বাভাস কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া স্থাপন করা হয়েছে তিনটি স্যাটেলাইট গ্রাউন্ড স্টেশন। দুইটি আধুনিক ডপলার রাডার স্থাপনের কাজ চলছে। দেশের ১৩টি উপকূলীয় জেলায় স্যাটেলাইট টেলিফোনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

বাংলাদেশের মানুষ প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে লড়াই করে টিকে থাকতে জানে। স্থানীয়ভাবে গৃহীত অভিযোজনমূলক ব্যবস্থার ফলে মানুষ এখন প্রকৃতির বৈরিতার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে শিখেছে। স্থানীয় পর্যায়ে অভিযোজন ও সহনশীলতা বিনির্মাণে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ এ বছর সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে কপ-এর ২৮তম আসরে ইনোভেশন ইন ডেভেলপিং ফাইন্যান্স ক্যাটাগরিতে গ্লোবাল সেন্টার অন অ্যাডাপটেশন (জিসিএ) অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে বাংলাদেশ। জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যু দেশে যেমন জাতীয়ভাবে অগ্রাধিকার পেয়েছে, একই সঙ্গে বিশ্ব সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণেও জোরালো ভূমিকা রেখেছে। জলবায়ু সংকট মোকাবিলার লক্ষ্যে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে এখন বাংলাদেশ নেতৃত্ব দিচ্ছে।

বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত দুইবার জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জোট ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের (সিভিএফ) সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছে। বাংলাদেশ সভাপতি থাকাকালীন সময়েই এই ফোরাম জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছে। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার ব্যাপারে ২০০৯ সালের কোপেনহেগেন সম্মেলন থেকেই বাংলাদেশ শক্ত অবস্থান নিয়েছিল যা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের পক্ষে জনসমর্থন তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে অনুষ্ঠিত কপ২৬ সম্মেলনে বাংলাদেশ ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম এবং স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জোটের পক্ষে কার্বন নিঃসরণ কমানো এবং জলবায়ু তহবিলের পরিমাণ বাড়ানো ও তা পাওয়ার শর্ত শিথিলের পক্ষে অবস্থান নেয়। সম্মেলনে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশ কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা থেকে সরে আসার ঘোষণা দেয়।

অভিযোজনের জন্য প্রয়োজনীয় আর্থিক সক্ষমতা না থাকায় বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে জলবায়ু অর্থায়নের মাধ্যমে সহায়তার দায়িত্বটা জলবায়ু দূষণকারী ধনী দেশগুলোর কাঁধেই বর্তায়। ধনী দেশগুলো তাদের প্রতিশ্রুতি রাখছে না বলে বাংলাদেশ বৈশ্বিক ফোরামে এ ব্যাপারে বরাবরই সোচ্চার ভূমিকা পালন করছে। ২০২১ সালে জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আমন্ত্রণে দুই দিনব্যাপী লিডার্স সামিটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বনেতাদের জলবায়ুর ক্ষতি প্রশমন ও পুনর্বাসনে বার্ষিক ১০০ বিলিয়ন ডলার ফান্ড নিশ্চিত করার পরামর্শ দিয়েছেন।

এ বছর ২৮ নভেম্বর জাতিসংঘের অভিবাসন সংস্থা, আইওএম কাউন্সিলের ১১৪তম অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী জলবায়ু সংশ্লিষ্ট বাস্তুচ্যুতির কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তার আহ্বান জানিয়েছেন। কপ২৮ সম্মেলনে তহবিল আদায়ে বাংলাদেশ শক্ত অবস্থান নিয়েছে। শিল্পোন্নত দেশগুলোকে জলবায়ুর ক্ষয়ক্ষতি তহবিলে অন্য কোনো খাত থেকে অর্থ এনে না দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। সেই সাথে প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী বিশ্বের তাপমাত্রা এ শতাব্দির মধ্যে যাতে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি না বাড়ে সেই লক্ষ্যে শিল্পোন্নত দেশগুলোকে কার্বন নিঃসরণ কমানোর তাগিদ দেওয়া হয়েছে। এভাবেই জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় স্বল্পোন্নত দেশগুলোর আশা-ভরসার প্রতীক হয়ে উঠছে বাংলাদেশ।

দুর্যোগ
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close