• শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

অবন্তিকার মৃত্যু: বয়কটের চাদরে যেন ঢেকে না যায়

প্রকাশ:  ৩১ মার্চ ২০২৪, ১৯:০১ | আপডেট : ৩১ মার্চ ২০২৪, ১৯:০৮
নিজস্ব প্রতিবেদক

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী অবন্তিকা। আইন বিভাগে পড়তেন। কালো গাউনে আইনাঙ্গনে আইনি লড়াই বা বিচারকের স্বপ্ন নিয়েই হয়তো আইন বিভাগে এসেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্ত পরিবেশে তারুণ্যের উচ্ছ্বাস নিয়ে শিক্ষাজীবন শেষ করার কথা ছিল।

তার বিশ্ববিদ্যালয় মুক্ত ছিল না। ক্যাম্পাসের জীবন আনন্দময় হওয়ার কথা ছিল, হয়নি। জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিষহ। নিপীড়নের শিকার হন।

দানব সহপাঠী আম্মান হয়ে যান মূর্তিমান আতঙ্ক। জীবনের সব রং, তারুণ্যের উচ্ছ্বাস হারিয়ে যায়। আশ্রয় নেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের। সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামের কাছে অভিযোগ দেন।

সহকারী প্রক্টর তার সাহায্যে এগিয়ে আসেননি। বিপরীত ভূমিকা নেন। অবন্তিকাকে উল্টো ধমক দেন। অসহায় মেয়েটিকে এরা সবাই বিষণœতার দিকে ঠেলে দেন। মেধাবী অবন্তিকা হতাশায় ডুবে যান।নিপীড়নের শিকার অসহায় মেয়েটি আত্মহননের পথে হাঁটেন। কাউকে জানতে দেননি। সুইসাইড নোট লিখেন। সেখানে সহপাঠী আম্মান আর শিক্ষক দ্বীন ইসলামকে দায়ী করেন। আত্মহত্যার মধ্য দিয়ে জীবন এবং নিপীড়ন থেকে মুক্তি নেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে নিপীড়নের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা রয়েছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সেই নির্দেশনা মেনে ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এক সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ পদে থাকতেন পান্ডিত্য, মেধা, সততা আর প্রখর ব্যক্তিত্বের অধ্যাপকরা। উনাদের প্রতি শ্রদ্ধা-ভক্তিতে অবনত থাকতেন সবাই। বর্তমান চিত্র পাল্টে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে অনৈতিকভাবে নিয়োগের সঙ্গে তারা জড়িয়ে যাচ্ছেন। সেই সুযোগ নিচ্ছেন অভিযুক্তরা। সর্বশেষ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য বিদায়ী ভিসির বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ এসেছে। অভিযুক্তদের বিষয়ে উনি সব সময় অতি মানবিক থেকেছেন। মানবিক কারণ দেখিয়ে অভিযুক্তদের অব্যাহতি দিতেন তিনি। অভিযুক্ত ক্ষমতাসীনদের সহায়তা নিয়ে শেষ কর্মদিবসেও বিশাল নিয়োগ দিয়েছেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ভিসি নিয়োগকান্ডে জড়িত হয়ে মেয়াদ শেষে পুলিশ পাহারায় বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করেছেন।

একটি বেসরকারি সংস্থার বিশ্ববিদ্যালয়ে নিপীড়ন নিয়ে গবেষণায় ভয়াবহ অবস্থা উঠে এসেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, ৭০ ভাগের বেশি ছাত্রী নিপীড়নের শিকার হন। এ চিত্র ভয়াবহ। এর সমাধান প্রয়োজন। অভিযুক্তদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এখানে নিপীড়নকারী থাকবে না। এখান থেকে জ্ঞান আহরণ করে আলোকিত মানুষ বের হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এমন পরিস্থিতির জন্য দায়ী প্রশাসনিক দুর্বলতা। দলীয় আনুগত্য। অন্যদিকে ছাত্ররাজনীতির বন্ধ্যত্ব। যখন যে দল ক্ষমতায় ক্যাম্পাসে শুধু তাদের ছাত্র সংগঠন। একচ্ছত্র আধিপত্য তাদের। ছাত্ররাজনীতি মরা নদী। স্রোত নেই। একসময় মফস্বলের ছাত্ররাজনীতি ছিল কলেজকেন্দ্রিক। ক্যাম্পাসে প্রতিদিন ছাত্র সংগঠনগুলোর মিছিল হতো। নবীনবরণ হতো। কেন্দ্র থেকে ছাত্রনেতারা যেতেন। নেতাদের বক্তব্যে মফস্বলের কর্মীরা মুগ্ধ হতো। নেতারা মফস্বলে যেতেন পাবলিক পরিবহনে। নিজস্ব জিপ বা হেলিকপ্টার নয়। ছাত্রনেতারা ছিলেন তরুণদের নায়ক। ’৯০ সালের আগে এরশাদ জমানায় কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচন হতো। এরশাদ আমলের পর ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয় না। জনপ্রিয়, ভদ্র, মেধাবীদের তাই রাজনীতিতে সংখ্যা কমেছে। জনপ্রিয় ছাত্রনেতা থেকে আর জননেতা হয় না। নির্বাচনে বিভিন্ন পেশা থেকে এসে পোস্টারে জননেতা হয়ে যান। স্বাভাবিক ছাত্ররাজনীতি থাকলে ক্যাম্পাসে ছাত্রী নিপীড়নকারী থাকতে পারত না।

বিভিন্ন পেশা থেকে এসে পোস্টারে জননেতা হয়ে যান। স্বাভাবিক ছাত্ররাজনীতি থাকলে ক্যাম্পাসে ছাত্রী নিপীড়নকারী থাকতে পারত না। ধর্ষক হওয়ার সাহস হতো না কুলাঙ্গার কোনো ছাত্রের। ছাত্ররাজনীতির এ রুগ্ন দশার জন্য ’৯০-পরবর্তী ক্ষমতাসীন রাজনীতিবিদরাই দায়ী। এর খেসারত রাজনীতিবিদদেরই দিতে হবে। আসলাম দেখলাম জয় করলাম সুবিধাবাদীরাই লাভবান হচ্ছেন। ভবিষ্যতেও হবেন।

অবন্তিকার আত্মহত্যা সারা দেশে তোলপাড় সৃষ্টি করে। তার ক্যাম্পাসসহ সর্বত্র আন্দোলনের ঝড় তুলে।

দেশজুড়ে আলোচিত হতে থাকে অবন্তিকার আত্মহনন। দেশব্যাপী আলোচিত এ ঘটনা চাপা পড়ে বিএনপি নেতা রিজভীর চাদর ছোড়া ভারত বয়কটে।

২০ মার্চ বিএনপি নেতা রুহুল কবির রিজভী নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে এক কর্মসূচিতে অংশ নেন। কর্মসূচিতে তিনি শীতকালীন একটি চাদর ছুড়ে ফেলেন। সংহতি জানান ভারতীয় পণ্য বর্জনে।

প্রতিবেশী দেশ ভারতের পণ্য বর্জনের ঘোষণা চলে আসে দেশের রাজনীতি আর মিডিয়ার আলোচনায়।

হারিয়ে যায় অবন্তিকার আত্মহত্যার ঘটনা।

‘বয়কট’ নামক প্রতিবাদের সূচনা ১৮৮০ সালে আয়ারল্যান্ডে। ভূমি মালিকের অত্যাচারী প্রতিনিধি বয়কটকে বর্গাচাষিসহ স্থানীয় লোকজন একঘরে করে রেখেছিলেন। সম্ভ্রান্ত ইংরেজ ভূমি মালিক ছিলেন তৃতীয় আর্ল আর্নে জন ক্রিকটন। তার প্রতিনিধি কানিংহাম বয়কট। মায়ো কাউন্টির খাজনা আদায় করতেন তিনি। ফসলের ফলন কম হওয়ায় সেবার চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হন। সে কারণে জন ক্রিকটন ১০ শতাংশ খাজনা মওকুফের ঘোষণা দেন। চাষিরা দাবি তোলেন ২৫ শতাংশ। দাবি গ্রহণ করেননি লর্ড আর্নে। বয়কট অত্যাচারীর ভূমিকা নেন। ১১ জন বর্গাচাষিকে উচ্ছেদের চেষ্টা করেন।

সে সময় আয়ারল্যান্ডে ভূমি সংস্কারের পক্ষে আন্দোলন করছিলেন আইরিশ রাজনীতিবিদ চার্লস স্টুয়ার্ড পার্নেল। তিনি এক ভাষণে বলেন, কোনো বর্গাচাষিকে উচ্ছেদ করা হলে অন্য চাষিরা যেন সেই জমি বর্গা না নেন। উচ্ছেদের হুমকি দিলে মালিকপক্ষকে এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেন।

বয়কটের বিপক্ষে চাষিরা সেই কৌশল নেন। তার গৃহকর্মী থেকে দিনমজুররা কাজ বর্জন করেন। ব্যবসায়ীরা ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিন্ন করেন। বর্জন ও একঘরে হয়ে ওঠেন ‘বয়কট’। কালক্রমে এ বয়কট যুক্ত হয় অভিধানে।

১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের পর ভারতবর্ষেও ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বয়কট হয়েছিল। তখন ভারত ছিল পরাধীন।

বর্তমান আধুনিক বিশ্বে ভারত এবং বাংলাদেশ দুটো পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র। বিশ্ব আজ গ্লোবাল ভিলেজে পরিণত হয়েছে। দেশে দেশে বিনিয়োগ, বাণিজ্য ব্যাপ্তি লাভ করেছে। এমন অবস্থায় একটি দেশের রাজনৈতিক দলের অন্য দেশের পণ্য বয়কট কর্মসূচিতে কতটুকু রাজনৈতিক প্রজ্ঞা রয়েছে সেই প্রশ্ন থেকে যায়। ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য, বিনিয়োগ, শক্তি ও জ্বালানি, যোগাযোগ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সংস্কৃতির মতো নানা ক্ষেত্রে সম্পর্ক রয়েছে। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ চিকিৎসার জন্য ভারত যায়। সবাই সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া যেতে পারে না। মধ্যবিত্তরা চিকিৎসার জন্য ভারতেই যান। যদিও এ দৈন্যতা আমাদের দেশের বেহাল চিকিৎসাব্যবস্থার। এখানে খতনা করাতে শিশুর মৃত্যু মানুষকে আতঙ্কিত করে। ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশের তিন দিকে ভারতের সীমানা। প্রতিবেশী কখনো পরিবর্তন করা যায় না। যে কোনো কর্মসূচি ঘোষণায় বিষয়টি গুরুত্ব দিতে হয়।

এ কর্মসূচির নামে নিজ দেশের সরকারের বিরোধিতা করতে গিয়ে প্রতিবেশীকে করা হচ্ছে প্রতিপক্ষ। বিএনপি অনেকবার বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল। বিএনপির শাসনামলে প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে বিএনপি সরকার অনেক চুক্তি করেছে। বিএনপির আমলেই ভারতের ৩১৪টি পণ্য বাংলাদেশে শুল্কমুক্ত প্রবেশের সুবিধা পায়।

ভারত থেকে অনেক নিত্যপণ্য আমাদের দেশে আসে। আমরা এখনো সব নিত্যপণ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ নই। নিত্যপণ্য আমদানিনির্ভর। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে বয়কট মূল্যহীন।

এ ধরনের পণ্য বয়কট কর্মসূচি নিত্যপণ্যে অস্থিরতা তৈরি করবে। এ ছাড়া ভারত আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অকৃত্রিম বন্ধু। মহান মুক্তিযুদ্ধে আমাদের আশ্রয় দিয়েছে। খাবার দিয়েছে। অস্ত্র দিয়েছে। ট্রেনিং দিয়েছে। পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিয়ে কম-বেশি তাদের ১৫ হাজার সৈনিক আমাদের শহীদদের সঙ্গে জীবন দিয়েছে। স্বাধীনতার পর জাতির পিতা স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের জন্য বলেছেন। ভারতীয় সৈন্য ইতিহাসের দ্রুততম সময়ে ভারতে ফিরে গেছে।

তারপরও ভারতের সঙ্গে আমাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট আরও অমীমাংসিত বিষয় আছে। সেগুলোর কূটনৈতিক সমাধান প্রয়োজন। দুটি দেশই একই সঙ্গে সার্ক, বিমসটেক, কমনওয়েলথের সদস্য।

আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে মত-পথ থাকবে। সবাই এক মতের, এক পথের হবে না। তবে মহান মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতার প্রশ্নে ভিন্নমত থাকতে পারবে না। মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতাকে মেনে, অন্তরে ধারণ করেই সমস্যার সমাধান করতে হবে। আমাদের সমস্যা আমাদেরই সমাধান করতে হবে।

বিএনপি দীর্ঘদিন থেকে আন্দোলন, সংগ্রাম, কারাভোগ করছে। বিগত দুটো নির্বাচন বর্জন করেছে। একটিতে অংশ নিয়েছে। জাতীয় নির্বাচনগুলোর স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। আমাদের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী করা প্রয়োজন। মাত্র কিছুদিন আগে একাদশ সংসদে নির্বাচন কমিশন গঠন আইন হয়েছে। উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগ আইন এখনো প্রণয়ন হয়নি। সমস্যা রয়েছে। তবে সমস্যাগুলো নিজেদের। সমাধানও নিজেদের মতো করেই করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত দলিল আমাদের সংবিধান। সংবিধানেই নির্বাচন কমিশন গঠন আইনের কথা বলা ছিল। সেই আলোকে আইন হয়েছে। সংবিধানেই বিচারক নিয়োগের আইন করার কথা বলা আছে। মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশকে অন্তরাত্মায় ধারণ করে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বাধীন এবং শক্তিশালী করতে পারলেই সমাধান আসবে। মার্চ স্বাধীনতার মাস। ’৭১-এর ২৫ মার্চ পাকিস্তানিরা এদেশে গণহত্যা করেছিল। পাকিস্তানিদের গণহত্যা এখনো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায়নি। স্বীকৃতি আদায়ে সোচ্চার হতে হবে। এখানে বিভাজন নয়। যারা আমাদের নির্বিচার গণহত্যা করেছে তাদের বিরুদ্ধে এক হয়ে দাবি আদায় করতে হবে। এ স্বীকৃতি আরও আগে হওয়া উচিত ছিল।

বিএনপির আন্দোলন-সংগ্রামের ক্লান্তি আছে, কারাবরণ আছে, আন্দোলনে ব্যর্থতা আছে। তবু সবকিছুর সফলতা দেশের ভিতরেই খুঁজতে হবে। ব্যর্থতার হতাশা থেকে প্রতিবেশীকে উদ্দেশ্য করে চাদর ছুড়ে সফলতা আসবে না।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য

পীর মিজবাহ,অবন্তীকা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close