• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

প্রকাশ্যে ধূমপান বন্ধ হোক

প্রকাশ:  ২৫ মার্চ ২০১৯, ১২:৪৮
মুন্নি আক্তার

ধূমপান স্বাস্থের জন্য ক্ষতিকারক; এটি মৃত্যু ঘটায়। এই বাক্যগুলো আমরা সবাই জানি। কিন্তু এর গুরুত্ব কি আসলেই অনুধাবন করতে পারি? কেননা, আইন প্রয়োগ করেও বাংলাদেশে প্রকাশ্যে ধূমপান বন্ধে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। ধূমপানের মতো সামাজিক ব্যাধি দূরীকরণে শুধু আইন প্রয়োগ নয় চাই সামাজিক সচেতনতাও। ধূমপানের ক্ষতিকর প্রভাব জানার পরও দিন দিন ব্যাপক আকার ধারণ করে চলছে। তরুণদের আড্ডার অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে ধূমপান। মারাত্মকভাবে লক্ষ্য করা যায় প্রকাশ্যে ধূমপান। এতে করে ধূমপায়ী নিজে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আশেপাশের মানুষজনও পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

এক গবেষণায় দেখা গেছে সিগারেটের ধূমপানে নিকোটিনসহ ৫৬টি বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ বিদ্যমান। ২০১০ সালে প্রকাশিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে বিশ্বের ১৯২টি দেশে পরিচালিত একটি গবেষণা প্রতিবেদনে জানানো হয়, নিজে ধূমপান না করলেও অন্যের ধূমপানের প্রভাবে বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ৬,০০,০০০ মানুষ মারা যায়। এর মধ্যে ১,৬৫,০০০-ই হলো শিশু। শিশুরা পরোক্ষ ধূমপানের কারণে নিউমোনিয়া ও অ্যাজমায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর দিকে ঝুঁকে পড়ে। ২০০৪ সালে পরিচালিত এ জাতীয় আরেকটি গবেষণায় দেখা গিয়েছিলো যে, পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের ৪০% শিশু, ৩৩% অধূমপায়ী পুরুষ এবং ৩৫% অধূমপায়ী। গবেষণায় দেখা যায়, পরোক্ষ ধূমপান পুরুষের তুলনায় নারীদের উপর বেশি প্রভাব পড়ে। পরোক্ষ ধূমপানের কারণে বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ৮১,০০০ নারী মৃত্যুবরণ করেন। পরোক্ষ ধূমপানের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির স্বীকার হচ্ছেন ইউরোপ ও এশিয়ার মানুষ। এছাড়া পরোক্ষ ধূমপানের কারণে হৃদরোগ, ফুসফুসের ক্যান্সার সহ শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত রোগও দেখা দেয়।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ এবং মাদকাসক্তদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের জন্য ১৯৯০ সালে একটি আইন করা হয় যা কার্যকর হয় ওই বছরের ২ জানুয়ারি। এই আইনে ৫৬ টি ধারা রয়েছে। বলাবাহুল্য আইনের ব্যবহার কতটা কার্যকর আছে। এছাড়াও ২০০৫ সালে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্যের উৎপাদন ব্যবহার ক্রয়-বিক্রয় ও বিজ্ঞাপন নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ আইন ২০০৫ প্রণয়ন করা হয়। এই আইনের ৪ ধারায় পাবলিক প্লেস এবং পাবলিক পরিবহণে ধূমপান নিষিদ্ধ প্রষঙ্গে বলা হয়েছে। এই আইনের ৪ ধারার ১ উপধারায় বলা হয়েছে ধারা ৭ এর বিধান সাপেক্ষে, কোন ব্যক্তি কোন পাবলিক প্লেস এবং পাবলিক পরিবহণে ধূমপান করিতে পারিবেন না ৷ এবং ৪ ধারার উপধারা ২ এ বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তি উপ-ধারা (১) এর বিধান লঙ্ঘন করিলে তিনি অনধিক তিনশত টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং উক্ত ব্যক্তি দ্বিতীয়বার বা পুনঃপুনঃ একই ধরণের অপরাধ সংঘটন করিলে তিনি পর্যায়ক্রমিকভাবে উক্ত দণ্ডের দ্বিগুণ হারে দণ্ডনীয় হইবেন।

সারাদেশের প্রায় সব জায়গাতেই প্রকাশ্যে জনসমাগমস্থলে ধূমপান স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিপুল জনসংখ্যার শহর ঢাকায় এই বিষয়টি যেন মরার ওপর খাড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষত রাজধানীর লোকাল বাসগুলোতে চলাচলকারী যাত্রীরা প্রতিনিয়ত নীরবে সহ্য করেন সিগারেটের ধোঁয়ার অকারণ জ্বালাতন। অধিকাংশ যানবাহনের চালকই গাড়ি চলন্ত অবস্থায় ধূমপান করেন। সিগারেটের সেই ধোঁয়ায় বেশির ভাগ সময়ই বিপাকে পড়েন তাদের পাশে সংরক্ষিত আসনে বসে থাকা নারী যাত্রীরা।

এর ফলে, প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে যে পরিমাণ মানুষের প্রাণ যাচ্ছে তা রোধে এই শাস্তি কতটা গ্রহণযোগ্য। আইন প্রণয়ন করে তা যদি কার্যকর করা না হয় তবে কি দরকার আইন তৈরী করার। আইন আছে কিন্তু বাস্তবায়ন নেই। পাশাপাশি আমরা মানুষ হিসেবে নিজেরাই সচেতন না। প্রকাশ্যে ধূমপান করা থেকে আমাদের নিজেদেরই বিরত থাকতে হবে। অন্যের জীবনকে হুমকির মুখে ফেলার অধিকার আমাদের কারও নেই। এ বিষয়ে স্কুল, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত সেমিনার করা যেতে পারে। গ্রাম-গুলোতে এ বিষয়ে মুক্ত আলোচনা করা যেতে পারে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর বেশ উদ্যোগ গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ন করলে সুরহা পাওয়া যাবে। এছাড়াও মানবাধিকার কমিশনসহ দেশের বিভিন্ন সংগঠন ধূমপানের ভয়াবহতা সম্পর্কে সকলকে অবগত করতে পারে। এবং প্রণীত আইনের ব্যবহার নিশ্চিত করলে আমরা এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে পারবো।

একই আইনের ৬ ধারায় বলা হয়েছে অপ্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তির নিকট তামাক বা তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয় নিষিদ্ধ, ইত্যাদি প্রষঙ্গেঃ ৬ ধারার ১ উপধারায় বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তি অনধিক আঠারো বৎসর বয়সের কোন ব্যক্তির নিকট তামাক বা তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয় করিবেন না, অথবা উক্ত ব্যক্তিকে তামাক বা তামাকজাত দ্রব্য বিপণন বা বিতরণ কাজে নিয়োজিত করিবেন না বা করাইবেন না। ৬ ধারার ২ উপধারায় বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তি উপ-ধারা (১) এর বিধান লঙ্ঘন করিলে তিনি অনধিক পাঁচ হাজার টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং উক্ত ব্যক্তি দ্বিতীয়বার বা পুনঃপুনঃ একই ধরনের অপরাধ সংঘটন করিলে তিনি পর্যায়ক্রমিকভাবে উক্ত দণ্ডের দ্বিগুণ হারে দণ্ডনীয় হইবেন।

ঢাকার বিভিন্ন স্থানেই ৮-১৭ বছর বয়সী শিশু-কিশোরদের দেখা যায় সিগারেট বিক্রি করতে। বেশিদূর না জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সন্ধ্যার পর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এছাড়াও ফুটপাতসহ বিভিন্ন স্থানেই দেখা মেলে নাবালক শিশুদের। যার ফলে ছোট বয়স থেকেই ঐ সকল শিশুরা ধূমপান থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য গ্রহণ করে চলছে। এ বিষয় থেকে সুরহা পেতে সকলকে সচেতন হতে হবে। নিজেদের বিবেক জাগ্রত করতে হবে। আমরা অল্পবয়সীদের থেকে সিগারেট ক্রয়-বিক্রয় না করলে এ সমস্যা থেকে সুরহা পাওয়া যেতে পারে। তাছাড়া যেসকল বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে শিশুরা সিগারেট বিক্রয় করে সেসকল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এই বিষয়গুলো নজরে রাখলে এ সমস্যা থেকে বের হওয়া সম্ভব। আইনের ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। শিশুদের এ বিষয়ে সচেতন করে বিজ্ঞাপন, স্কুল-কলেজগুলোতে মাদকের ভয়াবহতা সম্পর্কে সেমিনার, নিজে সচেতন হওয়া এবং অন্যান্যদের সচেতন করার মাধ্যমেও এই অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে পারি।

বাংলাদেশ সরকার ২০০৩ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে গৃহীত আন্তর্জাতিক চুক্তি এফসিটিসিতে (ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল) স্বাক্ষর করে। চুক্তির বিধান অনুযায়ী ২০০৫ সালে সরকার তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন করে। কিন্তু এ আইনের কিছু দুর্বলতা থাকার কারণে আইনটি কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়। তাই সরকার ২০১৩ সালের মে মাসে আইনটি সংশোধিত আকারে পাস করে। সর্বশেষ ২০১৫ সালের ১২ মার্চ সংশোধিত আইনের আলোকে তামাক নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা ২০১৫ পাস করে। আইন প্রণয়ন করা হয় কোনো উদ্ভূত সমস্যার সমাধান বা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। খাতা-কলমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ করে রাখলে সে আইনের উপকারিতা জনগণ ভোগ করতে পারবে না। তাছাড়া জনসচেতনতা আইন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে একটি মুখ্য বিষয়। তাই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এই প্রকাশ্যে ধূমপানের বিরুদ্ধে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে সহায়তা করতে হবে এবং দেশের প্রতিটি মানুষকেও এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। তাই শুধু রাষ্ট্র নয় আইন নয় মানুষের পাশে দাড়ানোর দায়িত্ব সকলের উপরই বর্তায়। আমাদের সচেতনতা ও সরকারের আইনের কার্যকর বাস্তবায়নই আমাদের দিতে পারবে এমন সোনার বাংলা।

শিক্ষার্থী আইন বিভাগ, গণ বিশ্ববিদ্যালয়

প্রকাশ্যে ধূমপান
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close