• শনিবার, ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||

নির্বাচন কমিশন আইন নিয়ে তাড়াহুড়োর অভিযোগ

প্রকাশ:  ২৩ জানুয়ারি ২০২২, ০০:১৪
নিজস্ব প্রতিবেদক

জাতীয় সংসদে রোববার নির্বাচন কমিশন গঠন সংক্রান্ত নতুন আইন উত্থাপন করবে সরকার৷ তবে ‘তড়িঘড়ি’ করে এই আইন কেন এমন প্রশ্ন তুলছেন কেউ কেউ৷ আইনের অধীনে রাষ্ট্রপতি শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর মনোনীতদেরই নিয়োগ দিবেন এমনটাও মনে করেন অনেকে৷

সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ টি এম শামসুল হুদা শনিবার এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, নির্বাচন কমিশন গঠনে আইন করার ক্ষেত্রে আরো সময় নিয়ে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করার প্রয়োজন ছিল৷ এই আইনের খসড়ায় কিছু অপূর্ণতার কথাও বলেছেন তিনি৷

শামসুল হুদা বলেন, ‘বর্তমান নির্বাচন কমিশন সদিচ্ছা থাকলে ভালো নির্বাচন করতে পারত৷ কিন্তু তাদের পারফর্মেন্স সন্তোষজনক নয়৷ তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাজনৈতিক ব্যবস্থার জন্য সুখকর না হলেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচন অধিকতর গ্রহণযোগ্য হয়েছে৷’

নতুন এই আইনটির বিরোধিতা করেছে বিএনপি৷ রোববার সকালে খসড়া আইনের ত্রুটি তুলে ধরতে সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করেছে সুশাসনের জন্য নাগরিক- সুজন৷

সুজনের আয়োজনে ওই সংবাদ সম্মেলনে থাকবেন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি- বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান৷ তিনি বলেন, ‘সরকার কেন বারবার আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত নেয় সেটা আমরা বুঝতে পারি না৷ সরকারের পক্ষে সুন্দর একটা আইন করার সুযোগ ছিল৷ কিন্তু তারা সেটা না করে তড়িঘড়ি করে আইনটি করতে যাচ্ছে৷ এতে তো সমস্যার সমাধান হবে না৷ এত বেশি গোপনীয়তার সঙ্গে এই আইনটা করা হলো, সেটা মূলত আগের দু'টো নির্বাচন কমিশনকে বৈধতা দেওয়া, যারা অত্যন্ত বিতর্কিত নির্বাচন করেছেন৷ জনগণ যখন জেগে উঠে এবং গণতন্ত্র যখন প্রতিষ্ঠিত হয় তখন এইসব আইনগুলো আর টেকে না৷’

আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হচ্ছে৷ ১৫ ফেব্রুয়ারি নতুন কমিশনকে দায়িত্ব নিতে হবে৷ নির্বাচন পুনর্গঠন নিয়ে গত ২০ ডিসেম্বর থেকে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করে আসছিলেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ৷ সংলাপে বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল ইসি গঠনে আইনের পক্ষে প্রস্তাব করে৷ ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংলাপের মধ্য দিয়ে শেষ হয় রাষ্ট্রপতির এ সংলাপ৷ তারাও ইসি গঠনে আইনের প্রয়োজন আছে বলে মত দেন৷

গত মঙ্গলবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে আইনের খসড়া চূড়ান্তভাবে অনুমোদন দেওয়া হয়৷ আইনের খসড়ায় আছে, প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ দিতে একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা হবে৷ রাষ্ট্রপতির অনুমোদন নিয়ে এ অনুসন্ধান কমিটি হবে৷ এ কমিটির দায়িত্ব ও কাজ হবে যোগ্য প্রার্থীদের নাম সুপারিশ করা৷ ছয় সদস্যের এ অনুসন্ধান কমিটির প্রধান হিসেবে থাকবেন প্রধান বিচারপতির মনোনীত আপিল বিভাগের একজন বিচারপতি৷ আর সদস্য হিসেবে থাকবেন প্রধান বিচারপতির মনোনীত হাইকোর্টের একজন বিচারপতি, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, সরকারি কর্ম কমিশনের চেয়ারম্যান এবং রাষ্ট্রপতির মনোনীত দুইজন বিশিষ্ট নাগরিক৷ কমিটিকে সাচিবিক সহায়তা দেবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ৷

ওই পদগুলোতে নিয়োগের জন্য আইনের খসড়ায় যোগ্যতার কিছু শর্তও দেয়া হয়েছে৷ প্রথমত, বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে৷ দ্বিতীয়ত, ন্যূনতম বয়স ৫০ বছর হতে হবে এবং তৃতীয়ত গুরুত্বপূর্ণ সরকারি, আধা সরকারি, বেসরকারি বা বিচার বিভাগীয় পদে ওই সব ব্যক্তিকে কমপক্ষে ২০ বছর কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে৷ এসব যোগ্যতা থাকলে কেউ প্রধান নির্বাচন কমিশনার বা নির্বাচন কমিশনারের জন্য বিবেচ্য হতে পারবেন৷ তবে ২০ বছর কাজের অভিজ্ঞতার মধ্যে কোন পদে কত বছর থাকতে হবে, তার কিছু বলা নেই৷

যেসব বিষয়কে অযোগ্যতা হিসেবে ধরা হবে তার মধ্যে রয়েছে, দেউলিয়া ঘোষণা হওয়া, বিদেশি রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব থাকা বা আনুগত্য প্রকাশ করা (তবে দ্বৈত নাগরিক হলে হওয়া যাবে), নৈতিক স্খলন, ফৌজদারি অপরাধে অন্যূনতম দুই বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাজাপ্রাপ্ত হলে এসব পদে নিয়োগ পাওয়া যাবে না। এছাড়া কেউ প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে অবসরে গেলে আর সেই পদে নিয়োগ পাবেন না৷ তবে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে অবসরে গেলে শুধু প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যাবে৷

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, নতুন নির্বাচন কমিশন গঠিত হবে আইনের আলোকে৷ তার আগেই আইনটি পাশ হবে৷

আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক ড. সেলিম মাহমুদ বলেন, ‘এখন যারা আইনটির বিরোধিতা করছেন তারা স্ববিরোধিতা করছেন৷ আমরা বলেছিলাম, আইনটি আমরা করব, কিন্তু এর জন্য সময় লাগবে৷ তখন তারা বলেছিল, সরকারের সদিচ্ছা থাকলে এই সময়ের মধ্যেই আইন করা সম্ভব৷ এখন আইনটি করা হচ্ছে৷ আসলে সংবিধানের ১১৮(১) অনুচ্ছেদে বিষয়টি পরিস্কার উল্লেখ রয়েছে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং কমিশনারদের নিয়োগ দিবেন৷ সেখানে নির্বাচন কমিশনারদের যোগ্যতা, অযোগ্যতার বিষয়টি উল্লেখ নেই৷ ফলে রাষ্ট্রপতি সার্চ কমিটি করে গত দুই বার এই নিয়োগ দিয়েছেন৷ এর আগে তো অন্য কোন সরকার এটাও ফলো করেনি৷ এখন আইন করে তাদের যোগ্যতা-অযোগ্যতাসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে৷’

তার মতে, সংবিধানে বিচারপতিদের যোগ্যতার কথা বলা থাকায় সেখানে সার্চ কমিটি করতে হয় না৷ তাই নতুন আইনের মধ্য দিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠনেও আর সমস্যা থাকবে না৷ সেলিম মাহমুদ বলেন, ‘এখানে সার্চ কমিটিতে যাদের রাখা হচ্ছে, তারা সবাই সাংবিধানিক দায়িত্বে আছেন৷ ফলে তাদের চেয়ে নিরপেক্ষ লোক পাওয়া সম্ভব নয়৷ আর দলীয়ভাবে করলে সংসদে তো আওয়ামী লীগের এমপি বেশি৷ ফলে আমরা কিন্তু সেটা করতে চাইনি৷ গ্রহণযোগ্য করার চেষ্টা করেছি আমরা৷’

সংবিধান বিশেষজ্ঞ অ্যাডভোকেট ড. শাহদীন মালিক বলেন, ‘২০০৩ সাল থেকে সরকারের প্রতি সহানুভুতিশীল না, এমন কাউকে বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় না৷ তখন বিএনপি দিয়েছে৷ ২০০৯ সাল থেকে যারা আওয়ামী লীগের প্রতি সহানুভুতিশীল না তাদের নিয়োগ দেওয়া হয় না৷ শুধু বিচারপতি না, রাষ্ট্রের সব গুরুত্বপূর্ণ পদেই আওয়ামী লীগের প্রতি যারা সহানুভুতিশীল তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়৷ এখন সার্চ কমিটিতে যাদের রাখা হচ্ছে তারা তো নিরপেক্ষ নন৷ তাই আমরা বলেছিলাম, সংসদের প্রধান তিনটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি থেকে দলের মনোনয়ন পাওয়া তিনজন এমপিকে নিয়ে এটা করা যেতে পারে৷ আওয়ামী লীগের যত এমপিই থাকুক না কেন তারা একজনকে নিয়োগ দিতে পরবেন৷ এখন সেটা তো হচ্ছে না৷ এখন তো আমরা জানতেই পারব না, সার্চ কমিটি কাদের নাম সুপারিশ করেছে৷’

এই আইনজীবীর মতে, এই প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো রাষ্ট্রপতি স্বাধীনভাবে কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারেন না৷ ‘সংবিধান তো তাকে সেই ক্ষমতা দেয়নি৷ ফলে তিনি যাদের নিয়োগ দেবেন তারা সবাই প্রধানমন্ত্রীর মনোনীত হবেন৷ এটাই তো হওয়ার কথা৷ এভাবে তো কমিশন করলে ভালো কিছু হবে না,’ বলেন ড. শাহদীন মালিক৷

নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে আইন প্রণয়নের উদ্যোগকে ‘তামাশা’ বলে অভিহিত করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন৷ তিনি দাবি করেন, জনগণকে বিভ্রান্ত করতেই নির্বাচন কমিশন গঠনে সরকারের প্রণীত খসড়া বিলটি সংসদে উত্থাপন করা হচ্ছে৷ শনিবার এক আলোচনা সভায় তিনি বলেন, ‘যারা গায়ের জোরে সরকার, যারা জনগণের সরকার নয়, তারা একটা আইন পাস করবে৷ তারপরে কী করবে? ওই আইন মোতাবেক একটি সার্চ কমিটি করতে হবে৷ অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী যে লিস্ট দেবেন, ওই সার্চ কমিটি সেই লিস্টটা প্রেসিডেন্টকে দেবেন, প্রেসিডেন্ট সেটা ঘোষণা করবেন৷’

বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্য হারুনুর রশীদ বলেন, ‘আমরা তো পূর্ণাঙ্গ আইনের কথা বলেছিলাম৷ এখন যেটা হচ্ছে সেটা সার্চ কমিটি আইন৷ এটা জনগনের সঙ্গে প্রহসন ছাড়া আর কিছুই না বলে আমরা মনে করছি।’ সূত্র: ডিডাব্লিউ

পূর্বপশ্চিম- এনই

নির্বাচন কমিশন আইন
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close