• সোমবার, ১৩ মে ২০২৪, ৩০ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||

খালেদার নেতৃত্বে ভোটে যেতে চান বিএনপির সিনিয়র নেতারা

প্রকাশ:  ১৯ মে ২০২৩, ১৪:১৯
নিউজ ডেস্ক

নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছে মাঠের প্রধান বিরোধীদল বিএনপি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন পেতে কূটনৈতিক তৎপরতাও চালাচ্ছে দলটি। তবে নীতিনির্ধারকরা নিজ দাবিতে অটল থাকলেও বিএনপির সত্তরোর্ধ্ব অনেক নেতা দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ভোটে যেতে আগ্রহী।

এই নেতারা বলছেন, দলের চেয়ারপারসনকে ছাড়া নির্বাচনে গিয়ে তারা তৃণমূলের নেতাকর্মীদের কাছে দালাল হিসেবে চিহ্নিত হতে চান না। সেক্ষেত্রে খালেদা জিয়ার পূর্ণ কারামুক্তি চান তারা। এজন্য তারা ভেতরে ভেতরে সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা এবং কূটনৈতিক চ্যানেলেও নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন।

কয়েকজন সিনিয়র নেতা বলেন, সরকার বিএনপিকে চাপে রাখতে ও নির্বাচনে আনতে নানামুখী কৌশল ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নেবে, এটাই স্বাভাবিক। সেজন্য অনেক নেতার বিরুদ্ধে বিভিন্ন মামলায় সাজা দেওয়ার জন্য তড়িঘড়ি করা হচ্ছে। এই বিষয়টিও বিএনপিকে ভাবনায় ফেলেছে।

জানা যায়, যেসব সিনিয়র নেতা খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে নির্বাচনে যেতে ইচ্ছুক, তাদের পর্যবেক্ষণ হলো—সরকারবিরোধী চলমান আন্দোলন সফল না হলে দলে ভাঙন তৈরি করবে ক্ষমতাসীনরা। সেক্ষেত্রে দলে ভাঙন রোধে নির্বাচনে যেতে হতে পারে। তা ছাড়া বিএনপি শেখ হাসিনার সরকারের অধীনে নির্বাচন বর্জন করলেও সরকারি নানামুখী চাপ ও প্রলোভনে দলের অনেক নেতাই ভোটে অংশগ্রহণ করতে পারেন। বাজারে এমন প্রচারণাও আছে—সরকারি দলের সঙ্গে আসন সমঝোতার ভিত্তিতে বিএনপি নির্বাচনে যেতে পারে। তবে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের অনুসারী অপেক্ষাকৃত তরুণ নেতারা কোনো অবস্থাতেই আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবেন না। রাজপথে আন্দোলনে দাবি আদায় করেই তারা ভোটে যেতে চান। কিন্তু বিএনপি কোনো কারণে ২০১৮ সালের মতো শেষ মুহূর্তে নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে সেক্ষেত্রে এই তরুণ নেতারাও বেকায়দায় পড়বেন।

তবে তারেকের অনুসারীদের মতে, বিএনপি কোনো আসন ভাগাভাগির নির্বাচনে অংশ নিলে রাজনীতিতে তারেক রহমান ও জিয়া পরিবারের ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। তারেকপন্থিরা মনে করছেন, শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে গেলে কোনো লাভ হবে না এবং বিএনপির পরাজয় সুনিশ্চিত। লন্ডনে থাকা তারেক রহমান দেশে আসতে পারবেন না, খালেদা জিয়াও স্থায়ী মুক্তি পাবেন না। বরং এর ফলে খালেদা জিয়া রাজনীতি থেকে এমনিতেই মাইনাস হয়ে যাবেন। কারণ, বিএনপির নেতৃত্ব তখন জিয়া পরিবার বাইরে চলে যেতে পারে।

তারেকপন্থিরা মনে করেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে বিএনপি বিপুল বিজয়ী হবে। আর বিএনপি সরকার গঠন করলে, তারেক রহমানের দেশে ফেরার পথ উন্মুক্ত হবে। নেতাকর্মীরা তখন ব্যাপক সংবর্ধনা দিয়ে তাকে দেশে ফিরিয়ে আনবেন। খালেদা জিয়াও স্থায়ী মুক্তি পাবেন। সবমিলিয়ে আগামী নির্বাচন ঘিরে বিএনপিতে নানা সমীকরণ চলছে বলে জানা গেছে।

খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ৩৭টি মামলার মধ্যে দুটিতে তার ১৭ বছরের কারাদণ্ড হয়েছে। ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কারাগারে যান তিনি। পরে করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকার নির্বাহী আদেশে সাজা স্থগিত করে ২০২০ সালের ২৫ মার্চ তাকে সাময়িক মুক্তি দেয়। তারপর থেকেই গুলশানের বাসভবন ফিরোজায় রয়েছেন তিনি। দীর্ঘ অসুস্থতা এবং আইনি বাধ্যবাধকতায় তিনি রাজনীতির মাঠের বাইরে। দল পরিচালনায় কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্তও দেন না তিনি।

খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে তারেক রহমান স্থায়ী কমিটির সদস্যদের মতামতে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি দল পরিচালনা করছেন। তবে তিনিও একাধিক মামলায় সাজাপ্রাপ্ত। ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার মামলায় তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। এ ছাড়া জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় ১০ বছর সশ্রম কারাদণ্ড এবং মুদ্রা পাচার মামলায় হয় ৭ বছরের কারাদণ্ড। নিম্ন আদালতের খালাসের রায় বাতিল করে হাইকোর্ট তাকে ওই দণ্ড এবং ২০ কোটি টাকার অর্থদণ্ডও দেন। তবে বিএনপির দাবি, খালেদা জিয়ার মতো তারেক রহমানও রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার।

সংবিধান ও নির্বাচনী আইন অনুযায়ী, ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে ন্যূনতম দুই বছর দণ্ডিত হলে সংসদ সদস্য হওয়ার ও থাকার যোগ্যতা হারান যে কেউ। মুক্তিলাভের পাঁচ বছর পার না হওয়া পর্যন্ত ভোটে অংশ নেওয়া যায় না। ফলে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান কেউই নির্বাচন করতে পারবেন না বলে আইনজীবীদের মত।

জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সিনিয়র সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনসহ ১০ দফা দাবিতে আমরা আন্দোলনে রয়েছি। এই সরকারকে বিদায় না করা পর্যন্ত আমরা কোনো নির্বাচনে যাব না। আমাদের পুরো মনোযোগ এখন আন্দোলনের দিকে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গতবার নির্বাচনে গিয়ে আমাদের তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে। নির্বাচন সুষ্ঠু করতে সরকারের পক্ষ থেকে তখন নানা প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু শেষপর্যন্ত কোনোটাই রাখা হয়নি। ওই নির্বাচনে জনগণেরও অভিজ্ঞতা হয়েছে। তারা ভোট দিতে পারেননি। দিনের ভোট রাতে ডাকাতি করা হয়েছে। এরপর আর কীভাবে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাওয়ার কথা আসে। ন্যাড়া বেলতলায় কতবার যায়?

নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে না হওয়ায় ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে তা প্রতিহতের ঘোষণা দিয়ে মাঠে নামে বিএনপি। কিন্তু দলটি ভোট ঠেকাতে ব্যর্থ হয় এবং আওয়ামী লীগ ও এর শরিক দলগুলো ১৫৩টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়। ওই নির্বাচনে ১৭টি রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এককভাবে ২৩৪টি আসন পেয়ে টানা দ্বিতীয়বারের মতো সরকার গঠন করে।

তবে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বিএনপি অনড় অবস্থানে বজায় থাকে। একপর্যায়ে বিএনপি চেয়ারপারসন জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিত হয়ে কারাগারে যান। তিনি কারাগারে যাওয়ার পর থেকে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবির সঙ্গে তার মুক্তির দাবিও সামনে নিয়ে আসে বিএনপি। এমনকি দলীয় চেয়ারপারসনকে ছাড়া নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণাও দেওয়া হয়। কিন্তু শেষ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে একাদশ নির্বাচনের আগে ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট’ গঠন করে খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখেই ২০১৮ সালে নির্বাচনে অংশ নেয় বিএনপি। দলটির পক্ষ থেকে তখন বলা হয়েছিল, আন্দোলনের অংশ হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে বিএনপি। সেবার বিএনপি মাত্র ছয় আসন পায়। আর জোটগতভাবে পায় ৮টি।

ওই নির্বাচনের পর ঘুরে দাঁড়াতে বিএনপি এবং অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের কমিটি গঠনে বিশেষ গুরুত্ব দেয় দলের হাইকমান্ড। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের তত্ত্বাবধানে মূল দল ও অঙ্গ সংগঠনগুলোকে নতুনভাবে ঢেলে সাজানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়। তারেক রহমানপন্থি একাধিক নেতার সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, দল পরিচালনায় কেন্দ্র থেকে তৃণমূল, সারা দেশে তারেক রহমানের নিজস্ব নেটওয়ার্ক রয়েছে, যা দলের তরুণ নেতাদের সমন্বয়ে গঠিত। বিশ্বস্ত এই নেটওয়ার্কের সাহায্যে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ এবং যাচাই-বাছাই শেষে কমিটি গঠন করেন তারেক রহমান। এ ছাড়া ওই নেটওয়ার্কের সাহায্যে সন্দেহভাজন নেতাদের ওপর নজরদারিও করেন তিনি।

দলের ভেতরে-বাইরে গুঞ্জন আছে, দলীয় সরকারের অধীনে বিএনপি নির্বাচনে না গেলেও সরকারি চাপ ও নানা প্রলোভনে দলের সিনিয়র কিছু নেতা সেই নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন। এমন পরিস্থিতি এড়াতে স্থায়ী কমিটিসহ দলের আস্থাভাজন ও বিশ্বস্ত নেতাদের সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আনেন তারেক রহমান।

এদিকে সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনসহ ১০ দফা দাবিতে সমমনা দল ও জোটগুলো নিয়ে ২০২২ সালের ২৪ ডিসেম্বর থেকে যুগপৎ আন্দোলন শুরু করে বিএনপি। ঈদুল ফিতর শেষে প্রায় দুই সপ্তাহ বিরতির পর গত বুধবার থেকে ফের এককভাবে মাঠে নেমেছে দলটি। এর মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত আন্দোলনের প্রথম ধাপ শুরু হয়েছে। আগামী ২৭ মে পর্যন্ত জেলা ও মহানগর পর্যায়ে বিক্ষোভ সমাবেশ করবে বিএনপি। আর কোরবানির ঈদের পর ঢাকামুখী এক দফার চূড়ান্ত আন্দোলন শুরুর পরিকল্পনা রয়েছে হাইকমান্ডের।

জানতে চাইলে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, দলের সিদ্ধান্ত হলো এই সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়া। এমনকি স্থানীয় সরকার নির্বাচনও বর্জন করেছি। তবুও বিএনপির যারা নির্বাচন করছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তা ছাড়া আমরা রাস্তায় বের হয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে দেখা হলেই তারা প্রশ্ন করেন—এই সরকারকে কবে বিদায় করবেন? মানুষ কিন্তু নির্বাচন নিয়ে কোনো মন্তব্য করছে না। এখান থেকেই বোঝা যায় যে, এই সরকারের ওপর একটা চাপ তৈরি হয়েছে।

তিনি বলেন, এরই মধ্যে বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের জামিন না দিয়ে কারাগারে পাঠানোর ঘটনা বেড়েছে। সেইসঙ্গে অনেক নেতার বিরুদ্ধে মামলা দ্রুত শেষ করতে তৎপরতা চলছে। অনেক নেতার স্ত্রী-সন্তানের পাসপোর্টও জমা রাখা হয়েছে, যা মানবাধিকারের লঙ্ঘন। আমার নিজের বিরুদ্ধেও কিছু মামলা দ্রুত শেষ করতে প্রক্রিয়া চলছে। অর্থাৎ সরকার আবারও ২০১৮ সালের মতো নির্বাচন করতে একটা ভিন্ন প্রক্রিয়ায় এগোচ্ছে বলে জানান আলাল।

সম্প্রতি বিএনপির উদ্দেশে যুগপৎ আন্দোলনের শরিক গণঅধিকার পরিষদের সদস্য সচিব নুরুল হক নুর বলেন, বিদেশিদের সিগন্যালের আশায় থাকলে নিজেদের ক্ষতি হয়ে যাবে। কারণ, প্রতিটি রাষ্ট্রই তার নিজস্ব সুবিধাটা দেখবে। সেক্ষেত্রে আমরা যদি আন্দোলনটাকে বেগবান করতে পারি, বিদেশি শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো আমাদের সমর্থন করবে। আর আন্দোলন বেগবান করতে না পারলে কোনো বিদেশিদের সিগন্যালে সরকার পরিবর্তন হবে না।

খালেদা জিয়া,বিএনপি
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close