• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

১৮শ স্প্লিন্টার বয়ে বেড়ানো মাহবুবা পারভীন

প্রকাশ:  ২১ আগস্ট ২০২২, ১১:০৬
নিজস্ব প্রতিবেদক

মৃত ভেবে মর্গের লাশঘরে ফেলে রাখা হয়েছিল তাকে। টানা ছয় ঘণ্টা লাশঘরে পড়ে ছিলেন। স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় নেতা আশিষ কুমার মজুমদার লাশ শনাক্ত করতে গিয়ে, জীবিত দেখতে পেয়ে উদ্ধার করেন। ৭২ ঘণ্টা পর জ্ঞান ফিরে আসে তার। মরতে মরতে অল্পের জন্য বেঁচে যান তিনি। তবে ফিরে পাওয়া প্রাণে প্রতিনিয়ত অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করতে হচ্ছে তাকে। গোটা শরীরে গ্রেনেডের ১৮শ স্প্লিন্টার বয়ে বেড়াচ্ছেন। রাতে স্প্লিন্টারের যন্ত্রণায় ভালোমতো ঘুমাতেও পারেন না তিনি।

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া মাহবুবা পারভীনের নতুন জীবন পাওয়ার গল্প এটি। সেদিনের ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় ঘটনাস্থলেই নিহত আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক আইভি রহমানের মরদেহের পাশে যে তিনজন নারীকে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়, তাদেরই একজন সাভারের মাহবুবা পারভীন। তৎকালীন ঢাকা জেলা আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক তিনি। পত্রিকার পাতায় নীল পেড়ে হালকা কমলা রঙের শাড়ি পরা মাহবুবার ছবি দেখে সবাই ভেবেছিলো তিনি মৃত।

সম্পর্কিত খবর

    মাহবুবা পারভীন পাঁচ বছর হুইলচেয়ারে আর আট বছর ক্রাচে ভর করার দুঃসহ জীবন পার করেছেন। দীর্ঘ চিকিৎসার পর তিনি কিছুদূর একা একা হাঁটতে পারেন এখন। বেশিক্ষণ হাঁটলে ক্লান্ত হয়ে পড়েন। শরীরে ভারসাম্য রাখতে পারেন না। তবে শরীরের ভেতরে ১ হাজার ৭৯৭টি স্প্লিন্টারের জ্বালাপোড়ায় সারারাত ঘুমাতে পারেন না এই মৃত্যুঞ্জয়ী লড়াকু যোদ্ধা।

    মাহবুবা পারভীন থাকেন সাভারের ব্যাংক কলোনিতে। ২০১৬ সালের ১৫ নভেম্বর তার স্বামী ফ্লাইট সার্জেন্ট (অব.) এম এ মাসুদ মারা যান। তাদের দুই ছেলের একজন স্থপতি রোশাদ জোবায়ের স্ত্রীসহ ডেনমার্ক থাকেন। বড় ছেলে আসিফ পারভেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করে এখন ঢাকাতেই থাকেন।

    সেদিনের সেই বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করে মাহবুবা পারভীন বলেন, ‘শেখ হাসিনা আপা, জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু বলতে পারেননি। তখনই একটা বিকট শব্দ হয়। পুরো এলাকা অন্ধকারে ছেয়ে যায়। তখন আমরা কেউ কাউকে দেখতে পারছিলাম না। শুধু চিৎকার শুনতে পাচ্ছিলাম—বাঁচাও, বাঁচাও।’

    ‘আমি দাঁড়ানো অবস্থা থেকে পড়ে যাই, সেন্স হারিয়ে ফেলি। পরে শুনেছি তখন নাকি আমার হার্ট অ্যাটাক হয়। অনেকে ভেবেছিল আমি মারা গিয়েছি। পরে আমাকে ভ্যানে করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ৭২ ঘণ্টা আইসিইউতে ছিলাম। ২৫ দিন পর স্মৃতিশক্তি ফেরে।’ বলেন মাহবুবা পারভীন।

    মাহবুবা রাজনীতিতে যুক্ত হন গ্রেনেড হামলায় আহত হওয়ার ঠিক আগের বছর ২০০৩ সালে, সাভার পৌর আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক নির্বাচিত হন সে বছর। এরপরে ২০০৪ সালে নির্বাচিত হন বৃহত্তর ঢাকা জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা তার জীবন থমকে দেয়। শুধু একটা বিকট শব্দ শোনার কথা মনে আছে তার। আর কিছুই মনে নেই তার।

    হামলার পরপরই মাহবুবার মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়ে শরীরের এক পাশ অবশ হয়ে গিয়েছিল। উদ্ধারকারীরা জানতেন না তিনি জীবিত, না মৃত। ভ্যানে করে অন্যদের সঙ্গে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে। দুদিন পর তার জ্ঞান ফিরল, তবে স্বামী-সন্তান কাউকেই চিনতে পারলেন না। দেশে চিকিৎসার পর কলকাতার পিয়ারলেস হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন তিনি।

    মাহবুবা পারভীন বলেন, ‘একেক দিন একেক উপসর্গ। জ্বালা-যন্ত্রণা কিছুটা নিয়ন্ত্রণে। তবে রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারি না। ঘুম থেকে উঠে শরীরের যেসব জায়গায় স্প্লিন্টার সেখানে চুলকায়, ব্যথা করে সেসব স্থানে ম্যাসাজ করে দিত আমার স্বামী। এখন তিনি নেই, তাই যন্ত্রণা হলেও ম্যাসাজ করার লোক পাই না।'

    মাহবুবা পারভীন বর্তমানে ঢাকা জেলা (উত্তর) স্বেচ্ছাসেবক লীগের জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্বরত রয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছাকাছি যেতে চেয়েছিলেন, পেরেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে খুব আদর করেন। প্রধানমন্ত্রী তাকে রাজধানীর মিরপুরে একটি ফ্ল্যাট দিয়েছেন, চিকিৎসার জন্য প্রতি মাসে জনতা ব্যাংকে তার অ্যাকাউন্টে ১০ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়। অনুদান হিসেবে দেওয়া হয়েছে ১০ লাখ টাকা। সেই টাকা দিয়ে বাবার দেওয়া জমিতে একটি দোতলা বাড়ি নির্মাণ করেছেন।

    আক্ষেপের সুরে তিনি বলেন, ‘রাজনীতির জন্য এত ত্যাগের পরেও একমাত্র প্রধানমন্ত্রী ছাড়া অন্য কেউ এমনকি স্বেচ্ছাসেবক লীগ কিংবা সাভার আওয়ামী লীগ থেকে আমার কোনো খোঁজখবর নেওয়া হয়নি।’

    যে দলের জন্য তিনি মৃত্যুর দ্বারপ্রান্ত থেকে ফিরে এসেছেন, সেই দলের স্থানীয় আওয়ামী লীগের কোনো অনুষ্ঠানে তাকে ডাকা হয় না, নিজ উদ্যোগে কোনো অনুষ্ঠানে গেলেও তাকে মঞ্চে উঠানো হয় না, এমনকি একটা বারের জন্য নামটিও ঘোষণা করা হয় না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে বুকে নিয়েছেন জেনেও স্থানীয় নেতারা তাকে প্রাপ্য সম্মানটুকু দিতে চান না বলে অভিযোগ করেন মাহবুবা পারভীন।

    মাহবুবা বলেন, তিনি সংরক্ষিত নারী আসনের সাংসদ হওয়ার জন্য আবেদন করেছিলেন। তিনি আবারও সক্রিয়ভাবে রাজনীতি করতে চান। তার এখন একটাই চাওয়া, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কর্মী হয়ে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কাজ করে যাওয়া।

    পূর্বপশ্চিম/ম

    ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা

    সারাদেশ

    অনুসন্ধান করুন
    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close