• বৃহস্পতিবার, ১৬ মে ২০২৪, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
  • ||

মজুরি বাড়াতে কেন আপত্তি চা বাগান মালিকদের?

প্রকাশ:  ২৩ আগস্ট ২০২২, ০৯:৪১
নিজস্ব প্রতিবেদক

দৈনিক ৩০০ টাকা মজুরির দাবিতে আন্দোলন করছেন চা শ্রমিকরা। শ্রমিক নেতারা সোমবার থেকে ধর্মঘট প্রত্যাহারের ঘোষণা দিলেও বাড়েনি তাদের মজুরি। আপাতত পূর্বের ১২০ টাকা মজুরিতেই কাজে যোগ দিতে হচ্ছে তাদের।

প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে নতুন মজুরি নির্ধারণ করা হবে বলে জানা গেছে। এর আগে গত শনিবার দৈনিক ১৪৫ টাকা মজুরির প্রস্তাব দেওয়া হলেও তা মানেননি চা শ্রমিকরা।

দেশের বিভিন্ন শিল্প খাতের শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণ করে সরকার গঠিত নিম্নতম মজুরি বোর্ড। তাদের তথ্য মতে, দেশের ৩১টি সেক্টরের মধ্যে সবচেয়ে কম মজুরি পান চা শ্রমিকরা। এমনকি প্রস্তাবিত দৈনিক ১৪৫ টাকা বাস্তবায়ন হলেও মজুরির হিসেবে চা শ্রমিকরাই থাকবেন তলানিতে।

বর্তমান বাজার বিবেচনায় চা শ্রমিকদের ৩০০ টাকার কম মজুরিতে জীবিকা চালানো অসম্ভব বলছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

এদিকে বাগান মালিকপক্ষ বলছে, বর্তমান মজুরিতেই লোকসান গুনতে হচ্ছে তাদের। মজুরি আরও বাড়লে লোকসান আরও বাড়বে। ফলে এই শিল্প থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হবেন উদ্যোক্তারা। তাদের দাবি, শ্রমিকরা ১২০ টাকা নয়, বাগান থেকে দেয়া বিভিন্ন সুবিধা মিলিয়ে দৈনিক ন্যূনতম ৪০২ টাকা আয় করে থাকেন।

৩০০ টাকা মজুরিতে কেন আপত্তি চা বাগান মালিকদের বর্তমান বাজার বিবেচনায় চা শ্রমিকদের ৩০০ টাকার কম মজুরিতে জীবিকা চালানো অসম্ভব বলছেন সংশ্লিষ্টরা।

মালিকদের এমন দাবির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন চা শ্রমিকরা।

প্রতি দুই বছর পর পর বাগান মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ চা সংসদ ও শ্রমিক সংগঠন বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে চা শ্রমিকদের মজুরি পুনর্নির্ধারণ করা হয়। সবশেষ ২০১৯ সালে চা শ্রমিকদের মজুরি ১২০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। এরপর দুই বছর পেরিয়ে গেলেও মজুরি না বাড়ায় চলতি মাস থেকে আন্দোলনে নামেন শ্রমিকরা। ৩০০ টাকা মজুরির দাবিতে ১৩ আগস্ট থেকে অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট শুরু করেন দেশের ১৬৬ বাগানের দেড় লাখ শ্রমিক।

শ্রমিকদের ৩০০ টাকা মজুরির দাবি অযৌক্তিক বলে উল্লেখ করে চা-শিল্পের উদ্যোক্তা ও সিলেট মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি আফজাল রশীদ চৌধুরী বলেন, ‘এত টাকা মজুরি দিতে গেলে একটা বাগানও টিকবে না।’

তিনি বলেন, ‘নিলামে প্রতি কেজি চা আমরা বিক্রি করি ১৮০ টাকা করে। অথচ এখন প্রতি কেজি চায়ের উৎপাদন খরচ প্রায় ১৯০ থেকে ১৯৫ টাকা। ফলে গত তিন বছর ধরে দেশের প্রায় সব বাগানই লোকসানে আছে। করোনাকালীন লোকসান এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি বাগানগুলো। এখন প্রধানমন্ত্রী যেটি প্রস্তাব করেছেন, মজুরি আরও ২৫ টাকা বাড়ানোর, সেটি করতে গেলে উৎপাদন খরচ কেজিতে ২০০ টাকা ছাড়িয়ে যাবে। কিন্তু বিক্রির সময় আমরা এই দাম পাব না। এই অবস্থায় মজুরি ৩০০ টাকা করা তো একেবারে অসম্ভব। এই বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে এমন দাবিও অযৌক্তিক।’

৩০০ টাকা মজুরিতে কেন আপত্তি চা বাগান মালিকদের

উদ্যোক্তাদের দাবি, শ্রমিকরা ১২০ টাকা নয়, বাগান থেকে দেয়া বিভিন্ন সুবিধা মিলিয়ে দৈনিক ন্যূনতম ৪০২ টাকা আয় করে থাকেন।

চায়ের দাম বাড়িয়ে কেন শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানো হচ্ছে না– এমন প্রশ্নের জবাবে আফজাল রশীদ বলেন, ‘চা যারা প্যাকেটজাত করে, তারা আমাদের কাছ থেকে কিনে এটি গ্রাহক পর্যায়ে নিয়ে যায়। এরা একটা সিন্ডিকেট করে ফেলেছে। তারা কম দামে চা কিনে বাজারে বেশি দামে বিক্রি করে। আমাদের কেজিপ্রতি ২০০ টাকা দিতে চায় না অথচ তারা বাজারে ৪০০ টাকার ওপরে কেজি বিক্রি করে।’

তিনি বলেন, ‘প্যাকেটজাতকরণ কোম্পানিগুলো এখন অনেক বাগান কিনে নিচ্ছে। তারা চায় বাগান মালিকদের লোকসানে ফেলে নিজেরা বাগান কিনে ফেলতে। ফলে এখন দেখা যাচ্ছে, এই শিল্পের বনেদি উদ্যোক্তা, তারা আর এই খাতে টিকে থাকতে পারছেন না। তারা বাগান বিক্রি করে দিচ্ছেন আর বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো এই খাতে বিনিয়োগ করছে।’

তবে বাগান মালিকদের লোকসান গোনার এমন দাবির সঙ্গে ভিন্নমত জানিয়েছেন সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এমাদউল্লাহ শহিদুল ইসলাম শাহিন। চা শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করার নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা একবার সিলেটের কালনাগুল চা-বাগানের শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলন করেছিলাম। তখন বাগান কর্তৃপক্ষ লোকসানের দোহাই দিয়ে মজুরি বৃদ্ধিতে আপত্তি জানায়। অথচ তারাই তখন সংবাদ সম্মেলন করে বলেছিল, এক মাস আন্দোলনের কারণে কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এক মাস কাজ বন্ধ থাকলে যে বাগানে কোটি টাকার ক্ষতি হয়, সেটি লোকসানে থাকে কী করে?’

শাহিন বলেন, ‘এবারও বাগান মালিকরা জানিয়েছেন, আন্দোলনের ফলে তাদের প্রতিদিন ২০ কোটি টাকা ক্ষতি হচ্ছে। এ ছাড়া বাজারে এখন চায়ের কেজি প্রায় ৫০০ টাকা। ফলে তাদের লোকসানের দাবি এক ধরনের ভাঁওতাবাজি।’

চা শ্রমিক সংসদের হিসাবে, ২০২১ সালে দেশে রেকর্ড ৯ কোটি ৬৫ লাখ কেজি চা উৎপাদিত হয়। এর আগে সর্বোচ্চ রেকর্ড ছিল ২০১৯ সালে। সে বছর ৯ কোটি ৬০ লাখ কেজি চা উৎপাদিত হয়েছিল।

বাগান মালিকদের এই সংগঠনের দাবি, নগদ অর্থ ছাড়াও একজন শ্রমিককে বাগান থেকে বিভিন্ন সেবা ও সুবিধা দেওয়া হয়। সব মিলিয়ে প্রতিদিন একজন শ্রমিকের পেছনে ব্যয় হয় ন্যূনতম ৪০২ টাকা।

চা শ্রমিক সংসদ সিলেট ভ্যালির সভাপতি জি এম শিবলী বলেন, ‘একজন শ্রমিক নগদ মজুরি, বার্ষিক ছুটি ভাতা, উৎসব ভাতা, অসুস্থতাজনিত ভাতা মিলিয়ে দৈনিক গড়ে ২২৬ টাকা আয় করেন। এ ছাড়া ভর্তুকি মূল্যে র‌্যাশন, অবসরকালীন ভাতা, পোষ্যদের শিক্ষা ব্যয়, চাষের জন্য জমি, চিকিৎসা, আবাসনসহ বিভিন্ন সুবিধা মিলিয়ে দৈনিক আরও ১৭৬ টাকা আয় করেন। সব মিলিয়ে তার দৈনিক আয় ৪০২ টাকা। দেশের অন্যান্য খাতের শ্রমিকরাও এ রকম মজুরি পেয়ে থাকেন। ফলে চা শ্রমিকরা কম মজুরি পাচ্ছে- এমন দাবি সত্য নয়।’

শিবলী বলেন, ‘চায়ের গুণগত মান কমে যাওয়া, উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি, রপ্তানি হ্রাস, ভারত থেকে অবৈধভাবে চা আমদানিসহ নানা কারণেই দেশের চা-শিল্প ঝুঁকিতে আছে। লোকসান গুনতে হচ্ছে উদ্যোক্তাদের। এই অবস্থায় শ্রমিকদের বর্তমান দাবি পূরণ করতে গেলে আরও সংকটে পড়বে এই শিল্প।’

তবে মালিকপক্ষের দাবি অনুযায়ী শ্রমিকরা সুবিধা পায় না জানিয়ে চা শ্রমিক ইউনিয়নের সিলেট ভ্যালির সভাপতি রাজু গোয়ালা বলেন, ‘অনেক বাগানে র‌্যাশনের নামে শ্রমিকদের শুধু আটা দেয়া হয়। অথচ আমাদের চুক্তিতে আছে, ছয় মাস চাল এবং ছয় মাস আটা দেয়া হবে। কিন্তু সেটাও তারা মানছেন না। এ ছাড়া চিকিৎসা ও শিক্ষার সুবিধা একেবারেই নামমাত্র। এসব সেবা বাইরে থেকেই আমাদের নিতে হয়।’

র‌্যাশনের সঙ্গে মজুরির কোনো সম্পর্ক নেই উল্লেখ করে চা শ্রমিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নিপেন পাল বলেন, ‘শ্রম আইনের ২(৪৫) ধারায় বলা আছে- বাসস্থান, আলো, পানি, চিকিৎসা সুবিধা, অবসর ভাতা বা ভবিষ্যৎ তহবিলে মালিক কর্তৃক দেয়া টাকা মজুরির অন্তর্ভুক্ত হবে না।

তবে দৈনিক ৩০০ টাকা দিয়েও বর্তমান বাজারে চলা সম্ভব নয় জানিয়ে আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এমাদ উল্লাহ শহীদুল ইসলাম শাহিন বলেন, ‘আমার দাবি তো ছিল দৈনিক ৫০০ টাকা মজুরি। তার পরও শ্রমিক ইউনিয়ন ৩০০ টাকা দাবি করেছে। ৩০০ টাকায় মোটামুটি গা বাঁচানো যায়। কিন্তু মালিকপক্ষ যে প্রস্তাব দিয়েছে, ১৪৫ টাকা দেয়ার, তা বর্তমান বাজারমূল্যের পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তিসংগত নয়।’

তিনি বলেন, ‘বাগান মালিকরা দাবি করছেন, তারা শ্রমিকদের র‌্যাশন, মেডিক্যাল, শিক্ষাসহ বিভিন্ন সুবিধা দেন। কিন্তু বাস্তবে বেশির ভাগ বাগানেই এসব দেয়া হয় না। বেশির ভাগ বাগানে কোনো ডাক্তার নেই, কম্পাউন্ডার দিয়ে চিকিৎসা দেয়া হয়। আর যাদের চাষের জন্য জমি দেয়া হয়, তাদের র‌্যাশন দেয়া হয় না। বাগানে নামমাত্র কিছু প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। উচ্চ শিক্ষার সুযোগ নেই। তাদের আবাসন ব্যবস্থা খুবই নাজুক। সব মিলিয়ে চা শ্রমিকদের সঙ্গে প্রতারণা করা হচ্ছে, শোষণ করা হচ্ছে।’

মালিকদের বিলাসবহুল জীবন নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, ‘বাগান মালিকরা কী বিলাসবহুল জীবন যাপন করেন ও শ্রমিকরা মানবেতর জীবন যাপন করেন। এত পার্থক্য কেন? এটা মানা যায় না।’

পূর্বপশ্চিম/ম

চা শ্রমিক

সারাদেশ

অনুসন্ধান করুন
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close