করমজলের কৃত্রিম প্রজননকেন্দ্রে সফলতায় বিপন্ন প্রাণীর প্রত্যাবর্তন
প্রকৃতি সংরক্ষণ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা আইইউসিএন ২০১৫ সালে বাংলাদেশে বিপন্ন প্রাণীর ‘আইইউসিএন রেড লিস্ট’ নামে একটি তালিকা প্রস্তুত করে। তালিকায় বাটাগুর বাসকাকে মহাবিপন্ন ও লোনা পানির কুমিরকে বিপন্ন প্রজাতি হিসেবে তালিকাভুক্ত করে। যার প্রেক্ষিতে বিপন্ন প্রজাতির প্রাণীগুলোকে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে ফের প্রকৃতিতে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। পূর্ব সুন্দরবনের করমজলে বনবিভাগের উদ্যোগে প্রায় দু’দশক ধরে চলছে এই কার্যক্রম।
ইতোমধ্যে এসব উদ্যোগ আশার কথা শোনাচ্ছে। গত ৯ বছরে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে ২০৬টি বিপন্ন প্রজাতির লোনা পানির কুমির সুন্দরবনের নদীতে অবমুক্ত করা হয়েছে। একই প্রক্রিয়ায় বাটাগুর বাসকা অবমুক্ত করা হয়েছে ১২টি। এছাড়া বর্তমানে করমজল বন্যপ্রাণী প্রজননকেন্দ্রে ১২৯টি কুমির এবং ৪৩২টি কচ্ছপ রয়েছে।
সম্পর্কিত খবর
বন বিভাগ সূত্র জানায়, ২০০২ সালে পূর্ব সুন্দরবনের করমজল পর্যটন কেন্দ্রে ৮ একর জমির উপর গড়ে তোলা হয় বন্যপ্রাণী এ প্রজনন কেন্দ্রটি। শুরুতে রোমিও ও জুলিয়েট নামে দু’টি কুমির দিয়ে এর কার্যক্রম শুরু হয়। এরপর ২০০৫ সালে জুলিয়েট দম্পতি দু’টি ডিম পাড়লে সেখানে শুরু হয় কুমির প্রজননের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম।
একইভাবে ২০১৪ সালে সেখানে শুরু হয় বাটাগুর বাসকা প্রজাতির কচ্ছপের কৃত্রিম প্রজননের কাজ। অবশ্য বন বিভাগের সঙ্গে বাটাগুর বাসকার গবেষণায় যুক্ত হয় প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন, অস্ট্রিয়ার জু ভিয়েনার গবেষণা দল ও যুক্তরাষ্ট্রের টার্টল সারভাইভাল অ্যালায়েন্স। ২০১৭ সাল থেকে কেন্দ্রটিতে ডিম দিতে শুরু করে মহাবিপন্ন প্রজাতির বাটাগুর বাসকা কচ্ছপগুলো।
দীর্ঘ প্রায় এক যুগ ধরে করমজল বন্যপ্রাণী প্রজননকেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার দায়িত্ব পালনকারী হাওলাদার আজাদ কবীরের মাধ্যমেই প্রকৃতিতে ফিরতে শুরু করেছে সেখানকার উৎপাদিত লোনা পানির কুমির।
এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, রোমিও-জুলিয়েটের পর প্রজননের জন্য পিলপিল ও আলেকজান্ডার নামে আরো দু’টি কুমির সম্পৃক্ত করা হয় সেখানে। মধ্যে জুলিয়েট ও পিলপিল ডিম দেয়। ডিমগুলো ইনকিউবেটরে রেখে বাচ্চা ফোটানো হয়।
তিনি জানান, কুমিরের বয়স সাধারণত ৭-৮ বছর এবং দৈর্ঘ্য দুই মিটারের বেশি হলে এগুলো প্রকৃতিতে অবমুক্ত করা হয়। বনবিভাগ ২০১৩ সাল থেকে সুন্দরবনের নদী সমূহে কুমির অবমুক্ত কার্যক্রম শুরু করে। এখন পর্যন্ত গত ৯ বছরে ২০৬টি কুমির অবমুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে গতবছরই অবমুক্ত করা হয়েছে ৯০টি কুমির।
তবে অবমুক্ত করা এসব কুমির সর্বশেষ ঠিক কি অবস্থায় রয়েছে তার তথ্য নেই বনবিভাগের কাছে। এ প্রসঙ্গে হাওলাদার আজাদ কবীর বলেন, কুমির মনিটরিংয়ে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়নি। তবে ২০১৭ সালে দু’টি, ২০১৮ সালে ৫টি এবং ২০১৯ সালে ৫টি কচ্ছপে স্যাটেলাইট ট্রান্সমিটার লাগিয়ে সুন্দরবনে অবমুক্ত করা হয়। প্রতিটি কচ্ছপ কোথায় যাচ্ছে প্রতি ১৫ মিনিট পর পর জিপিএস লোকেশন পাওয়া যাচ্ছে। আফসোসের বিষয় হচ্ছে, প্রজনন মৌসুমে তাদের শব্দ সংকেতের মাধ্যমে স্ত্রী কচ্ছপের সঙ্গে একত্রিত হওয়ার কথা। কিন্তু তারা কোনো সঙ্গীর সন্ধান পায়নি। এমন অবস্থায় সুন্দরবনে বাটাগুর বাসকা প্রজাতির কোনো কচ্ছপ নেই বলে ধারণা তাদের।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নাইমুল নাসের বলেন, কৃত্রিম প্রজননের বিষয়টি খুবই ভালো উদ্যোগ। তবে প্রাকৃতিক পরিবেশের বাইরে প্রজনন ঘটালে কিছুটা সতর্ক থাকতে হবে। কারণ এই প্রক্রিয়ায় প্রাণির মৃত্যুর হার বেড়ে যায়। এ জন্য প্রাণীটি বড় করে কিছুটা নিরাপদ জায়গায় তাদের ছাড়াই, যাতে নিজেরা প্রকৃতির সঙ্গে মিশে নিজেদের রক্ষা করতে পারে।
করমজল বন্যপ্রাণী প্রজননকেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাওলাদার আজাদ কবীর বলেন, লোনা পানির কুমির কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ বংশবিস্তারের সুযোগ কিংবা পরিবেশ হ্রাস পাওয়া। সুন্দরবনের লোনা পানির কুমির উঁচু জায়গায় ডিম পাড়ে। নির্দিষ্ট সময় শেষে বাচ্চা ফুটে বের হয়। কিন্তু বনের ভেতর এখন উঁচু জায়গা কমে গেছে। জোয়ারে অধিকাংশ এলাকা প্লাবিত হয়। ফলে কৃত্রিম প্রজনন সফল হলেও বিপন্ন প্রজাতিটিকে টিকিয়ে রাখতে হলে প্রাকৃতিক প্রজনন ও পরিবেশ ফিরিয়ে আনা অতি জরুরি।
সর্বশেষ প্রাকৃতিক পরিবেশে সব বিপন্ন ও মহাবিপন্ন প্রজাতির প্রাণিগুলো ফের ফিরে পাক তার আপন আবাস। গতি ফিরুক তার প্রজনন পরিবেশের বনবিভাগের পাশাপাশি এমন প্রত্যাশা প্রকৃতিপ্রেমী সব মানুষের।
পূর্বপশ্চিমবিডি/এসএম