• শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
  • ||

বান্দরবানে আতঙ্কের নাম কুকি চিন

প্রকাশ:  ০৮ এপ্রিল ২০২৩, ১৩:৪৫
বান্দরবান প্রতিনিধি

দুই দশকেরও বেশি সময় শান্ত থাকার পর ফের অশান্ত হয়ে উঠেছে পার্বত্য জেলা বান্দরবান। আর এর নেপথ্যে রয়েছে স্থানীয় বিভিন্ন দল ও সংগঠনের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দ্বন্দ্ব। স্থানীয়রা বলছেন, জনসংহতি সমিতি (জেএসএস), জেএসএস সংস্কার, ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ), ইউপিডিএফ সংস্কার, মগ পার্টি ও কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) মতো সংগঠনগুলোর দ্বন্দ্বের কারণে আতঙ্কের জনপদে পরিণত হয়েছে বান্দরবান। বিশেষ করে বান্দরবানের থানচি উপজেলায় কেএনএফের দৌরাত্ম্য সবচেয়ে বেশি বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।

থানচির তিন ইউনিয়নের অর্ধশতাধিক গ্রামে অধিবাসী ১২ হাজারেরও বেশি। তারা অভিযোগ করেছেন, কেএনএফ সদস্যরা রাস্তায় গাছ ফেলে বা সেতুর পাটাতন ভেঙে যাতায়াতে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। ফলে পাহাড়ে কৃষিজমি ও বাজারসহ অন্যান্য গন্তব্যে যাতায়াত, শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা, এমনকি হাসপাতালে যাতায়াতও বিঘ্নিত হচ্ছে। মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে পর্যটন। কেএনএফের ভয়ে অনেকেই বাড়িঘর ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন। এক কথায়, তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে।

উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, পার্বত্য মন্ত্রীর প্রতিনিধি ও থানচি সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অংপ্রু ম্রো বলেন, ‘তাদের (কেএনএফ) কারণে আমার ইউনিয়নের ১০-১৫টি গ্রামের পাঁচ শতাধিক মানুষ ভয়ের মধ্যে দিনযাপন করছে। জনজীবন একেবারে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। পরিস্থিতি শান্ত করতে আমরা কেএনএফের সঙ্গে আলোচনায় বসতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তারা আমাদের কথা কানে তোলেনি।’

স্থানীয় ও প্রশাসন সূত্র জানায়, সশস্ত্র সংগঠন কেএনএফ জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে খবর পেয়ে গত অক্টোবর থেকে পাহাড়ে যৌথ বাহিনীর অভিযান চলছে। এরপর থানচি, রুমা ও রোয়াংছড়ি উপজেলায় পর্যটনকেন্দ্রগুলোয় ভ্রমণে সাময়িক নিষেধাজ্ঞা জারি করে প্রশাসন। এখনো সে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।

স্থানীয় সূত্র জানায়, কেএনএফের উৎপাতে রুমা উপজেলার রেমাক্রী প্রাংসা ইউনিয়নের লুংওয়ের পাড়া, পাইনোওয়াম পাড়া, সলোপি পাড়া, দুলিচাং পাড়া, থামলো পাড়াসহ কয়েকটি এলাকার বাসিন্দাদের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। গত ১১ মার্চ থামলো বম পাড়ায় কেএনএফ সদস্যরা সরকারের উন্নয়নকাজের শ্রমিকদের ওপর অতর্কিত গুলি চালায়। এতে দুই নির্মাণ শ্রমিক গুলিবিদ্ধ হন। পরদিন একই স্থান থেকে ২১ জন শ্রমিকসহ ঠিকাদারকে অপহরণ করে সংগঠনটির সদস্যরা। দুই দিন পর অবশ্য তাদের ছেড়ে দেয়া হয়।

এদিকে থানচি উপজেলার তিন্দু ইউনিয়নের সালুক্যা পাড়া, বংক পাড়া, সাকক্রয় পাড়া, হাজরাই পাড়া, নিপিউ পাড়া, লালদুসাং পাড়া, মতিলাল পাড়া, সাজাই পাড়া, মংখয় পাড়া, খুংলাই পাড়া, পারাও পাড়া, হৈতে পাড়া, অর্জুন পাড়া, রেমং পাড়া, বদুন্যা পাড়া, থানচি সদর ইউনিয়নের সিংতলাংপি পাড়া, থাংডয় পাড়া, সেরকর পাড়া, কাইতং পাড়া, কুংলা পাড়া, বোল্ডিং পাড়া, শাহজাহান পাড়াসহ ৩০-৩৫টি এলাকার বাসিন্দারাও কেএনএফের উৎপাতে অতীষ্ঠ।

থানচি বাজারে প্রতি রবি ও সোমবার সাপ্তাহিক হাট বসে। সম্প্রতি সে হাটে কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেন দৈনিক বাংলার এই প্রতিবেদক। তবে ভয়ে কেউই মুখ খুলতে রাজি হননি। এরপর নিরিবিলি স্থানে গিয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন বলেন, ‘আমরা খুব একটা ভালো নেই।’

ওই ব্যক্তির চোখে-মুখে তখন আতঙ্কের ছাপ। জানালেন, আশপাশের প্রায় ৩০-৩৫টি এলাকার মানুষ ঠিকমতো কাজ করতে পারছে না, জুমে যেতে পারছে না। কুকি চিন এসে ভাত-তরকারি ছাড়াও স্থানীয়দের গৃহপালিত পশুপাখি নিয়ে যায়। ছেলেমেয়েরা ঠিকমতো স্কুলে যেতে পারছে না। নির্ভয়ে যাতায়াতের কোনো সুযোগ নেই। জুমের ও ফলদ বাগানের ফসল ও ফল বেচাকেনা করা যাচ্ছে না। অনেকেই বাড়িঘর ছেড়ে অন্য জায়গায় চলে গেছে।

ট্যুরিস্ট গাইড কল্যাণ সমবায় সমিতি সভাপতি ম্যানুয়েওল ত্রিপুরা ইমন বলেন, পর্যটক ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞার কারণে দুই শতাধিক গাইড ছাড়াও শতাধিক হোটেল-রিসোর্টের কর্মী এবং হাজারও নৌকার মাঝি কর্মহীন হয়ে পড়েছেন।

তিন্দু ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ভাগ্য চন্দ্র ত্রিপুরা বলেন, ‘সমস্যাটি জাতীয় ইস্যু। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি আমরাও এলাকাবাসীদের নিয়ে আলোচনা করে শিগগিরই সমাধানের চেষ্টা চালাব।’

জানতে চাইলে থানচি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইমদাদুল হক বলেন, ‘আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সার্বক্ষণিক কথা বলছি। সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছি।’

আর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুহা. আবুল মনসুর বলেন, ‘প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ের এলাকার শান্তির জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। আশা করছি দ্রুততম সময়ের মধ্যে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে।’

কুকি চিন

সারাদেশ

অনুসন্ধান করুন
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close