• রোববার, ১৯ মে ২০২৪, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
  • ||

তাঁতকে ঘিরে গড়ে উঠেছে গ্রাম, কর্মসংস্থান কয়েক হাজার মানুষের

প্রকাশ:  ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১০:১৮
নিজস্ব প্রতিবেদক

তাঁত শিল্পকে কেন্দ্র করে টাঙ্গাইল সদর উপজেলার বাঘিল ইউনিয়নে গড়ে উঠেছে কৃষ্ণপুর নতুনপাড়া নামের একটি গ্রাম। এ গ্রামে ২৫০টির বেশি তাঁত কারখানা আছে। এসব কারখানায় সরাসরি ২ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। এছাড়াও এ তাঁত শিল্পকে কেন্দ্র করে নানা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠায় পরোক্ষভাবে আরও কয়েক হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এর ফলে বদলে গেছে একটি গ্রামের সামগ্রিক চিত্র।

সম্পর্কিত খবর

    স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, টাঙ্গাইলের দেলদুয়ারের পাথরাইলসহ বিভিন্ন এলাকায় সুতি শাড়ি তৈরি হলেও কৃষ্ণপুর নতুনপাড়া গ্রামে গ্যাস শাড়ি তৈরি হয়। এ গ্রামে প্রতিদিন ২ সহস্রাধিক তাঁতে ৭-৮ হাজার শাড়ি উৎপাদন হয়। এসব শাড়ির দাম ৭০ থেকে ৮০ লাখ টাকা। এখানকার শাড়ি স্থানীয় বাজার ছাড়াও ভারতসহ কয়েকটি দেশে রপ্তানি হয়।

    কৃষ্ণপুর নতুনপাড়া গ্রামে তাঁতকে ঘিরে বিশাল অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞ চললেও ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, এই গ্রামের দিকে তাঁত বোর্ডসহ কারো নজরদারি নেই। তবে, তাঁত বোর্ড বলছে, ওই গ্রামে সমিতি না থাকায় তাঁতিদের সহযোগিতা করা যাচ্ছে না। টাঙ্গাইল থেকে ভারতে শাড়ি রপ্তানি করতে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে টাঙ্গাইল চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ।

    খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৭০ বছর বয়সী আব্দুল গনির হাত ধরে বদলে গেছে কৃষ্ণপুর নতুনপাড়া গ্রামের চিত্র। তিনি সদর উপজেলার হুগড়া ইউনিয়নের বারবালা চরের বাসিন্দা ছিলেন। ১৯৮৮ সালের বন্যায় যমুনা নদীতে বসতভিটা হারিয়ে যাওয়ার পর এখানে আশ্রয় নেন তিনি। তখন এখানে আর কোনো জনবসতি ছিল না। আব্দুল গনি ১৫টি তাঁত মেশিন দিয়ে শুরু করেন শাড়ি বুনন। বর্তমানে আব্দুল গনির ৩৮টি তাঁত আছে। এতে ২৫-৩০ জনের কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে।

    আব্দুল গনি বলেন, যমুনা নদীতে বাড়ি বিলীন হওয়ার পর বাঘিল ইউনিয়নের যুগনি স্লুইসগেটের সামনে আশ্রয় নিয়েছিলাম। পরে এখানে বাড়ি করে ১৫টি তাঁত দিয়ে ব্যবসা শুরু করি। তারপর থেকে ঘুরতে থাকে আমার ব্যবসার চাকা।

    আব্দুল গনিকে দেখে উৎসাহিত হন অনেকে। ধীরে ধীরে এখানে জনবসতি বাড়তে থাকে। বর্তমানে ২৫০ জন তাঁত ব্যবসায়ীর বসবাস এ গ্রামে। তাদের মাধ্যমে প্রতিদিন ৭-৮ হাজার শাড়ি উৎপাদন হয়। এসব শাড়ি উৎপাদনে প্রায় ২ হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। শুধু তাই নয়, এই তাঁত শিল্পকে কেন্দ্র করে স্থানীয়ভাবে গড়ে উঠেছে ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এখানে উৎপাদিত শাড়িগুলো স্থানীয় বাজারসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করা হয়। কয়েক বছর আগেও এই শাড়িগুলো টাঙ্গাইল হয়ে ভারতসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হলেও একটি প্রভাবশালী মহলের কারণে বর্তমানে তা রপ্তানি করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে, সিরাজগঞ্জ হয়ে ভারতসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করতে কৃষ্ণপুর নতুনপাড়া গ্রামের শাড়ি। এতে খরচ বেড়ে যায়।

    শাড়ি ব্যবসায়ী ফরিদুল ইসলাম ও শহিদুল ইসলাম বলেন, কৃষ্ণপুর নতুনপাড়ায় যারা বসবাস করি, সবাই নদীভাঙা মানুষ। তাঁত শিল্পকে কেন্দ্র করে গ্রামটি গড়ে উঠেছে। এখানে হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। আগে আমরা টাঙ্গাইল থেকে ভারতে শাড়ি রপ্তানি করলেও এখন সিরাজগঞ্জের শাহাজাদপুর হয়ে ভারতে শাড়ি রপ্তানি করতে হয়। এতে আমাদের খরচ বেড়েছে।

    সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের তাঁত শ্রমিক রফিকুল মিয়া ও সোলায়মান হোসেন বলেন, কৃষ্ণপুর নতুনপাড়া গ্রামে স্থানীয় ও দূর-দূরান্তের প্রায় ২ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। প্রত্যেক শ্রমিক মাসে ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকা আয় করতে পারেন। বর্তমান সময়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ায় খুব কষ্টে জীবন পার করতে হচ্ছে।

    স্থানীয় মুদি দোকানদার সুজন মিয়া বলেন, শাড়ির ব্যবসাকে কেন্দ্র করে এখানে শতাধিক মানুষের ক্ষুদ্র ব্যবসা করার সুযোগ হয়েছে। এখানে সুতার দোকান, চায়ের দোকান, মুদি দোকান, ওষুধ ও স্বর্ণের দোকানসহ বিভিন্ন ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে।

    অটোরিকশার চালক আলতাব হোসেন বলেন, ধরেরবাড়ী, বানিয়াবাড়ী, দূরিয়াবাড়ী ও কোনবাড়ী থেকে সারা দিনে আমরা যে পরিমাণ যাত্রী না পাই, তার চেয়ে কৃষ্ণপুর নতুনপাড়া থেকে যাত্রী বেশি পাই। তাঁত ব্যবসাকে কেন্দ্র করে অনেকেই প্রতিনিয়ত শহরের যাতায়াত করেন।

    বাঘিল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এস এম মতিয়ার রহমান তালুকদার মন্টু বলেন, তাঁত শিল্পকে কেন্দ্র করে এ এলাকার উন্নয়ন হচ্ছে। আশপাশের এলাকার চেয়ে এ এলাকার জমির দাম অনেক বেশি। এছাড়া, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এই বাজারেই পাওয়া যায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, গ্রাম হবে শহর, এই কৃষ্ণপুর নতুনপাড়া গ্রাম তার দৃষ্টান্ত।

    তাঁত বোর্ডের টাঙ্গাইল কার্যালয়ের লিয়াজোঁ অফিসার রবিউল ইসলাম বলেন, কৃষ্ণপুর নতুনপাড়ার বাসিন্দারা আগে যখন যমুনার চরে বাস করতেন, সেখানে তাদের সমিতি ছিল। সমিতির আওতায় তাদের ঋণসহ নানা সুবিধা দেওয়া হতো। কৃষ্ণপুর নতুনপাড়া গ্রামে তাদের কোনো সমিতি নেই। সমিতি করার জন্য বারবার চেষ্টা করা হয়েছে। সমিতি না থাকায় তাদের ঋণসহ নানা সুবিধা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

    টাঙ্গাইল চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের পরিচালক নাসির উদ্দিন বলেন, ১৫ থেকে ২০ জন লাইসেন্সধারীর মাধ্যমে প্রতি মাসে ৩ থেকে ৪ কোটি টাকার শাড়ি ভারতসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়ে থাকে। কৃষ্ণপুরের শাড়িগুলো যাতে টাঙ্গাইল থেকে রপ্তানি করা যায়, সেজন্য স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে কথা বলা হবে।

    সারাদেশ

    অনুসন্ধান করুন
    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close