• বুধবার, ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

কালের সাক্ষী চুন-শুড়কির অনন্য স্থাপত্য দক্ষিণাঞ্চলকে করেছে ইতিহাস প্রসিদ্ধ

প্রকাশ:  ১৯ নভেম্বর ২০২৩, ১৬:৩২
শেখ নাদীর শাহ্, খুলনা প্রতিনিধি

প্রসিদ্ধ ইতিহাস আর ঐতিহ্যের লীলাভূমি সুন্দরবন উপকূলীয় খুলনার কয়রা উপজেলাটি প্রতিবছর প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে দেশবাসীর কাছে পরিচিতি পেলেও উপজেলার কপোতাক্ষ পাড়ের মসজিদকুড় গ্রামটি যেন দক্ষিণাঞ্চলকে আরও বেশি ইতিহাস প্রসিদ্ধ করেছে।

খুলনা থেকে ৯০ কিলোমিটার দক্ষিণে কয়রা উপজেলার প্রাচীন একটি ইউনিয়ন আমাদি। আর এ ইউনিয়নের মসজিদকুড় গ্রামেই আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে ইট, চুন-সুড়কির গাঁথুনির অপরূপ স্থাপত্যশৈলীর মসজিদকুড় মসজিদটি। স্থানীয়দের ধারণা গ্রামটিরও নামকরণ হয়েছে মসজিদকুড় মসজিদটিকে কেন্দ্র করে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখাযায়, স্থানীয় এলাকাবাসীসহ দূরদূরান্ত থেকে আজও বহু মানুষ আসেন শিল্পীর নিপুন হাতের ছোঁয়ায় গড়া অপরূপ স্থাপত্যশৈলীর এ মসজিদে নামাজ আদায় করতে। নজরকাঁড়া সৌন্দর্যমন্ডিত মসজিদটির রয়েছে সর্বোমোট ৯টি গম্বুজ। মসজিদটির তিনপাশে তিনটি প্রবেশপথের সঙ্গে রয়েছে আরও ছয়টি ছোট প্রবেশ পথ। তবে এখন উত্তর ও দক্ষিণ দিকের প্রবেশ পথ বন্ধ করে দিয়ে শুধু পূর্ব দিকের প্রবেশ পথ দিয়েই মুসল্লিরাসহ দর্শনার্থীরা মসজিদ অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে পারেন।

৪৫ একর জায়গার ওপর প্রতিষ্ঠিত পুরো মসজিদটি বর্গাকার। প্রতি পাশের মাপ হচ্ছে ১৬ দশমিক ৭৬ মিটার, ভেতরের মাপ ১২ দশমিক ১৯ মিটার করে। কেবলামুখী দেয়াল বাদে বাকি তিনটি দেয়ালেই মসজিদে প্রবেশের জন্য তিনটি করে খিলান প্রবেশদ্বার রয়েছে। তবে মাঝের প্রবেশদ্বারগুলো অপেক্ষাকৃত অন্যগুলোর তুলনায় বেশ বড়। কেবলামুখী দেয়ালে অর্ধবৃত্তাকার মিহরাব তৈরি করা হয়েছে। মাঝের মিহরাব অপেক্ষাকৃত বড়। মসজিদের ভেতরে চারটি স্তম্ভের ওপর ছাদ ভর করে আছে। এই চারটি স্তম্ভ মসজিদের ভেতরের অংশকে নয়টি সম বর্গক্ষেত্রে ভাগ করেছে। বর্গক্ষেত্রগুলো গম্বুজ দিয়ে ঢাকা। মসজিদটি একসময় টেরাকোটা দিয়ে সজ্জিত ছিল, এগুলোর অনেকটাই কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।

এছাড়া মসজিদের বাইরের দেয়াল দক্ষিণ, পূর্ব ও উত্তর দিকে পোড়ামাটির চিত্রফলক দ্বারা পদ্মফুল, মালা, বিলম্বিত রজ্জু ও ঘণ্টাসহ বিভিন্ন প্রতিকৃতি দ্বারা অলঙ্কৃত ছিল। খিলান ও কার্নিসের উপরেও অনুরূপ অলঙ্কারের কারুকাজ দ্বারা বেষ্ঠিত ছিল। চারটি প্রস্তর স্তম্ভ ও চারিদিকের দেয়ালের ওপর খিলানের সাহায্যে নির্মিত হয়েছে মসজিদের নয়টি গম্বুজ। যদিও মসজিদের ভেতরের খিলান গম্বুজ গুলোর নির্মাণশৈলী অত্যন্ত নিখুঁত ও উচ্চমানের। কেন্দ্রীয় গম্বুজটি অন্যগুলোর তুলনায় আকারে বেশ কিছুটা বড়।

স্থানীয়রা জানায়, এক সময় মসজিদের স্তম্ভগুলোতে এলাকাবাসী তেল লাগিয়ে তা নিয়ে যেতেন। যদিও কুসংস্কার তবুও তারা বিশ্বাস করতেন , এই তেল গায়ে মাখলে বা খেলে অনেক রোগব্যাধী থেকে আরোগ্য লাভ করা যায়। তবে তেল মাখতে মাখতে স্তম্ভগুলো ক্রমশ সরু হতে থাকায় পরবর্তীতে তা ইট-সিমেন্ট দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। এমনকি সেখানে বিভিন্ন ধরনের মানতও করা হতো। তবে সর্বশেষ এসব কিছুই নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

তবে মসজিদটিতে কোনো শিলালিপি পাওয়া না গেলেও এটি বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ ও মসজিদকুড়ের নয়গম্বুজ মসজিদের গঠন প্রণালী ও স্থাপত্যশৈলীতে কোন প্রকার বৈসাদৃশ্য না থাকায় এটি খানজাহান আলী (রহ.) কর্তৃক নির্মিত বা তার সমসাময়িক বলে ধারণা করা হয়।

খান-ই-জাহান সম্পর্কে স্থানীয়দের প্রবল জনশ্রুতির ভিত্তিতে তথ্য অনুসন্ধানে জানাযায়, ১৪১৮-১৪৩২ খ্রিষ্টাব্দে গৌড়ের সুলতান ছিলেন জালাল উদ্দীন মুহাম্মদ শাহ। এই সময় হজরত খানজাহান আলী (রহ.) দক্ষিণবঙ্গে আগমন করেন। সর্বপ্রথম তিনিই যশোরের বারোবাজার তারপর মুরলী পর্যন্ত দ্বীন প্রচার করেন এবং সফলও হন। এরপর মুরালী কসবা হতে খানজাহান আলী তার কাফেলাকে দুই ভাগে বিভক্ত করেন। এর একটি কপোতাক্ষ নদ বেয়ে সুদূর সুন্দরবন অঞ্চলে গিয়ে পৌঁছায়। এই কাফেলার আমির ছিলেন বোরহান খাঁ ওরফে বুড়ো খাঁ যিনি হজরত খানজাহান আলীর (রহ.) একান্ত সহচর ছিলেন। এই বুড়ো খাঁর এক ছেলে ছিলো ফতেহ খাঁ। পিতা-পুত্র উভয় মিলে এ অঞ্চলে ধর্মপ্রচারে ব্রতী হন। এভাবেই এই কাফেলা সুন্দরবনের প্রাণকেন্দ্র আমাদিতে পৌঁছান। এটিই ছিল তাদের শেষ সীমানা।

স্থানীয় বিভিন্ন সূত্র আরও জানান, মসজিদের দক্ষিণ দিকে বুড়ো খাঁ ও ফতেহ খাঁর কাছারিবাড়ি ও সমাধি ছিল, যার অনেকটাই তৎকালীন আগ্রাসী কপোতাক্ষের বন্যায় ধুয়ে মুছে যায়। মূল মসজিদটিও একসময় পলিতে তলিয়ে গিয়েছিল। সব এলাকা জঙ্গল হয়ে গিয়েছিল। জীবজন্তুর ভয়ে মানুষ মসজিদেও যেতে সাহস করত না। পঞ্চদশ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে খুলনার পাইকগাছার সীমান্তবর্তী কয়রা উপজেলার শুরুতেই কপোতাক্ষ নদের তীরে মসজিদকুড় মসজিদটি নির্মাণ করা হয় বলে ধারণা করা হয়। মসজিদের দক্ষিণে কপোতাক্ষ নদ আর পশ্চিমে খাল।

মসজিদকুড় গ্রামের প্রবীণদের সাথে কথা বলে জানাযায়, তৎকালীন সময়ে অত্র এলাকার জঙ্গলের কাঠ কেটে কলকাতায় বিক্রি করা হতো। এ সময়ই মূলত কাঠ কাটতে গিয়ে মসজিদটির সন্ধান মেলে।

মসজিদের ইমাম ও খতিব মাওলানা মাহমুদুল হাসান জানান, অত্র এলাকার সবচেয়ে প্রাচীনতম নিদর্শন এটি। যার ফলে প্রতিদিন নিদর্শনটি দেখতে দেশি বিদেশি বহু মানুষ আসেন। আর এমন একটি প্রাচীনতম মসজিদের দায়িত্ব পালন করতে পেরে আল্লাহর প্রতি শুকরিয়া জানিয়ে নিজেকে গর্বিত মনে করেন বলেও প্রকাশ করেন তিনি।

সর্বশেষ যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নসহ গোটা মসজিদকে একটি কমপ্লেক্স হিসেবে গড়তে পারলে আরো আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে মসজিদকুড়। আর এমটি হলে সুন্দরবন কেন্দ্রিক পর্যটকদের আনাগোনাও বৃদ্ধি পাবে। আর তাই দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম প্রচীন একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে মসজিদকুড়ের রক্ষণাবেক্ষণ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর করলেও এটিকে দর্শনার্থীদের কাছে আকর্ষণীয় করতে সকলের আনন্তরিকতা ও সংশ্লিষ্টদের স্বদিচ্ছার দাবি জানান স্থানীয় সর্বোস্তরের মানুষ।

ঐতিহ্য

সারাদেশ

অনুসন্ধান করুন
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close