• শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
  • ||

বাবার পরশ খোঁজতে ৩৪০ বধ্যভূমির মাটি সংগ্রহ

প্রকাশ:  ০৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৭:৪১
আনোয়ার হোসেন , ভালুকা প্রতিনিধি

মহান মুক্তিযোদ্ধে শহীদ হওয়া বাবার লাশ বা কবরের সন্ধান পাবেননা কখনও জেনেও দেশের বেশিরভাগ বধ্যভূমিতে গিয়ে বাবার পরশ খোজেছেন কন্যা সেলিনা রশিদ। বাবার প্রতি ভালোবাসার নিদর্শন স্বরূপ দেশের ৩৪০ বধ্যভূমির মাটি সংগ্রহ করেছেন তিনি। সেই মাটি দিয়ে ময়মনসিংহের ভালুকায় গড়ে তুলেছেন ব্যতিক্রমী এক বিশাল সংগ্রহশালা।

তাঁর বিশ্বাস, এই বধ্যভূমির কোনো একটিতে তার বাবা জহির উদ্দিন মিশে আছেন। পাশাপাশি তাঁর সংগ্রহশালায় সংরক্ষণ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধি পারের মাটি, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের কবরের মাটি, ভাষাশহীদ, ভাষাসৈনিক এবং জাতীয় চার নেতার কবর পারের মাটি। এখনো কোনো বধ্যভূমির খবর পেলে সেখানে ছুটে যান সেলিনা। সংগ্রহ করেন সেখানকার পবিত্র মাটি। বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, ২১শে ফেব্রুয়ারি সংগ্রহ করা এসব স্মৃতিচিহ্নে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান তিনি। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের একাধিক মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও বিশিষ্টজনেরা সেলিনার এ ব্যাতিক্রমি সংগ্রহশালা পরিদর্শন করেছেন। সাধারণ মানুষও পরিবার নিয়ে পরিদর্শণ করেন সেলিনা রশিদেরর সংগ্রহশালা।

সেনাবাহিনীতে চাকরির সুবাদে সেলিনার বাবা জহির উদ্দিন ছিলেন অস্ত্রের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। দিনাজপুর, রংপুর ও ঠাকুরগাঁওয়ে ৬ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন তিনি। ১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ সকালে স্ত্রী ও চার মেয়েকে বাড়িতে রেখে বের হয়ে নীলফামারীর সৈয়দপুরের ক্যাম্পে যান সেলিনার বাবা। সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকে সেলিনার মা আনোয়ারার কাছে একটি টেলিগ্রাম আসে, ‘মুক্তিযোদ্ধা জহির উদ্দিন নিখোঁজ!’ এর কিছুদিন পর আরেকটি টেলিগ্রাম আসে। সেখানে লেখা ছিল, ‘মুক্তিযোদ্ধা জহির উদ্দিনকে পাক বাহিনী গুলি করে হত্যা করেছে।’ তার পর থেকে শহিদ মুক্তিযোদ্ধা জহির উদ্দিনের স্ত্রী-সন্তানদের ওপর নেমে আসে স্বজনদের নির্যাতনের খরগ। জোর করে তাঁদের পৈত্রিক সম্পত্তি ও উত্তরাধিকারের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। নির্মম-নিষ্ঠুরতায় কাটতে থাকে সেলিনার পরিবারের দিনগুলো। এর মধ্যেও কষ্ট করে সেলিনারা চার বোন লেখাপড়া চালিয়ে যান। ১৯৭৯ সালে এসএসসি পাসের পর ১৯৮০ সালে ভালুকার আবদুর রশিদের সঙ্গে সেলিনার বিয়ে হয়। বিয়ের পর তিনি এইচএসসি, ডিগ্রি, এমএ, এমবিএ ও পিএইচডি অর্জন করেন। কিন্তু প্রতি মুহূর্তে তাঁকে তাড়িয়ে বেড়ায় বাবার স্মৃতি। কতজনের বাবাই তো যুদ্ধ শেষে স্বাধীন দেশে ফিরে এসেছেন। অথচ তাঁর বাবা ফিরলেন না। সেই থেকে তিনি শুরু করেন বাবাকে খোঁজা। বছরের পর বছর ধরে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের বধ্যভূমিগুলোতে যেতে শুরু করেন। পরম মমতায় সংগ্রহ করতে শুরু করেন বধ্যভূমির পবিত্র মাটি। তাঁর বিশ্বাস হয়তো এসব বধ্যভূমির কোনো একটির পবিত্র মাটিতে শুয়ে আছেন তাঁর বাবা।

শেলিনা রশিদ শহীদ সন্তান ৭১’-এর কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি, ময়মনসিংহ জেলা মহিলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক ও ভালুকা উপজেলা পরিষদের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান।

ব্যাতিক্রমি সংগ্রহশালা নিয়ে অপর এক মুক্তিযোদ্ধা সন্তান মাহমুদা সুলতানা মুন্নি বলেন, ‘সেলিনা রশিদের অনন্য এ উদ্যোগ আমাদের জন্য অত্যান্ত গর্বের। আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা এখানে গিয়ে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। আমরা সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি, যেসব শহীদ মুক্তিযোদ্ধার লাশ পাওয়া যায়নি, তাঁদের জন্য এলাকাভিত্তিক একটি করে প্রতীকী কবর স্থাপন করার।’

সংগ্রহশালার প্রতিষ্ঠাতা ড. সেলিনা রশিদ বলেন, ‘পুরো দেশটাকে মনে হয় আমার বাবার সমাধিস্থল। বাবার রক্তে ভেজা এ বাংলার মাটি বড় বেশিই পবিত্র। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বয়স ছিল ১০ বছর। চার বোন আর মাকে শ্রীপুরের চকপাড়া গ্রামের বাড়িতে রেখে বাবা চলে যান যুদ্ধে। ফিরে আসার কথা ছিল, বাবা আসেননি। বহুকাল ধরেই বিভিন্ন স্থানে বাবার লাশ কিংবা তার সমাধি খুঁজে বেরিয়েছি। কোথাও পাইনি। এ কারণে দেশের প্রায় সকল বধ্যভূমির মাটি সংগ্রহ করেছি। আমার বিশ্বাস, এই মাটিতেই ঘুমিয়ে আছেন বাবা। আমি একটি প্রতীকী সমাধি নির্মাণ করে দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুতি জানাই।

মুক্তিযুদ্ধে

সারাদেশ

অনুসন্ধান করুন
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close