• বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

এক ভবন উদ্বোধনেই সাড়ে ৪৪ লাখ টাকা খরচ

প্রকাশ:  ১৬ ডিসেম্বর ২০২৩, ২০:৫৯
পূর্বপশ্চিম ডেস্ক

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ভবন উদ্বোধনেই ৪৪ লাখ ৫৫ হাজার টাকা খরচ করেছে কর্তৃপক্ষ। বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরিন সায়েন্সেস অ্যান্ড ফিশারিজ অনুষদের একাডেমিক ভবন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এ খরচ দেখানো হয়েছে। তবে এ খরচ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছে নানা সমালোচনা। জ্যেষ্ঠ শিক্ষকেরা এটির সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করে বলছেন, ভবন উদ্বোধনে এত টাকা খরচ করা অস্বাভাবিক।

বিশ্ববিদ্যালয়ে দুটি দপ্তরের নথিপত্রে দেখা যায়, ভবনটি উপলক্ষে উপাচার্যের নির্দেশে দুই দফায় টাকা নিয়েছেন প্রক্টর নূরুল আজিম সিকদার। প্রথম দফায় টাকা নেন ৩০ মে। ওই দিন পরিকল্পনা উন্নয়ন দপ্তরের এক চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, শিক্ষামন্ত্রীর সফর উপলক্ষে গঠিত কমিটির সদস্যসচিবকে (প্রক্টর) ৩৩ লাখ ৫৫ হাজার টাকা অগ্রিম দেওয়ার জন্য উপাচার্য শিরীণ আখতার নির্দেশ দিয়েছেন। ওই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ওই দিন টাকা তোলেন প্রক্টর।

আর দ্বিতীয় ধাপে টাকা নেন ১৮ সেপ্টেম্বর। ওই দিন হিসাব নিয়ামক দপ্তরকে দেওয়া এক চিঠিতে প্রক্টর নূরুল আজিম সিকদার উল্লেখ করেন, ভবন উদ্বোধন অনুষ্ঠান পরিচালনার জন্য যে ৩৩ লাখ টাকা তিনি নিয়েছিলেন তা দিয়ে অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়নি। দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি ও আনুষঙ্গিক অতিরিক্ত খরচের কারণে আরও ১১ লাখ টাকা প্রয়োজন। অর্থাৎ ভবন উদ্বোধনের খরচ হয়েছে ৪৪ লাখ ৫৫ হাজার টাকা।

‘ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্সেস অ্যান্ড ফিশারিজ গবেষণা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় নির্মিত হয়েছে এ ভবন। এতে ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্সেস, ফিশারিজ ও সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের একাডেমিক অবকাঠামোর সুবিধা রয়েছে। এটির নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল ২০১৯ সালের ২৯ জানুয়ারি। এতে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩৫ কোটি টাকা। নির্মাণ শেষে গত এপ্রিলে বিশ্ববিদ্যালয়কে কাজ বুঝিয়ে দেন ঠিকাদার। পরে ৪ নভেম্বর শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি এর উদ্বোধন করেন।

ভবন উদ্বোধন উপলক্ষে ৪৪ লাখ টাকা কোন কোন খাতে খরচ করা হয়েছে তা জানতে বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়োজক কমিটির আহ্বায়ক মেরিন সায়েন্সেস অ্যান্ড ফিশারিজ অনুষদের ডিন মো. শফিকুল ইসলাম ও সদস্যসচিব নূরুল আজিম সিকদারের সঙ্গে কমপক্ষে সাত দিন যোগাযোগ করেছেন প্রথম আলোর এ প্রতিবেদক। একাধিকবার সাক্ষাৎ করেছেন। তবে তাঁরা কেউই নির্দিষ্ট কোনো হিসাব দিতে পারেননি।

ভবন উদ্বোধনের এ খরচ সম্পর্কে জানতে চেয়ে অন্তত পাঁচবার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শিরীণ আখতারের কার্যালয়ে গেলেও তিনি সাক্ষাৎ করতে রাজি হননি। পরে একাধিকবার মুঠোফোনে কল করা হলেও তিনি সাড়া দেননি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত হিসাব নিয়ামক মো. আমিরুল ইসলামের কার্যালয়ে একাধিকার গেলেও তিনি সাক্ষাৎ করতে রাজি হননি। গত ১৮ অক্টোবর ওই অনুষদের ডিনের কার্যালয়ে মো. শফিকুল ইসলাম ও নূরুল আজিম সিকদারের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। ওই সময় আয়োজক কমিটির সদস্য মেরিন সায়েন্সেস ইনস্টিটিউটের পরিচালক শেখ আফতাব উদ্দিনও ছিলেন। তাঁরা তিনজন খরচের তিন খাতের কথা উল্লেখ করে আনুমানিক মৌখিক হিসাব দেন। তবে কোনো লিখিত হিসাব দিতে পারেননি। সর্বশেষ ১ নভেম্বর প্রক্টর নূরুল আজিম সিকদারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাঁর কাছে এসবের হিসাব নেই বলে জানান।

আয়োজক কমিটির এ তিন সদস্যের মতে, খাওয়া ও আপ্যায়ন বাবদ খরচ হয়েছে প্রায় ১৫ লাখ টাকা। এ ছাড়া আলোকসজ্জা, ভিডিও প্রামাণ্যচিত্র তৈরি, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বাদক দল ও আতশবাজিতে খরচ হয়েছে ২২ লাখ ৮৮ হাজার টাকা। বাকি ৬ লাখ ৪৪ হাজার টাকা ভ্যাট দেওয়া হয়েছে।

নির্দিষ্ট করে কেন বলা যাচ্ছে না, এমন প্রশ্নের জবাবে মো. শফিকুল ইসলাম ও নূরুল আজিম সিকদার বলেন, অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে কয়েকটি উপকমিটি করা হয়েছিল। এসব কমিটির সদস্যরা সবাই মিলে এ টাকা খরচ করেছেন। এ কারণে তাঁরা নির্দিষ্ট করে বলতে পারবেন না।

অর্থসংকটের কারণে যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত পাঠদান, গবেষণা ও ছাত্রছাত্রীদের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। সেখানে এসব বিষয়ে এত টাকা খরচ করা অস্বাভাবিক। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থে এসব বিষয়ে সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া উচিত।

অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান ছিদ্দিকী, সভাপতি, শিক্ষক সমিতি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

ভবন উদ্বোধনের এ খরচ সম্পর্কে জানতে চেয়ে অন্তত পাঁচবার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শিরীণ আখতারের কার্যালয়ে গেলে তিনি সাক্ষাৎ করতে রাজি হননি। পরে একাধিকবার মুঠোফোনে কল করা হলেও তিনি সাড়া দেননি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত হিসাব নিয়ামক মো. আমিরুল ইসলামের কার্যালয়ে একাধিকার গেলে তিনি সাক্ষাৎ করতে রাজি হননি।

আপ্যায়নের ১৫ লাখ কীভাবে খাওয়া আর আপ্যায়নে ১৫ লাখ টাকা কীভাবে খরচ হয়েছে, এ প্রশ্নের জবাবে আয়োজক কমিটির সদস্য শেখ আফতাব উদ্দিন দাবি করেন, উদ্বোধনের দিন প্রায় আট হাজার লোকের দুপুরের খাওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন তাঁরা। এর মধ্যে এক হাজার পুলিশ ও সাংস্কৃতিক কর্মী, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও কর্মচারী ছিলেন। তবে গত ৪ নভেম্বর শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি যে মিলনায়তনে উপস্থিত হয়ে ভবন উদ্বোধন করেন, সে মিলনায়তনের দর্শক ধারণাক্ষমতা ছিল ২৫০ জনের।

বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন জ্যেষ্ঠ শিক্ষক ও বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভবন উদ্বোধনের জন্য এত টাকা আগে কখনো খরচ হয়নি। গত ২৭ অক্টোবরেও একসঙ্গে ছাত্রদের দুটি আবাসিক হল উদ্বোধন করেছে কর্তৃপক্ষ।

পাচার্যের দপ্তরের সম্মেলনকক্ষে ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমে উপস্থিত থেকে উদ্বোধন ঘোষণা করেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ওই দিনের অনুষ্ঠানে কর্তৃপক্ষের খরচ ২০ হাজার টাকার বেশি হবে না।

বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন জ্যেষ্ঠ শিক্ষক ও বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভবন উদ্বোধনের জন্য এত টাকা আগে কখনো খরচ হয়নি। গত ২৭ অক্টোবরেও একসঙ্গে ছাত্রদের দুটি আবাসিক হল উদ্বোধন করেছে কর্তৃপক্ষ। উপাচার্যের দপ্তরের সম্মেলনকক্ষে ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমে উপস্থিত থেকে উদ্বোধন ঘোষণা করেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ওই দিনের অনুষ্ঠানে কর্তৃপক্ষের খরচ ২০ হাজার টাকার বেশি হবে না।

তদন্তের দাবি

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের ৪৪ লাখ টাকার এ খরচকে অস্বাভাবিক বলে মনে করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান ছিদ্দিকী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, অর্থসংকটের কারণে যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত পাঠদান, গবেষণা ও ছাত্রছাত্রীদের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। সেখানে এসব বিষয়ে এত টাকা খরচ করা অস্বাভাবিক। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থে এসব বিষয়ে সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া উচিত। প্রশাসনের লোক দিয়ে যদি তদন্ত হয়, সেখানে কতটা সত্য বেরিয়ে আসবে, এ বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে। তাই নির্ভরযোগ্য সংস্থা দিয়ে এর তদন্ত করতে হবে।

দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যয় সংকোচন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) নির্দেশনা রয়েছে। গত বছরের ২৫ জুলাই এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ইউজিসি জানায়, জরুরি ও অপরিহার্য ক্ষেত্র বিবেচনা না হলে অর্থ ব্যয় করা যাবে না। যদি অপরিহার্য হয়, তাহলে ওই খাতে বরাদ্দের ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ব্যয় করা যাবে।

জানতে চাইলে ইউজিসির অর্থ ও হিসাব বিভাগের দায়িত্বে থাকা সদস্য অধ্যাপক মো. আবু তাহের প্রথম আলোকে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি কমিশনের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অধ্যাপক মুহাম্মদ আলমগীরের সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন। পরে মুহাম্মদ আলমগীর প্রথম আলোকে বলেন এ বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না। জানলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবেন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

সারাদেশ

অনুসন্ধান করুন
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close