• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

মানবতার কাছে জয়ী নাজমুলের উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন

প্রকাশ:  ০১ অক্টোবর ২০১৮, ১৩:৫৩
দেবাশীষ দত্ত, কুষ্টিয়া

প্রাইভেট টিউশনি আর দিনমজুরী করে সংসারের ঘানি টেনেও কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার হালসা ডিগ্রী কলেজ থেকে মানবিক বিভাগ থেকে এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ লাভ করে মেধাবী ছাত্র নাজমুল। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স ১ম বর্ষের খ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করে নাজমুল মেধা তালিকায় ৪৭৬ নম্বরে রয়েছে। অথচ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় মেধা তালিকায় স্থান পাওয়ার পরও অর্থের অভাবে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল নাজমুলের উচ্চ শিক্ষা।

এর আগে এইচ.এস.সি পরীক্ষায় পাশ করার পর নাজমুলকে নিয়ে পূর্বপশ্চিমবিডিসহ দেশের কয়েকটি জনপ্রিয় অনলাইনে “অর্থের অভাবে বন্ধ হতে চলেছে নাজমুলের উচ্চ শিক্ষা” প্রথম সংবাদ প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে ভর্তি পরীক্ষায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাই নাজমুল। কিন্তু অর্থের অভাবে তার উচ্চশিক্ষা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। আবারও কুষ্টিয়ার স্থানীয় দৈনিক পত্রিকাসহ কয়েকটি অনলাইন পোর্টালে নাজমুলের দারিদ্রতা নিয়ে সংবাদ প্রকাশ হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সংবাদটি ছড়িয়ে পড়লে কুষ্টিয়ার নবাগত পুলিশ সুপার বিষয়টি নজরে নিয়ে নাজমুলকে সহায়তা প্রদানের ইচ্ছা পোষণ করেন। মেধাবী সেই নাজমুলের ভর্তির জন্য কুষ্টিয়ার নবাগত পুলিশ সুপার এসএম তানভির আরাফাত পিপিএম নগদ ২০ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা প্রদান করেছেন।

সোমবার (১ অক্টোবর) বেলা ১১টায় পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের নিজ কক্ষে পুলিশ সুপার নাজমুলের হাতে এ অর্থ তুলে দেন। এ সময় নাজমুলের দিনমজুর পিতা আজিজ হোসেন ও মা নাসিমা খাতুন ও হালসা ডিগ্রী কলেজের শিক্ষক ইমাজ উদ্দিন সেখানে উপস্থিত ছিলেন। এ সময় পুলিম সুপার সাংবাদিকদের বলেন, আমিও অর্থাভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারি নি। অর্থাভাবে নাজমুলের মত অদম্য মেধাবী একজন ছাত্র চান্স পেয়েও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারবে না এটা কোন ভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। তাই সঙ্গে সঙ্গেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি ছেলেটিকে সহযোগিতা করার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির হওয়ার জন্য হাতে নগদ টাকা তুলে দেওয়ার পাশাপাশি নাজমুল যাতে পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারে তার সব ব্যবস্থা তিনি করবেন বলে ঘোষণা দেন। বলেন, তোমার যে কোন প্রয়োজনে আমি তোমার পাশে আছি। নাজমুলের উদ্দেশ্যে পুলিশ সুপার বলেন, দৃঢ়তা ও মনোবল রেখে সামনের দিকে এগিয়ে যাও। ছাত্রবস্থায় আমি নিজেও টিউশনি করে পড়ালেখার খরচ চালিয়েছি। ঢাকায় প্রচুর টিউশনির সুযোগ রয়েছে। তুমি অবসর সময় টিউশনি করে পড়ালেখার খরচ জোগাড় করতে পারবে। এসপি নাজমুলকে পরামর্শ দেন রাজনীতি অ্যাভয়েড করার চেষ্টা করবে। আর যদি রাজনীতি করতেই হয় তাহলে প্রগতিশীল, মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের রাজনৈতিক দল করবে।

এদিকে নাজমুলকে নিয়ে সংবাদ প্রকাশের পর বেশ কয়েক জন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান তাকে আর্থিক সহায়তা প্রদানের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। কুষ্টিয়ার মৌবন সুইটস নামের একটি প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর থেকে যত দিন পড়ালেখা শেষ না হবে ততদিন পর্যন্ত নাজমুলকে মাসিক ২৫০০ টাকা করে সহায়তা প্রদান করার ঘোষণা দিয়েছে। প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক সাবিনা আঞ্জুম জনি রোববার নাজমুলের উপস্থিতিতে গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে এ ঘোষণা দেন।

জনা গেছে, প্রাইভেট টিউশনি আর দিনমজুরী করে সংসারের ঘানি টেনেও কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার হালসা ডিগ্রী কলেজ থেকে মানবিক বিভাগ থেকে এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ লাভ করে অদম্য মেধাবী নাজমুল। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স ১ম বর্ষের খ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করে নাজমুল মেধা তালিকায় ৪৭৬ নম্বরে রয়েছে। পরীক্ষায় তার রোল ছিল ৯০৪৮১৪। নাজমুল জানায়, অনেকে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করার জন্য ভাল কোচিং-এ ভর্তি হয়। অনেক পড়াশোনা করে। কিন্তু অভাবের কারণে সে কোচিং করার কোন সুযোগ পাইনি। প্রাইভেট টিউশনির পাশাপাশি যতটুকু সময় পেয়েছি বাড়িতে পড়াশোনা করেছে। অনেক কষ্ট করে টাকা জোগাড় করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। মনোবল ছিল মেধা তালিকায় তার নাম থাকবে। বাস্তবেও তাই হয়েছে। মেধা তালিকায় তার নাম এসেছে। আগামী ২১ আগস্ট তার ভাইবা পরীক্ষা রয়েছে। নাজমুলের ইচ্ছা রয়েছে ইংরেজী সাহিত্য নিয়ে পড়ালেখা করার। তবে মেধা তালিকায় স্থান পেয়েও শেষ পর্যন্ত অর্থাভাবে নাজমুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি এবং পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারবে কিনা এনিয়ে যথেষ্ট সংশয় দেখা দিয়েছে।

মিরপুর উপজেলার নিভৃত পল্লী কুর্শা ইউনিয়নের মাজিহাট গ্রামের হত দরিদ্র দিনমজুর আজিজ হোসেন ও নাসিমা খাতুনের দুই ছেলে মেয়ের মধ্যে সবার বড় নাজমুল। আজিজ হোসেনের নিজের কোন জমি নেই। সহায়-সম্বল বলতে গেলে দুই কাঠা জায়গার উপরে নির্মিত টিনের কুঁড়ে ঘরটি। সামান্য দিনমজুরী করে ঠিক মত সংসার চলে না। তার ওপরে আবার সবদিন হাতে কাজ থাকে না দিনমজুর আজিজ হোসেনের। যেদিন হাতে কাজ থাকে না সেদিন এক-আধ বেলা সবাইকে উপোষ থাকতে হয়। মা নাসিমা খাতুনও দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। নিয়মিত ওষুধ খেতে হয়। ছোট বোন আর্জিনা খাতুন একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। মাঝিহাট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণীর ছাত্রী। সংসার চালাতে গিয়ে পিতাকে হিমশিম খেতে দেখে ৮ম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় নাজমুল প্রাইভেট টিউশনি শুরু করে। কোন দিন আবার চলে পিতার সাথে দিনমজুরী।

এভাবে প্রাইভেট টিউশনি আর পিতার সাথে দিনমজুরী করে মাঝিহাট মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ৪ দশমিক ৫৬ পেয়ে উত্তীর্ণ হয় নাজমুল। এইচএসসিতে ভর্তি হয় মিরপুর উপজেলার হালসা ডিগ্রী কলেজে। প্রতিনিয়ত দারিদ্রের সাথে সংগ্রাম করেও নাজমুল এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় মানবিক বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছে।

এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় হালসা ডিগ্রী কলেজ থেকে ২শ জন পরীক্ষার্থী অংশ নেই। এর মধ্যে উত্তীর্ণ হয়েছে ৮৬ জন। তবে এই কলেজ থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছে একমাত্র নাজমুল। অদম্য ইচ্ছা শক্তি থাকলে দারিদ্র্যতাকে পেছনে ফেলে যে সফলতা পাওয়া যায় তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হচ্ছে নাজমুল। পড়ালেখা শেষ করে বিসিএস দিয়ে পুলিশ ক্যাডারে চাকুরী করার ইচ্ছা নাজমুলের। মা নাসিমা খাতুন বলেন, টাকার অভাবে নাজমুল মাঠে কাজ করেছে। প্রাইভেট পড়িয়ে সংসার চালানোর পাশাপাশি নিজের পড়ালেখার খরচ জুগিয়েছে। হালসা ডিগ্রী কলেজের শিক্ষক আব্দুল মজিদ বলেন, নাজমুল আমাদের কলেজের গর্ব। প্রতিনিয়ত দারিদ্রের সাথে সংগ্রাম করে আজ সে এ পর্যন্ত এসেছে। তিনি বলেন, প্রাচ্যের অক্সফোড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়ে নাজমুল প্রমাণ করেছে সে আসলেই অদম্য মেধাবী। তাই আমি মনে করি নাজমুলের উচ্চশিক্ষা লাভের স্বপ্ন পূরণে সমাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আসা উচিত।

/পি.এস

কুষ্টিয়া,উচ্চশিক্ষা

সারাদেশ

অনুসন্ধান করুন
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close