নিহত ধর্ষিতা রূপার কথা ভুলে গেলে নারীর জন্য গোটা দেশ নিরাপদ নয়
ধর্ষিতা রূপার কথা কি আমরা ভুলে যাচ্ছি? বগুড়া থেকে ময়মনসিংহ যাবার পথে ছোঁয়া পরিবহনে বাসের চালক হেলপারদের হাতে রূপা নামের তরুণী ধর্ষিতাই হয়নি, জোরপূর্বক তার সম্ভ্রম কেড়েই নেয়া হয়নি, যৌন অত্যাচারই করা হয়নি; ঘাড় মটকে হত্যা করেছে ঘাতকেরা। সিরাজগঞ্জের মেয়ে রূপা বগুড়া আজিজুল হক কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক পাস করেছিল। ভর্তি হয়েছিল ঢাকার আইডিয়াল ল কলেজে।
রূপা নামের মেয়েরা যেরকম সুন্দরী হয়, এই রূপাও সেই রকম ছিল। মুক্তমনের রূপা বিশ্বাস করেছিল রাষ্ট্র তার জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে। রূপা বিশ্বাস করেছিল সমাজ অগ্রসর হয়েছে, নারীর ক্ষমতায়ন ঘটেছে। মেয়েরা একা চলাফেরা করতে পারে, বসবাস করতে পারে। জীবনের বিনিময়ে তার বিশ্বাস ভঙ্গ হয়েছে।
সম্পর্কিত খবর
একদল অশিক্ষিত, বর্বর, যৌনবিকৃত পুরুষ তাকে নৃশংসভাবে হত্যার করার আগে একের পর এক উন্মত্ত হায়েনার মতো তার ওপর ঝাঁপিয়ে পরেছে। তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে পাশবিক শক্তি নিয়ে ওরা ঝাঁপিয়ে পরেছে। ধর্ষিতা হয়েও রূপা বাঁচতে পারেনি। পুলিশ ধর্ষক ও খুনিদের আটক করে আদালতে নিয়ে গেলে তারা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছে।
একজন তরুণী রূপার ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ড ঘিরে দেশজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় উঠতে না উঠতেই থেমে গেল। একের এক এক ইস্যু আসে, একের পর এক জলন্ত সব ইস্যু তামাদি হয়ে যায়। ভাসি খবরে না আছে গণমাধ্যমের আগ্রহ, না আছে মানুষের কথা বলার শক্তি। রোহিঙ্গা শরনার্থীদের ঘিরে তাদের অবর্ণনীয় জীবনের মর্মান্তিক ঘটনা এখন জলন্ত ইস্যু। তাই বলে আমরা কি রূপাকে ভুলে যাবো? ধর্ষিতা ও নিহত রূপা এদেশেরই সন্তান। সংবিধান, রাষ্ট্র তার জীবনের নিরপত্তা বিধানের যে অঙ্গীকার করেছিল, তা রক্ষা করতে পারেনি।
কিন্তু এমন বর্বোরোচিত পাশবিক ধর্ষণ ও নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে একজন রূপার জীবনের সকল স্বাদ, আহ্বালাদ, স্বপ্নের যেভাবে সমাধি দেয়া হয়েছে তাতে অগ্রসর সমাজের সচেতন বাসিন্দরা প্রতিবাদের ঝড় তোলার কথা। এই হত্যাকাণ্ড শুনে মানুষের বুক কেঁপেছে। কর্মজীবী বা একা চলাফেরা করা নারীদের নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন অভিভাবকরা।
রূপা হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে, রূপাকে জঘন্যভাবে বর্বর কাপুরুষদের হাতে ধর্ষিতা হওয়ার মধ্য দিয়ে যেন গোটা দেশবাসীকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে, কিশোরী বা তরুণী যেকোনো নারীর পক্ষেই একা চলাফেরা করা বিপদজনকই নয়, ধর্ষণ ও প্রাণ হারানোর সুযোগ থাকে। সোহাগী জাহান তনু হত্যা ও ধর্ষণের পর প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল, সেটি এখন তামাদি হয়ে গেছে। তনুর স্মৃতি নিয়ে হয়তো শুধু তার মা বাবাই কাঁদেন। আমরা আত্নবিস্তৃত জাতি তনুসহ অসংখ্য ধর্ষিতা নারীর কথা ভুলে গেছি। আমরা কি এবার ধর্ষিতা ও নিহত রূপাকেও ভুলে যাবো?
রূপা কারো সন্তান ছিল, রূপা হতে পারতো আমার-আপনার কারো সন্তান। যার যায়, যেন কেবল সে একা তার দহন ও বেদনা ভোগে। সন্তান হারানোর বেদনা এমনিতেই পিতামতা ও ভাইবোন সইতে পারে না। তার ওপর রূপার ঘটনায় যে ধর্ষণের উল্লাস চলেছে, যেভাবে ঘাড় মটকে হত্যা করা হয়েছে; মধ্যযুগীয় ঘটনাও এখানে ধূসর হয়ে গেছে। ধর্ষকরা যদি ধর্ষিতা ও নিহত রূপার জীবনের প্রদীপ নিভিয়ে স্বপ্নের সমাধি করে এমন নৃশংসতা হজম করতে পারে তাহলে তাদের মৃত্যুদন্ডের মতো শাস্তি নিশ্চিত না হয়, তাহলে এই ঘটনাও ধীরে ধীরে সবাই ভুলে যাবো। আর গোটা বাংলাদেশ ধর্ষক ও খুনির ভয়ে নিরাপদ মনে হবে না নারীর কাছে। যে যেখানে থাকুন, এই জঘন্য অপরাধের, এই ভয়াবহ ধর্ষণ ও হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ অব্যাহত রাখুন।
লেখক: সম্পাদক, পূর্বপশ্চিমবিডি.নিউজ