• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

বাবুল ভাই মনে পড়ে?

প্রকাশ:  ০৩ ডিসেম্বর ২০১৭, ০১:৪০
শামীম আজাদ

আমার হাতে একটি প্লাস্টিক ব্যাগ। ব্যাগের ভেতরে স্কিম্ড দুধের সবুজ ঢাকনাওলা প্লাস্টিক বোতল ভরা দুধ, বিলেতের আজকের পত্রিকা, দুটি আপেল, সদ্য বেক করা ছোট্ট একটি রুটি ও এক টুকরো মাখন। তাপমাত্রা প্রায় হিমাঙ্কের নিচে। উলের দস্তানা জোড়ার ভেতর হাত হিম হয়ে আসছে। আমার দুচোখ গড়িয়ে পড়ছে উষ্ণ নোনা জল। আমি মুচ্ছি না। ব্যাগ ছাপিয়ে রুটি ও মাখনের সুগন্ধ আসছে। এ মাখনের রং সাদা নয়, বাটা সর্ষের মতো। এ রুটিকে লোফ বলে না, বলে ব্রেড।

মনে পড়ল বাবুল ভাই ও তাঁর ভাইবোন ও আমরা যেখানে বড় হয়েছিলাম, সেই ছোট্ট সুন্দর শান্ত এক রাস্তার শহরের কথা। জামালপুরে আমরা কিন্তু লোফের মধ্যে ঘোষের ভাঁড়ে জলে কলাপাতায় ভাসা হাতে তোলা সাদা মাখন হতো। নান্নার ছাপড়া দোকানে আসত তিলের খাজা। আর আমাদের হীমসাগর গাছে হতো অসম্ভব মিষ্টি আম। মর ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে আমাদের বাংলা মার্কা টিনশেড বাড়িটা ছিল।

সম্পর্কিত খবর

    বাবুল ভাই, তোমাদের বাসা ছিল ওই রাস্তা থেকেই বেরিয়ে যাওয়া পোস্ট অফিসের পাশ গলিয়ে আমাদের গার্ল স্কুলের ঠিক পেছনে। আমার বাবা আর তোমার বাবা শরীফুল হক চাচা প্রবল শিল্পপ্রেমী বন্ধু ছিলেন। যারা ওই ছোট্ট শহরটিকে সাংস্কৃতিক আনন্দে, কৃষি শিল্প মেলা, নজরুলজয়ন্তী, রবীন্দ্ররাগিণীর আয়োজনে জাগিয়ে রাখতেন। আমরা সেই দুই বন্ধু-বাবার হাতে ধরে প্রথম পা ফেলেছিলাম সেই অঙ্গনে। সে সময় আমজাদ হোসেন ও আনোয়ার হোসেন আমাদের ওই টুকরো শহর থেকেই ঢাকায় নাম করতে শুরু করেছেন। তাঁদের সঙ্গে নাটক করতে আমাদের শহরে আসছেন সুজাতা। গান করতে আসছেন খন্দকার ফারুক আহাদ।

    মনে পড়ে বাবুল ভাই? চাচা ও আব্বা নদীর ধারে পাবলিক লাইব্রেরির হলে অনুষ্ঠান করবেন বলে চান মিয়া চাচার বাসায় আমাদের নিয়ে কি যে লাগাতার মহড়া দিতেন! বেনু দা তাঁর সেতার নিয়ে আসতেন। পরান দা তবলা জোড়া। আম্মা ও চাচি সুচির হালুয়া ও আটারুটি খাইয়ে আমাদের রিহার্সেলে পাঠাতেন। তখন চাচা ছিলেন জামালপুরের আনসার অ্যাডজুট্যান্ট আর আব্বা ফুড কন্ট্রোলার। আহা, সে ছিল আমাদের এক অনন্য নির্ভেজাল কৈশোর ও ঊষাকালের যৌবন।

    তুমি ও আমার ভাই শিবলী ছিলে অকৃত্রিম বন্ধু। তাই তোমাদের অনেকগুলো দুষ্টুমির খবর আমার জানা। আমি তোমার ছোট ভাই ইকবালের বন্ধু আর আমার ছোট ভাই তোমার ভাই হেলালের। বেলাল ও জেসমিনকে আমরা তখন হিসেবে ধরতাম না। ওরা আমাদের পেছনে ছিল দুধভাত।

    তখন ছোটদের সাইকেল আছে বলেও জানি না। জানলেও সৎ সরকারি চাকুরে বাবাদের যেখানে রেশনের চালে সংসার চলে, তাদের তা কেনার সামর্থ্য ছিল না। তোমরা ও আমরা সবাই বড়দের সাইকেলের রডের তিন কোনার ভেতর অদ্ভুতভাবে দেহ গলিয়ে ত্রিভঙ্গ হয়ে প্যাডেল মেরে সাইকেলে চড়া শিখেছি। পাথালিয়ার বিশাল বিশাল জামগাছ ছাওয়া রাস্তা থেকে আসত শেলী। আমড়াপাড়া থেকে ডলি। আর বকুলতলা থেকে আমি আর মন্টি। ওড়না কোমরে গেঁথে, সালোয়ার উঁচু করে আমি নামতাম পিয়ন আরব আলী ভাইয়ের সাইকেল নিয়ে। আর এমনি ভোরবেলা তুমি, গেন্দা ভাই, ভাইয়া আরও কে কে যেন তখন সারা রাস্তার এ মাথা ও মাথাজুড়ে লাইন ধরে প্রায় আমাদের গতিপথ রুদ্ধ করে ‘মর্নিং ওয়াক’ করতে! আসলে তো রাস্তায় নামতে আমাদের জন্য! ছেলেদের অমন ঘোরাফেরাকে আমরা বলতাম ফিল্ডিং। তখন এখনকার মতো মারাত্মক ইভ টিজিং ছিলও না। আমরা নড়বড়ে বালিকা সাইকেল চালিকা প্রাণপণে বেল দিতে থাকলেও একদম সরতে না। যখন প্রায় তোমাদের ঘাড়ে গিয়ে পড়ার সময় হতো। আমরা অসম্ভব নার্ভাস হয়ে পড়তাম, তখন দুষ্টু হাসি হেসে, ছেড়ে দেরে ছেড়ে দেরে বলে রাস্তা ছেড়ে দিতে। কোনোমতে ফোকর গলিয়ে বেরিয়ে গেলে শুনতাম তোমাদের হাসি। ওটাই ছিল আমাদের ফান। কিন্তু সবারটা ছাপিয়ে উঠত তোমার হা হা ধ্বনি। যা কিনা একদিন হয়ে উঠেছিল পুরো ঢাকাবাসীর এক অনন্য শক্তির উৎস।

    বাবুল ভাই, মনে আছে সেই আমাদের বাসার উল্টো দিকেই শুকনো খালের ওপারে ছিল ধাঙ্গর বসবাসের কথা? ছুটির দিনে আমাদের বৈঠকখানার মুখ বের করা খোলা বারান্দায় কাঠের পিলারে ঠেস দিয়ে তুমি আর ভাইয়া দেখতে ওদের ওদের গড়াগড়ি। বিকেল বেলা বকুলতলায় ক্রিকেট হাতে আমাদের বড় আপার ছেলে বুলবুল ভাইসহ খেলতে ক্রিকেট। তোমরা তখন আশেক মাহমুদ কলেজে পড়তে। আর ছুটিছাটাতে ঢাকা কলেজে পড়ুয়া জামাল ভাই এসে ছক্কা মারত তোমাদেরই মাঠে। আমি আর মন্টি তখন মা’য়ের জন্য বই ধার করার নাম করে ওই মাঠের সামনে দিয়ে একবার পাবলিক লাইব্রেরি যেতাম আবার ফিরে আসতাম।

    বাবুল ভাই, মাঝের গল্পগুলো আরও রঙিন। আরও চনমনে এবং তোমার অর্জনের এবং আনিসুল হক হয়ে ওঠার। এমনকি শেষের দিকের গল্পও। তত দিনে তুমি শুধু আনিসুল হক হয়ে শুধু সিঁড়ির পর সিঁড়ি মাড়িয়ে উঠেই চলেছ। সে আমি বিলেত চলে আসার পরও।

    আমাদের পারিবারিক সম্পর্কের কারণে আমাদের ছেলেমেয়েরাও ভাইবোনের নিগড়ে ঢাকা মাতিয়ে আনন্দ করে চলছিল। আর তুমি হয়ে উঠেছিলে দেশের এক অনন্য আইকন। ছোটবেলার সে দুর্বার বাবুল ভাই হয়ে উঠেছিলে ডাকাবুকো ঢাকা উত্তরের দেশপ্রেমী প্রবল পরাক্রান্তশালী মেয়র। নগরপিতা।

    কাল যখন তুমি দেহত্যাগ করেছ, এর দুই ঘণ্টার মধ্যে তীব্র শৈত্যের মধ্যে লন্ডন শহীদ মিনারে আমরা সবাই বিজয়ফুল নিয়ে যখন বিজয় মাসের সূচনা করার আগে তুমি ও তোমার কীর্তি স্মরণ করে এক মিনিট নীরব হয়েছিলাম। সমবেত মুক্তিযোদ্ধারা বলছিলেন, তুমি ছিলে তাঁদেরই উত্তরসূরি। তরুণেরা বলছিল, তাদের ছিলে অনুপ্রেরণা। অল্প বয়সীরা অবাক হয়ে ভাবছিল, কেন এই আনন্দের দিনে বিজয় মাসের সূচনালগ্নে আমরা এত ভারাক্রান্ত! কে সেই ব্যক্তি, যার কারণে বাংলাদেশের মানচিত্রের বাইরে এই মানুষগুলো এত কাতর হয়ে পড়েছে!

    চোখের জল গড়াচ্ছে। আমার ঘরে ফিরতে ইচ্ছে হচ্ছে না। আরেকটু পর রিজেন্ট পার্ক মসজিদে যাব। বিলেতে তোমার শেষকৃত্যে। গত তিন মাস এই লন্ডনেই নিথর হয়ে যখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছিলে, আমি ভেবেছিলাম তুমি সেই হাল্কের মতো যেভাবে চরম শক্তিতে দেশের বিদেশি দূতাবাসের স্ল্যাব উড়িয়ে গুঁড়িয়ে উঠে দাঁড়িয়েছিলে নির্ভীক বাংলাদেশ আবার দাঁড়াবেই তেমনি। কারণ, তোমার রুবানা তোমার পাশে তো আছেই। যে তোমার মিশন ও ভিশনের সঙ্গে হাত ধরা ধরি করে আছে প্রায় কিংবদন্তি নারীর মতোই। যে নারী জীবনে কোনো পরীক্ষায় দ্বিতীয় হয়নি। যে নারী এবারও শত হায়নার আঁচড় থেকে নিজে অসামাজিক অপ্রিয় হয়ে তোমাকে আগলে রেখেছিল। কিন্তু এ নারী এবার তোমাকে ফিরিয়ে আনার পরীক্ষায় অকৃতকার্য হলো। হায় অ্যাড্রোমেকি! তোমার ক্রন্দনে ও বীরের মহাপ্রয়াণে আমি পুষ্প রেখে যাই। আমাদের দেশের আগামীর সন্তানদের কাছে প্রত্যাশা রেখে যাই। হে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত বীর, আমরা তোমাকে ভুলব না।

    কবি ও কলামিস্ট

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close