এক যে ছিল চার্লি চ্যাপলিন
ভবঘুরে লোকটা দেখতে বড়ই কিম্ভূত। পরনে নোংরা ঢিলেঢালা প্যান্ট, গায়ে জড়ানো জীর্ণ কালো কোট, পায়ে মাপহীন জুতো, মাথায় কালো হ্যাট, বাটারফ্লাই ছাঁটা গোঁফের নিচে গুঁজে রাখা চুরুট আর হাতে বেতের ছড়ি। রাস্তায় রাস্তায় সে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর একের পর এক ঘটাচ্ছে অদ্ভুত সব ঘটনা। তার উদ্ভট কাণ্ডকারখানায় হেসে কুটিকুটি বিশ্বের কোটি মানুষ।
এই হলো বিশ্বজয়ী অভিনেতা চার্লি চ্যাপলিন। পুরো নাম স্যার চার্লস স্পেনসার চ্যাপলিন জুনিয়র। মূক-যুগের চলচ্চিত্রের শ্রেষ্ঠতম অভিনেতা। সারা বিশ্বের মতোই এই অভিনেতা বাংলাদেশেও সমান জনপ্রিয়। ১৮৮৯ সালের ১৬ এপ্রিল লন্ডনের ওয়ালস ওয়ার্থে চার্লি চ্যাপলিন পৃথিবীর মুখ দেখেন। জন্মদিনে চার্লি চ্যাপলিনের স্মৃতির প্রতি পূর্বপশ্চিমের বিনত শ্রদ্ধা।
সম্পর্কিত খবর
কিংবদন্তি অভিনেতা চার্লি চ্যাপলিনের সব চলচ্চিত্রের প্রধান উপদান হচ্ছে ব্যঙ্গ আর হাসি। শুধু কী তাই! চার্লির সব ছবিতেই হাসির আড়ালে আছে মনের গহীনে লুকিয়ে থাকা যন্ত্রণা। অট্টহাসির মাঝেই ধরা দেয় রূঢ় বাস্তবতা, উন্মত্ততা আর নিষ্ঠুরতা। হাস্যরসের মধ্য দিয়েই চার্লি চ্যাপলিন চলচ্চিত্রে তুলে ধরেন সমাজের বিভিন্ন অসঙ্গতিসহ তৎকালীন রাজনৈতিক সমস্যা, দুটি বিশ্বযুদ্ধ, হিটলারের নারকীয় হত্যাযজ্ঞ, জাতীয়তাবাদ, মানবাধিকারসহ নানা সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়বস্তু। প্রতিটি চলচ্চিত্রেই স্যার চ্যাপলিন কোনো না কোনো বক্তব্য তুলে ধরার চেষ্টা করে গেছেন।
শৈশব থেকেই চার্লি চ্যাপলিনের অভিনয় শুরু। শিশুশিল্পী হিসেবে চ্যাপলিন ইংল্যান্ডের ভিক্টোরিয়ান নাট্যমঞ্চে এবং মিউজিক হলে যাত্রা শুরু করেন। চার্লির বয়স যখন মাত্র তিন, তখনই বাবা-মায়ের মধ্যে বিচ্ছেদ হয়ে যায়। মা হান্নাহ চ্যাপলিন এবং ভাই সিডনির সাথে দক্ষিণ লন্ডনের বার্লো স্ট্রিটে থাকতেন তিনি। অত্যন্ত দরিদ্র আর কষ্টের মধ্যে কেটেছে শিশু চ্যাপলিনের ব্যক্তিজীবন। সেই কষ্টই তাকে নিয়ে আসে অভিনয়ে।
চার্লির মা-বাবা দুজনই মঞ্চের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাদের হাত ধরেই রঙ্গমঞ্চে অভিনয় শুরু চার্লির । লন্ডনের সেসময়ের জনপ্রিয় নাট্যদল ‘জ্যাকসন্স এইট ল্যাঙ্কাসায়ার ল্যাডস’-এর সদস্য হয়ে শৈশব-কৈশোরে তিনি পারফর্ম করেন ব্রিটেনের নানা জায়গায়। সেই বয়সেই নিজের অভিনয় প্রতিভার প্রমান দেন।
নিজের স্বপ্ন সার্থক করতে ১৯১০ সালে চ্যাপলিন চলে যান আমেরিকায়। ১৯১৪ সালে প্রথম অভিনীত ছবি ‘মেকিং এ লিভিং’-এর মাধ্যমে হলিউডে তার আবির্ভাব। একই বছর ১৯১৪ সালে ‘দ্য ট্রাম্প’ ছবিতে তার অভিনীত মুখ্য চরিত্র ’শার্লট‘ সেসময় ফ্রান্স, ইতালি, স্পেন, পর্তুগালে অলোচনার ঝড় তুলেছিল। এরপর একে একে ‘কিড অটো রেসেস অ্যাট ভেনিস’, ‘দ্য কিড’, ‘দ্য গোল্ড রাশ’ প্রভৃতি সিনেমা চ্যাপলিনকে খ্যাতির চূড়ায় নিয়ে যায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী যুগে কৌতুক চরিত্রে তাঁর অভিনয় পারদর্শিতা দর্শকদের মুগ্ধ করেছিল।
বিশ্ব যখন দু-দুটি বিশ্বযুদ্ধের ধাক্কায় বিপর্যস্ত তখন চার্লি চ্যাপলিন তার নির্বাক চলচ্চিত্রে কৌতুক অভিনয়ে তুলে এনেছেন সেসময়কার প্রধান চরিত্রগুলো। যা বিশ্ববাসীকে হাসালেও জানিয়ে দিয়েছিলো যুদ্ধের প্রকৃত ঘটনা। যেমন ১৯৪০ সালে তার বিখ্যাত ছবি ‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’ হিটলারকে ব্যঙ্গ করে নির্মিত হয়েছিল বলে অনেকের ধারণা।
চ্যাপলিন ১৯২৬ সালে ‘দ্য সার্কাস’ ছবির জন্যে প্রথম অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড জিতে নেন। এরপর ৪৩ বছর বয়সে পান দ্বিতীয়বারের মত অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড । মোশন পিকচারে অবদানের জন্যে ১৯৭২ সালে তিনি এ অ্যাওয়ার্ড পান। আবারও ১৯৭৩ সালে ‘লাইমলাইট’ ছবির জন্যে তাকে এ অ্যাওয়ার্ডে সম্মানিত করা হয়।
শুধু অভিনয় নয়, চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবেও তিনি বিশ্বখ্যিাত। নির্বাক চলচ্চিত্র যুগের সবচেয়ে জনপ্রিয় অভিনেতা চ্যাপলিন অভিনয় ছাড়াও সংলাপ রচনা, পরিচালনা ও প্রযোজনার দায়িত্ব পালন করেছেন। এমনকি চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালনায়ও তিনি অবদান রেখেছেন।
চলচ্চিত্রে চ্যাপলিন তার অভিনীত অনেক চরিত্র আজ অবদি ভক্তদের মনে দাগ কেটে আছে। একের পর এক বিখ্যাত ছবিতে অভিনয় আর বিখ্যাত সব ছবি নির্মাণে নিজেকে উৎসর্গ করে দেবার মধ্যেই আনন্দ খুঁজেছেন চার্লি চ্যাপলিন।
অভিনয়ের মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে মুগ্ধ করে রাখা এ বিশ্ববিখ্যাত চলচ্চিত্রাভিনেতা চার্লি চ্যাপলিন ১৯৭৭ সালের ২৫ ডিসেম্বর সুইজারল্যান্ডের ভেভেতে পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে যান। ৮৮ বছর বয়সে তিনি পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলেও তার অসামান্য কর্ম বিশ্ব-চলচ্চিত্রের ইতিহাসে তাকে আজও জীবন্ত করে রেখেছে।
এক নজরে চার্লি চাপলিন
পুরো নাম : স্যার চার্লস স্পেনসার চ্যাপলিন জুনিয়র
জন্ম : ১৬ এপ্রিল ১৮৮৯
জন্মস্থান : ওয়াল ওর্থ, লন্ডন, ইউ কে।
মৃত্যু : ২৫ ডিসেম্বর ১৯৭৭
মৃত্যুর স্থান : ভেভে, সুইজারল্যান্ড
মৃত্যুকালে বয়স : ৮৮ বছর
স্ত্রী : মিল্ডরেড হ্যারিস (১৯১৮-২০)
লিটা গ্রে (১৯২৪-২৮)
পাউলেট্টে গর্ডাট(১৯৩৬-৪২)
ওনা ওনিল (১৯৪৩-৭৭)
সন্তান : ৩ জন
জাতীয়তা : ব্রিটিশউল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র : মেকিং অব লিভিং (১৯১৪), দ্য ট্রাম্প (১৯১৪), কিড অটো রেসেস অ্যাট ভেনিস (১৯১৫), এ ডগস লাইফ (১৯১৭), শোল্ডার আর্মস (১৯১৮), দ্য কিড (১৯২১), দ্য সার্কাস (১৯২৬), সিটি লাইটস (১৯৩১), মডার্ন টাইমস (১৯৩৬), দ্য গ্রেট ডিক্টেটর (১৯৪০), দ্য গোল্ড রাশ (১৯৪২), লাইম লাইট (১৯৫২), এ কিং অব নিউইয়ক (১৯৫৭) প্রভৃতি।
পূর্বপশ্চিম- এনই