• সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

কিশোর গেরিলা মোজাম্মেলের হাতে মোনায়েম খান খতম

প্রকাশ:  ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১১:৪৩
পূর্বপশ্চিম ডেস্ক

একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দখলে থাকা ঢাকায় একের পর এক গেরিলা আক্রমণের পাশাপাশি যে প্রবল আলোচিত অপারেশন ঢাকা কাঁপিয়ে দিয়েছিল সেটি হচ্ছে গভর্নর মোনায়েম খান কিলিং! নবম শ্রেণিতে পড়া ১৪ বছর বয়সী এক কিশোর গেরিলা মুক্তিযোদ্ধার অসমসাহসী কৌশলী অপারেশনে নিহত হয়েছিল সুরক্ষিত নিরাপত্তায় থাকা পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম। যা সাড়া ফেলেছিল গভীরভাবে, পাকিস্তানিদের মনোবলে আঘাত হেনেছিল মারাত্মক!

তেজগাঁও পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের পড়ুয়া মোজাম্মেল হক ছোট থেকেই ছিল রাজনীতি সচেতন। প্রতিদিন বাসে করে স্কুলে যাওয়ার পথে বিহারী অবাঙালি ড্রাইভার-হেল্পারেরা যে বাঙালিদের পছন্দ করে না, দুর্ব্যবহার করে কোনো কারণ ছাড়াই, সেটা তার চোখ এড়াতো না। ক্লাস সিক্স থেকেই কলেজের ছাত্রদের সাথে কিশোর মোজাম্মেল শেখ মুজিবের সব জনসভায় যেতো, স্লোগান শুনতো আইয়ুব-মোনায়েম দুই ভাই/ এক রাশিতে ফাঁসি চাই। তখন থেকেই তার মনে হত মোনায়েম খান লোকটা বাঙালি হবার পরেও সবাই আইয়ুবের সাথে এক দড়িতে ফাঁসি চায় তার, তাহলে তো সে নিশ্চয়ই খুবই খারাপ!

সম্পর্কিত খবর

    মার্চের সেই উত্তাল আন্দোলনের দিনগুলো পেরিয়ে হঠাৎ করেই ২৫শে মার্চ চলে এল। অপারেশন সার্চলাইট নামের বীভৎস গণহত্যা চালিয়েছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। অত্যাধুনিক ভারি অস্ত্রশস্ত্রে ছড়িয়ে পড়ছে দেশময়, চালিয়ে যাচ্ছে শতাব্দীর অন্যতম ভয়ংকর গণহত্যা! চারিদিকে শুধু ভয় আর আতংক, প্রাণ হাতে পালাচ্ছে মানুষজন। মে মাসের দিকে কিশোর মোজাম্মেল মুক্তিযোদ্ধাদের ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট গ্রুপে যোগ দেই। সেক্টর কমান্ডার ছিলেন খালেদ মোশাররফ। সেকেন্ড ইন কমান্ড ছিলেন মেজর হায়দার। ক্যান্টনমেন্ট গ্রুপের কমান্ডার ছিলেন এম এ লতিফ, সেকেন্ড ইন কমান্ড ছিলেন রহিমুদ্দিন। ১৩ সদস্যদের এই দলটি মেলাঘরে ট্রেনিং শেষে নিজেদের এলাকায় অপারেশনের জন্য নিযুক্ত হলেও কুমিল্লা বর্ডারে ক্রস করার সময় পাকিস্তানিনী আর্মিদের এমবুশে পড়ে যায়। ফলে সেখান থেকে তাদের আবার মেলাঘরে ফেরত আসতে হয়।

    এ পর্যায়ে মেজর হায়দার বললেন, তোমাদের দিয়া গেরিলা অপারেশান হবে না। পাকিস্তানি আর্মিদের এমবুশে পড়ে তোমাদের নৈতিক পরাজয় ঘটেছে। তোমরা শুধু ক্যাম্পে ক্যাম্পে গোলাবারুদ আনা নেওয়া করবা। এটা শুনে মোজাম্মেল আহত বোধ করলেন। পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রচণ্ড জিদ কাজ করছিল কিশোর মোজাম্মেলের মধ্যে। তার জন্য যে করেই হোক ফিরতে হবে যুদ্ধের ময়দানে।

    মেলাঘরে ক্যাম্পের বিশ-বাইশ গজ দুরত্বে একটা ছনের দোচালা বেড়া ঘরে ছিল মেজর হায়দারের অফিস। মাঝখানে একটা টেবিল নিয়ে সব সময় ওখানে বসে কাজ করতেন তিনি। প্রতিদিন সেখানে দাঁড়িয়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা শুরু করলেন মোজাম্মেল একটানা বাইশ-তেইশ দিন। ঘন্টার পর ঘন্টা। তার টার্গেট যেভাবেই হোক হায়দারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। অনেক অপেক্ষার পর একদিন সেই সুযোগ হলো। তিনি বললেন, “কিরে এইহানে দাঁড়ায়া আছস ক্যান।” সুযোগ পেয়েই মোজাম্মেল বললেন, “আমারে গেরিলা যুদ্ধে পাঠান।”

    হায়দার জিজ্ঞেস করলেন, “তোর সাহস কেমন, কারে মারতে পারবি?” শুনে কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন, যেহেতু পাকিস্তানি সৈন্যদের মারাটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সুতরাং তিনি বললেন, “স্পিকার আব্দুল জব্বার খানকে মারতে পারমু।” সমস্যাটা হলো সেখানেই, তাদের সাথেই ট্রেনিং ক্যাম্পে ছিল জব্বার খানের ছেলে বাদল। সুতরাং চাইলেও ব্যাপারটা সহজ হবে না তখন। মোজাম্মেল অনেকক্ষণ চিন্তা করেও ভেবে কূলকিনারা না পেয়ে হায়দারকেই আবার জিজ্ঞেস করলেন, “আপনিই কন, কারে মারতাম?”

    কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর হায়দার বললেন, “মোনায়েম খানরে মারতে পারবি?” সঙ্গে সঙ্গেই মোজাম্মেলের মনে হলো তার চাচা মোনায়েম খানের বাড়িতে সিন্ধি গরুর দুধ দোহন করে। তিনি বললেন, মারতে পারলে কি দিবেন? হায়দার মজা পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কি চাস? বললাম, কোমরের পিস্তলটা চাই। হায়দার হেসে বললেন, মারতে পারলে এই পিস্তল তো কিছুই না, বাঙালি জাতি তোরে মাথায় লইয়া নাচবো। মোজাম্মেল

    বললেন পারবেন, মনে মনে বললেন, তাকে পারতেই হবে। এরপর হায়দার তার পিঠ চাপড়ে দিলেন। মোজাম্মেল তার সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, আজো তিনি মাঝে মইধ্যে ওই পিঠ চাপড়ানো টের পান। তাকে অসম্ভব সাহস আর শক্তি দিয়েছিল মেজর হায়দারের সেই পিঠ চাপড়ানো। সেপ্টেম্বর মাসের শেষ দিকে তাকে ঢাকায় পাঠানো হলো।

    ঢাকা এসেই ভাটারায় গেলেন মোজাম্মেল। তার চাচা আব্দুল জব্বারের দুধ দোহনের সূত্রে মোনায়েম খানের বাসায় নিয়মিত যাতায়াত ছিল। তাকেই মোজাম্মেল প্রথম প্রস্তাব দিলেন মোনায়েম খানকে হত্যায় সহায়তা করতে। চাচা প্রবলভাবে অস্বীকৃতি জানিয়ে বললেন, “পাকিস্তানিরা আমাগো সব বাড়িঘর জ্বালায়া দিবো।” এরপর মোজাম্মেল মোনায়েমের বাড়ির চাকর শাহজাহান আর মোখলেসের সাথে খাতির জমালেন। শাহজাহান ছিল রাখাল, সে মোনায়েমের উপর ক্ষিপ্ত ছিল কারণ সে অতিরিক্ত খবরদারি করত এবং নিয়মিত বেতন দিত না। কয়েকবার পালিয়ে গিয়েও লাভ হয়নি। মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজছে সে, যদি তারা কিছু করতে পারেন। মোজাম্মেল বুঝতে পারলেন একে দিয়েই তার কাজ হবে।

    মোজাম্মেল বললেন, “বিকেলে গরু বাইন্দা ছুটি হইলে আইয়া পড়েন। গুলশানে দুই নম্বরের আরমান রেস্টুরেন্টে। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পরিচয় করাইয়া দিমু।” দুদিন তাকে ঘোরালেন মোজাম্মেল, পরে বুঝলেন সে আসলেই সাহায্য করতে রাজি। তারপর তাকে বললেন, মুক্তিবাহিনী লাগবে না, তিনিই মোনায়েমকে মারবেন। তৃতীয় দিন মোজাম্মেল শাহজাহানের সঙ্গে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। ভারতীয় স্টেনগান-৩৬, এইচজিহ্যান্ড গ্রেনেড আর একটা ফসফরাস। ফসফরাসের ব্যবহার হলো আগুন লাগানোর জন্য। শাহজাহানের সাথে গরু ঢোকানোর সময় ঢুকলেন তিনি মোনায়েমের বাড়িতে। গরু ঢোকানোর একটা আলাদা গেইট আছে। ওই গেইটের সঙ্গে মূল বাড়ির আরেকটা ছোট্ট গেইটের সঙ্গে সংযোগ আছে। পাশেই ছিল কলাবাগান।

    বাড়িতে ঢুকেই কলাবাগানে লুকিয়ে থাকলেন মোজাম্মেল। ভেতর থেকে ঘুরে এসে শাহজাহান বললেন আজকে আর হবে না, উনি অসুস্থ, উপরে উঠে গেছেন। মোনায়েমের ছেলে দোতলার সিড়ির প্রথম ঘরটাতে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে থাকে। রিস্ক বেশি। শুনে মোজাম্মেল বের হয়ে আসলেন, মোনায়েমের বাড়ির পাশে গির্জার কোনে একটা ইটের স্তুপ ছিল, অস্ত্রের ব্যাগটা সেখানে রেখে আসলেন। পরদিন আবার প্রস্তুতি নিয়ে ঢুকলেন মোজাম্মেল। গরু ঢোকানোর গেইটের মধ্যে একটা ২০০ ওয়াটের বাল্ব জ্বলছিল। প্রথমেই ওটা ভেঙে ফেললেন মোজাম্মেল যেন তার অবস্থান বোঝা না যায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বালব ভাঙায় শোরগোল পড়ে গেল চোর ঢুকছে, চোর ঢুকছে চেঁচামেচিতে। ধরা পড়ার ভয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ির উত্তর পাশ দিয়া লাফ দিয়ে বের হয়ে আসলেন তিনি। কোনোক্রমে বেঁচে গেলেন।

    এরপর দুইদিন শাহজাহান আর মোখলেসের সাথে দেখা করেননি মোজাম্মেল, হঠাৎ ১৩ অক্টোবর শাহজাহান খুঁজে বের করল মোজাম্মেলকে। দুদিন না যাওয়ায় তারা ভেবেছে মোজাম্মেল তাদের বিশ্বাস করতে পারছেন না। বাধ্য হয়ে শাহজাহান আবার তার ক্ষোভের কথা বলল মোনায়েম খানের বিরুদ্ধে। সে মনেপ্রাণে চায় কেউ যেন মোনায়েম খানের একটা চূড়ান্ত ব্যবস্থা করে, কারণ মোনায়েম খান শুধু যে বাঙালির প্রাণের শত্রু, পাকিস্তানিদের চালানো বর্বর জেনোসাইডের অন্যতম প্রধান সহযোগী অংশীদার, তাই তো নয়, একইসাথে সে এই তুলনামূলক ছোট অবস্থানে থাকা শাহজাহানের জীবনের অন্যতম দুঃস্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। মোজাম্মেল লিখেছেন, “শাহজাহানের কথা শুনে আমার মনে হইলো, মরি আর বাঁচি যাই হোক আমার আজকে যাইতেই হবে এবং যা করার আজকেই করতে হইবো।”

    মোনায়েম খান,বীরপ্রতিক মোজাম্মেল হক
    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close