কিভাবে মৃত অবস্থা থেকে বেঁচে ওঠে মানুষ

জন্মের পর চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করলেন শিশুটিকে। অথচ এর কিছু ঘন্টা পরেই নড়ে ওঠে শিশুটি। এমন অপ্রত্যাশিত কিংবা আশ্চর্যজনক ঘটনা শুনেছেন বা দেখেছেন অনেকেই। অনেক সময় বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যেমে উঠে আসে ঘঠণাগুলো।

২০২০ সালের ১৬ অক্টোবর ভোরবেলা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এক কন্যা সন্তানের জন্ম দেন শাহিনুর বেগম নামে এক নারী। জন্মের পরপরই নবজাতকটিকে মৃত ঘোষণা করেন দায়িত্বরত চিকিৎসক। ইয়াসিন মোল্লা নামে শিশুটির বাবা মৃত সন্তানকে দাফন করতে নিয়ে যান কবরস্থানে। দাফনের আগেই নড়ে ওঠে শিশুটি। তখনি শিশুটি আবার ফিরিয়ে আনা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এবং দেওয়া হয় চিকিৎসা।

এরকম আরেকটি ঘটনা ঘটে ২০১৬ সালের ২২ সেপ্টেম্বর ফরিদপুর জেলার আলীপুরে। স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমে বলা হয়, জন্মের কিছুক্ষণ পর শিশুটিকে মৃত ঘোষণা করেন স্থানীয় একটি হাসপাতালের চিকিৎসক। পরে কবর দেয়ার আগে হঠাৎ করেই কেঁদে ওঠে শিশুটি।

অনেকের কাছে এই সব ঘটনা অলৌকিক মনে হলেও এর পেছনে রয়েছে বৈজ্ঞানিক কারণ। ‘মৃত’ ঘোষণা করার পর জেগে ওঠার বা জীবিত হওয়ার এই ঘটনাকে বলা হয় ‘ল্যাজারাস সিনড্রোম’। রাজধানী ঢাকার ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালের ভাস্কুলার সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ডা. সাকলায়েন রাসেল ল্যাজারাস সিনড্রোম নিয়ে কাজ করছেন। সম্প্রতি তিনি তার একটি বইয়ে এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেছেন। খবর বিবিসির।

তাহলে চলুন জেনে নেওয়া যাক ‘ল্যাজারাস সিনড্রোম’ কী ও কেন এটি হয়?

ল্যাজারাস সিনড্রোম কী?

যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরী অব মেডিসিন এবং ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব হেলথ এর তথ্য অনুযায়ী, ল্যাজারাস সিনড্রোম হলো ‘কার্ডিও পালমোনারি রিসাসিটেশন বা সিপিআর দেয়া শেষ করার পর দেহের সঞ্চালন প্রক্রিয়া স্বতঃস্ফূর্তভাবে ফিরে আসা বা রিটার্ন অব স্পনটেনিয়াস সার্কুলেশন-আরওএসসি।’

চিকিৎসা বিজ্ঞানে সর্বপ্রথম ১৯৮২ সালে এ ধরণের ঘটনার প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়। এর দুই বছর পর এই ঘটনাগুলোকে ল্যাজারাস সিনড্রোম হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এই নামটি নেয়া হয়েছিল বাইবেলে বর্ণিত ল্যাজারাস নামে এক ব্যক্তির কাহিনী থেকে। বলা হয় যে, ল্যাজারাসকে তার মৃত্যুর চার দিন পর জীবিত করেছিলেন যিশু খ্রিস্ট।

ডা. সাকলায়েন রাসেল বলেন, ‘ওই যে একজন মানুষ জীবিত হলেন বা মারা যাওয়ার পর বেঁচে উঠলেন, সেজন্য অন্য কেউ মারা যাওয়ার পর যদি জেগে ওঠে তাহলে ওই ঘটনার সাথে মিল রেখে তাকে আমরা বলি ল্যাজারাস সিনড্রোম’

জার্নাল অব দ্য রয়াল সোসাইটি অব মেডিসিন এর একটি গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয় এখন পর্যন্ত ৩৮টি ল্যাজারাস সিনড্রোমের ঘটনাকে নথিবদ্ধ করা হয়েছে। এর মধ্যে সাত জন বাদে বাকিদের গড়ে ২৭ মিনিট ধরে সিপিআর দেয়া হয়েছিল।

এই ৩৮ জনের মধ্যে ১৭ জন জেগে উঠার পরপরই আবার মারা যায়। বাকি ১৭ জনকে হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছিল। এদের মধ্যে তিন জন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। ১৪ জন চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যায় এবং বাকি ৪ জন রোগীর ক্ষেত্রে তেমন কোন তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি।

কেন 'মৃত' মানুষ জেগে উঠে ?

যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরী অব মেডিসিন এবং ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব হেলথ এর তথ্য অনুযায়ী, মৃত্যু কোন একটি ঘটনা নয়, বরং এটি একটি প্রক্রিয়া।

ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালের ভাস্কুলার সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ডা. সাকলায়েন রাসেল বলেন, ল্যাজারাস সিনড্রোম কেন হয় সে বিষয়ে এখনো তেমন কোন সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না।

তবে এ পর্যন্ত দুটি তত্ত্বকে এই সিনড্রোমের জন্য দায়ী বলে মনে করা হয়। এর মধ্যে একটি হচ্ছে সিপিআর ও দ্বিতীয়ত হলো মানুষকে জরুরী ভিত্তিতে দেওয়া ইনজেকশন।

সাকলায়েন রাসেল বলেন, ‘কোন রোগীকে জরুরী অবস্থায় হাসপাতালে আনার পর তাকে সিপিআর বা কার্ডিও পালমোনারি রিসাসিটেশন দেয়া হয়। এতে ওই মুহূর্তে মনে হয় যে, ওই ব্যক্তি মৃত। কিন্তু কিছুক্ষণ পর তার ইলেক্ট্রিক্যাল অ্যাক্টিভিটিস, হৃদপিণ্ডে রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়া চালু হয়ে গিয়ে ওই ব্যক্তি জেগে উঠতে পারে। আবার, যখন সিপিআর দেয়া হয় তখন ফুসফুসে অনেক বাতাস জমে। সেটি বের হতে পারে না। কিন্তু সিপিআর দেয়া শেষ হয়ে গেলে বাতাস বের হতে থাকে এবং রক্ত সঞ্চালন শুরু হয়।’

দ্বিতীয়ত তত্ত্বটি হলো মানুষকে জরুরী ভিত্তিতে যে ইনজেকশন দেয়া হয়, সেটি হয়তো তাৎক্ষণিক ভাবে কাজ করে না। তবে কিছুক্ষণ পর হয়তো সেটি কাজ করা শুরু করে এবং হৃদযন্ত্র চালু হয়ে যায়। এতে করে ওই ব্যক্তির মধ্যে অনুভূতি ফিরে আসে।

কিভাবে জেগে ওঠে মানুষ?

২০১৩ সালে ইংল্যান্ডের উইল্টশায়ারে ল্যাজারাস সিনড্রোমের আরেকটি ঘটনা ঘটে। সেখানে ক্যারল ব্রাদার্স নামে ৬৩ বছর বয়সী এক নারীর হৃৎস্পন্দন বন্ধ হয়ে যাওয়ার ৪৫ মিনিট পর আবার জেগে ওঠেন তিনি।

এ বিষয়ে নিউ ইয়র্কের স্টোনি ব্রুক ইউনিভার্সিটির রিসাসিটেশন রিসার্চ বা পুনরুত্থান গবেষণা বিষয়ক বিভাগের পরিচালক ডা. স্যাম পারনিয়া বলেন, ‘৪৫ মিনিট খুবই তাৎপর্যপূর্ণ এবং এই সময়ের মধ্যে অনেক মানুষই তাকে মৃত বলে জেনেছে। কিন্তু এখন আমরা জানি যে, অনেক মানুষ রয়েছে যারা মৃত ঘোষণা করার তিন, চার বা পাঁচ ঘণ্টা পর ফিরে এসেছে এবং স্বাভাবিকভাবে জীবন যাপন করছে।’

ডা. স্যাম পারনিয়া বলেন, বেশিরভাগ মানুষ কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট-কে মৃত্যুর সমার্থক বলে মনে করে থাকেন। কিন্তু এটা আসলে চূড়ান্ত কিছু নয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানে মনে করা হয় যে, যদি কারো হৃদযন্ত্র ২০ মিনিটের বেশি সময় ধরে বন্ধ থাকে তাহলে তার মস্তিষ্কে অপূরণীয় ক্ষতি হয়। কিন্তু ডা. স্যাম পারনিয়ার মতে, এই ক্ষতিও এড়ানো সম্ভব ভাল মানের সিপিআর এবং জেগে ওঠার পরবর্তী চিকিৎসার মাধ্যমে।

ল্যাজারাস ইফেক্ট নামে একটি বইয়ে তিনি লিখেছেন, ‘রক্ত সঞ্চালনের মাধ্যমে মস্তিষ্কে অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলে সাথে সাথেই সেটি নষ্ট হয়ে যায় না। বরং এক ধরণের হাইবারনেশনে চলে যায়। এটি মূলত মস্তিষ্ক নষ্ট যাওয়া রোধের একটি নিজস্ব উপায়।’

এই হাইবারনেশনে থাকা মস্তিষ্ক জেগে ওঠার মুহূর্ত খুবই বিপদজনক। কারণ এই সময়ে মস্তিষ্কে যে অক্সিজেন সরবরাহ করা হয় সেটি বিষাক্ত হয়ে পড়তে পারে। আর এটি রোধে রোগীর দেহ ৩৭ থেকে ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় রাখার কথা বলেন ডা. স্যাম পারনিয়া।

পূর্বপশ্চিমবিডি/জেএস