• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

একজন মিথি ও পোড়া মাংসের ঘ্রাণ

প্রকাশ:  ৩০ মার্চ ২০১৯, ২০:০৭
হাসনাত কাদীর

বিখ্যাত সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় তার কবি উপন্যাসে বলেছিলেন, জীবন এতো ছোট ক্যানে... জীবন এতো ছোট ক্যানে...? এই প্রশ্নের উত্তর তিনি পাননি। কিন্তু ছোট এই জীবন যদি থেমে যায় মানবসৃষ্ট বিপর্যয়ে তখন বেদনার সীমা-পরিসীমা থাকে না। আমাদের দেশটা এগিয়ে যাচ্ছে দ্রুত। কিন্তু স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা আমরা দিতে পারছি না। মানুষ মরছে- ভেজাল আর বিষাক্ত খাদ্যে। মানুষ মরছে- হুটহাট সড়কে পিষ্ট হয়ে। মানুষ মরছে- টুপটাপ বহুতল ভবন থেকে খসে পড়ে। মরছে আগুনে ঝলসে, জ্বলেপুড়ে।

তানজিলা মৌলি মিথি। প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর এক তরুণী। স্বামী রায়হানুল ইসলাম রিমনের সঙ্গে তার সুখের সংসার। ছোট ঘর, ছোট আশা। ছোট ছোট স্বপ্ন আর ভালোবাসায় মোড়ানো স্বপ্নের মতো জীবন কেটে যাচ্ছিল। কিন্তু ছোট এই জীবন যে এতো দ্রুত জ্বলে-পুড়ে-মরে নিঃশেষ হয়ে যাবে কে তা জানতো!

মিথি ঢাকায় একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি বনানীর এফ আর টাওয়ারে অবস্থিত ট্যুারিস্ট অ্যান্ড হেরিটেজ নামের একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। টাওয়ারের দশম তলায় ছিলো তার অফিস। তার স্বামী রিমন চাকরি করেন ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্সে।

আগামী ২ এপ্রিল বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার সান্তাহার পৌরশহরের বশিপুর গ্রামে বাড়িতে যাবেন বলে জানিয়েছিলেন বাবা মাসুদুর রহমান ও মা নাসরিন সুলতানাকে। সেদিন মিথির বিবাহবার্ষিকী। কত হৈচৈ আনন্দে কেটে যাবে সময়। মা-বাবা তার একমাত্র সন্তানের জন্য অপেক্ষায় বসে আছেন। দিনটাকে কীভাবে আরও রঙ্গিন করা যায় হয়ত সেসব নিয়ে অন্ত নেই ভাবনার।

মিথি ঠিকই বাড়িতে গেলেন। গেলেন নির্দিষ্ট তারিখের আগেই। তবে জীবিত নয়, লাশ হয়ে। মিথির মা কাঁদছেন। সংজ্ঞা হারাচ্ছেন। আর একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে হয়ত সৃস্টিকর্তার কাছে জিজ্ঞাসা করছেন, জীবন এতো বড় ক্যানে? খোদা, আমি এখন কী নিয়ে এই লম্বা জীবন কাটাবো?

মিথির বড় চাচা সালাউদ্দিন সরদার জানান, বনানী এফ আর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডের সময় মিথি তার অফিসেই ছিলেন। অনেকের মতো তিনিও আগুনে আটকা পড়েন। বাঁচার জন্য সবার মতো জানান আকুতি।

অগ্নিদগ্ধ মিথি দিশেহারা হয়ে ফোন করেন তার বাবাকে। ফোন করেন প্রাণের মতো ভালোবাসা প্রিয় স্বামীকে। মিথি এই সুন্দর জীবন ছেড়ে এতো দ্রুত যেতে চান না। কিছুতেই না। কোনমতে তিনি মোবাইল বলতে পারেন, আমাদের অফিসে আগুন লেগেছে, আমি আগুনে আটকা পড়ে আছি। আমাকে বাঁচাও, আমি বাঁচতে চাই।

মেয়েকে বাঁচাতে বাবা মাসুদুর রহমান দিশেহারা হয়ে বগুড়ার সান্তাহার থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন। স্বামী রিমন যতটা সম্ভব নিজেকে সামলে শুধু বলতে পারেন, তুমি উপরের দিকে উঠতে থাকো।

কিন্তু কত উপরে যাবে মিথি? দুর্নীতি আর বিশৃঙ্খলা, মানুষের লোভ আর অসততাকে দুপায়ে মাড়িয়ে নিজের জীবন রক্ষা করবে এমন কী সাধ্য তার? মিথি পারেনি। পারে না কেউই। তাই আগুনে ঝলসে পরিণত হয় এক একটা পোড়া মাংস পিণ্ডে।

এই লোভী ও অসৎ সমাজ সেই মাংসের ঘ্রাণে কতটা আহ্লাদ বোধ করে জানে না মিথির বাবা। কিন্তু তার একমাত্র সন্তানের মুখ দেখে চেনার উপায় থাকবে না এ কথা জানে প্রকৃতি। তাই পুড়ে অঙ্গার হওয়ার আগে মিথির হাতে একটি আংটি ছিল। যেন অন্তত সেটা দেখে একজন পিতা তার পুড়ে খাক হয়ে যাওয়া মেয়েটিকে চিনতে পারেন। চিনে পোড়া লাশটিকে কাঁধে করে নিতে পারেন ঢাকা থেকে সুদূর বগুড়ায়। যেখানে মিথির মা বসে আছেন অপেক্ষায়!

কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল থেকে যখন সুন্দর মিথি মায়ের কাছে চলেছে পোড়া লাশ হয়ে, তখন এই বাংলার বাতাসে ঘুরছে মাংস পোড়া ঘ্রাণ! ঘ্রাণ না গন্ধ! আমরা জানি না। কিন্তু পোড়া মাংসের স্বাদ বড় ভয়ানক। কিছুটা অমানবিকতা, লোভ আর অসততার মাদে চুবিয়ে যারা সেটা খেতে পারে তারা হয়ত ভাবে, এ জীবন অফুরন্ত। আর ক্লীব সুশীল ও 'ভদ্দরনোকেরা' কপালে ভাঁজ ফেলে গোনার চেষ্টা করে 'মাংসাশী' মানুষের সংখ্যা কত?

তাদের সিংহভাগই সেলফি তোলে। লাইভ নাটক দেখে। লাশের পাশে ছবি তুলে চলে যায়। তবু হাত ধরে রাস্তায় দাঁড়ায় না একবার। একবার গলা ছেড়ে বলে না, জীবন কত ছোট! ছোট এ জীবনের পুরোটা বাঁচতে চাই। বাঁচতে দাও। চল বাঁচতে দেই।

না, বলি না আমরা কেউই। বলি না বলেই এতো এতো অনিয়ম, অসততায় মৃতুর লেলিহান শিখা বেড়ে ওঠে আমাদের চারিধারে। পুড়ে ঝলসে দেয়, অঙ্গার করে জননীর কোলে পাঠায় একের পর এক সিঁথিদের।

সিঁথির পোড়া মাংসের ঘ্রাণ আমাকেও আহ্লাদিত করে কি? আপনাকেও? ক্লীব জনতার এখন নিজেদের প্রশ্ন করার সময় এসেছে, নগর পুড়িলে দেবালয় কি এড়ায়?

আমরা জানতে পারি, ২৯ মার্চ সকাল ১১ টার দিকে মিথির মরদেহ ঢাকা থেকে তার মায়ের কাছে পৌঁছায়। সে সময় পুরো এলাকা ছিল শোকের চাদরে মোড়া।

আমরা আরও জানতে পারি, এরপর জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তার দাফন করা হয়। একসময় তার মা কান্নার শক্তি হারিয়ে ফেলেন বলেও আমাদের জানা আছে।

কিন্তু আমরা কিছুতেই জানতে পারি না, এরপর মিথির মা, মিথির বাবা কিংবা যে যুবক তাকে ভালোবেসে সুখের সংসার পেতেছিলেন তাদের জীবন কতটা দীর্ঘ হয়ে যায়। কতটা তীব্র ও প্রকট আগুন জ্বলতে থাকে বুকে ভেতর।

এবং কী তীব্র আগুনে বাংলার বুক পুড়ে খাক হতে থাকে, কেন হতে থাকে সেটাও আমাদের জানা হয় না।

পিবিডি/ এইচকে

আগুন,মিথি,হাসনাত কাদীর
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close